শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
এই তীর্থদর্শনে এলে প্রথমেই আসতে হবে নাসিকে। সত্যযুগে ভগবান ব্রহ্মা এই নাসিকে পদ্মাসনে বসে সৃষ্টি চিন্তা করেছিলেন, তাই এর নাম ‘পদ্মনগর’। ত্রেতাযুগে ঘন অরণ্য পরিবেষ্টিত এই নাসিকে খর, দূষণ এবং ত্রিশির নামক রাক্ষসের বিচরণ ভূমি ছিল, তাই এর নাম হয়েছিল ‘ত্রিকণ্টক’। জনকরাজা এখানে অনেক যজ্ঞ করেছিলেন বলে দ্বাপরে এর নাম হয়েছিল ‘জনস্থান’। কিন্তু কলিযুগের মানুষের কাছে লক্ষ্মণ কর্তৃক শূর্পণখার নাসিকা ছেদন কারণে এই স্থান নাসিক নামেই পরিচিত।
নাসিকে এসে আমি পঞ্চবটীতে সিন্ধানিয়া ধর্মশালায় উঠেছিলাম। নাসিক এবং পঞ্চবটী একই শহর হলেও গোদাবরী নদী এই শহরটিকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। গোদাবরীতে স্নান ও সপ্তশৃঙ্গী দর্শনের অভিলাষে এই শহরে আমি দু’বার এসেছিলাম।
ধর্মশালার খুব কাছেই বাস স্ট্যান্ড। সেখান থেকে সপ্তশৃঙ্গী যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। সেই বাস অবশ্য সপ্তশৃঙ্গী যায় না। এই বাসে নান্দুরি পর্যন্ত গিয়ে বাস বদল করতে হয়। ভাগ্য ভালো যে স্ট্যান্ডে যাওয়ামাত্রই সিবিএসের একটি বাস পাওয়া গেল।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ছাড়ল বাস। পথের দূরত্ব ৪৮ কিমি। পথে দিন্দুরি ও ওনি নামে দু’জায়গায় বাস থামল। তারপর ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম চানবরগাঁও তালুকের সপ্তশৃঙ্গীর পাদদেশে নান্দুরিতে। সেখান থেকে অন্য বাসে সপ্তশৃঙ্গী।
প্রথমেই এখানকার একটি ধর্মশালায় আশ্রয় নিলাম। ঘন পর্বতমালায় শোভিত এই পুণ্যক্ষেত্রে এসে আনন্দে নন্দিত হয়ে উঠলাম। এবার যাত্রীসাধারণের জ্ঞানার্থে বলি, আমি কিন্তু নান্দুরি থেকে সরাসরি বাসে আসিনি। এসেছিলাম এক দুর্গম পন্থায় রোদনতুণ্ড হয়ে। পরবর্তীকালে বাসে এসেছিলাম। আমারই লেখা দশমাতৃকা তীর্থে এই ব্যাপারে বিশদ আছে।
যাই হোক, ধর্মশালাকে ঘিরে সমস্ত মন্দির প্রাঙ্গণ পূজাসামগ্রী ও অন্যান্য দোকানপত্তরে ঘেরা। এই জায়গা থেকে আরও উচ্চস্থানে দেবীর গুহামন্দির। মন্দিরে ওঠার সিঁড়ির মুখে তোরণ। একটি বিশাল শৃঙ্গ এখানে দেওয়ালের মতো খাড়া। তারই এক চতুর্থাংশ উচ্চতায় দেবীর মন্দির। সেই পর্বতগাত্রে অসংখ্য গুহা। সেই গুহায় পেচক ও অন্যান্য নিশাচর পক্ষীদের বাস। এখানে মায়ের মন্দির পর্যন্ত লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে। পেশোয়ার সর্দার খাণ্ডেরাও দাবাড়ের স্ত্রী উমাবাঈ দাবাড়ে ৪৭২টি ধাপযুক্ত এই সিঁড়ি ১৭১০ সালে তৈরি করে দিয়েছিলেন।
আমি দর্শনের জন্য শুদ্ধবস্ত্রে পূজার ডালি নিয়ে সিঁড়িভাঙা শুরু করলাম। খানিক ওঠার পর ‘রাম কা টপ্পা’ পড়ল। কথিত আছে, রামচন্দ্র বনবাস কালে লক্ষ্মণ ও সীতা সহ সপ্তশৃঙ্গী দর্শনে এসে এখানে বিশ্রাম করেছিলেন। ‘রাম কা টপ্পা’ পেরিয়ে যখন মূল মন্দিরে গেলাম তখনই দর্শন মিলল সপ্তশৃঙ্গী দেবীর। একটি ১৮ ফুট গুহাকে কেন্দ্র করে এই মন্দির। মন্দিরের ভেতর ৮ ফুট উঁচু দেবীর মূর্তি। রণসজ্জায় সজ্জিতা দেবী বামদিকে ঘাড় কাত করে আছেন। শান্ত সিঁদুর রঞ্জিত মূর্তি তাঁর। রক্তবর্ণ চোখ। আঠারোভুজা দেবী। তাঁর দক্ষিণ হস্তে মণিমালা, পদ্ম, বাণ, তরবারি, বজ্র, চক্র, ত্রিশূল ও কুড়ুল। বাম হস্তে শঙ্খ, ঘণ্টা, পাশা, গদা, দণ্ড, ঢাল, ধনুক, পানপাত্র ও কমণ্ডলু।
ভাগ্যক্রমে আমি গিয়ে পড়েছিলাম দেবীর অভিষেক মুহূর্তে। এখানকার পাণ্ডারা খুব ভালো। বিশেষ করে বাঙালি যাত্রী দেখে খুব খুশি। নাটমন্দিরে তখন অনক যাত্রী বসে আছেন। পাণ্ডারা আমাকে সকলের সামনের সারিতে বসিয়ে দিলেন।
অভিষেক পর্ব আরম্ভ হল। দীর্ঘ এক ঘণ্টা ধরে চলল সেই অভিষেক পর্ব। প্রথমে জল দিয়ে দেবীর মুখ প্রক্ষালন। তারপর দুধে স্নান। এবার দেবীর সর্বাঙ্গে দধি মর্দন করে রাশি রাশি ঘি, মধু, এবং চিনি লেপন করা হল। তারপর ঘড়া ঘড়া জলে দেবীর স্নান। এরও পরে দুটি বালতিতে মেটেসিঁদুর গুলে দেবীর সর্বাঙ্গে মাখাতে লাগলেন পাণ্ডারা। পরে কাজল দিয়ে চোখ এঁকে চক্ষুদান করানো হল। সব শেষে বস্ত্র পরিধান।
এবার মন্ত্রধ্বনি সহকারে শুরু হল আরতি। আরতির পর পুজোপাঠ ও প্রসাদ বিতরণ।
এবার সপ্তশৃঙ্গী দেবীর একটু পরিচয় দেওয়া যাক। ইনিও ৫২ পীঠের অন্তর্গত এক দেবী। তবে সতীদেহের কোন অংশটি এখানে পড়েছিল তা সঠিকভাবে কেউ বলতে পারলেন না। দেবী ভাগবতে আছে সপ্তশৃঙ্গী মহারাষ্ট্রের সাড়ে তিন পীঠের এক দেবী। সপ্তশৃঙ্গী সাড়ে তিন পীঠের অর্ধপীঠ। ইনিও ত্রিগুণাত্মিকা দেবী।
এই অঞ্চলে সহ্যাদ্রি শিখরে সাতটি শৃঙ্গ। এগুলি ভীষণাকৃতি ও অসম সদৃশ। তার কারণ হনুমান যখন গন্ধমাদনকে বয়ে নিয়ে যান তখন সেই পাহাড়ের বিশাল বিশাল অংশগুলির এক একটি অংশ সহ্যাদ্রি পর্বতের সাতটি স্থানে পড়ে। তাই এই পাহাড়ের সাতটি শৃঙ্গ। এই সাতটি শিখরে সাত দেবী আছেন। তাঁদের বলা হয় সপ্ত দুর্গা। যেমন— ইন্দ্রাণী, কার্তিকেয়ী, বারাহী, বৈষ্ণবী, শিবা, চামুণ্ডী ও ন্যায়সিংহী। এই সাত দেবীর অনুরোধে সপ্তশৃঙ্গী এই পর্বতের সর্বোচ্চ শিখরে বিরাজ করছেন।
মার্কণ্ডেয় মুনি এই পর্বতেই তপস্যা করতেন। তিনিই স্বপ্নাদেশে দেবীকে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। সপ্তশৃঙ্গী হলেন দেবী চণ্ডিকার অন্য রূপ। মহিষাসুর বধের সংবাদ পেয়ে ভীমাসুর পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে এখানে প্রচণ্ড উপদ্রব শুরু করলে দেবী আঠারোভুজা হয়ে এখানেই তাকে বধ করেন।
কালক্রমে মার্কণ্ডেয় মুনির স্থাপনা করা এই মূর্তিটি জঙ্গলের গভীরে ঢাকা পড়ে যায়। বহুকাল পরে একবার এক মেষপালক মেষ চরাতে এসে এই পাহাড়ের বিশাল গুহায় একটি মৌচাক দেখে লুব্ধ হয়। একদিন গোপনে একাকী সেটি ভাঙতে এসেই চক্ষুস্থির। দেখল মৌচাক থেকে মধুর বদলে গল গল করে গোলা সিঁদুর বেরিয়ে আসছে। তাই দেখে সে ভয়ে পালিয়ে এসে গ্রামে খবর দেয়। মেষপালকের কথা শুনে গ্রামবাসীরা এসে মৌমাছি সরিয়ে চাক ভাঙতেই বেরিয়ে পড়ল দেবীর মূর্তি। গ্রামবাসীরা সবাই জানতেন সপ্তশৃঙ্গীর কথা। কিন্তু দেবী ঠিক কোনখানে অবস্থান করছেন তা কেউ জানতেন না। এবার মূর্তি আবিষ্কারের পর থেকেই শুরু হল নিয়ম করে সপ্তশৃঙ্গী দেবীর পূজার্চনা। এখন আমরা দলে দলে সেই দেবীকে দর্শন করে ধন্য হচ্ছি।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল