শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
আবার মৃত্যু, কবি-জীবন থেকে ঝরে যাবে আরও একটি ফুল। কবির জ্যেষ্ঠা কন্যা মাধুরীলতা। ডাকনাম বেলা। কবির বেল ফুল-প্রীতির কথা পরিবারের সবাই জানতেন। সেই ভালোবাসার কথা মাথায় রেখেই কবির মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবী সদ্যোজাত কন্যার নাম রাখলেন বেলা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এই কন্যাকে নানা নামে ডাকতেন, কখনও বেলা, কখনও বেল, কখনও বেলি, কখনও বা বেলুবুড়ি। অসাধারণ সুন্দরী এই কন্যাকে ঠাকুর পরিবারের সকলেই খুব ভালোবাসতেন। লেখার হাতটিও ছিল ভারি চমৎকার।
১৯০১ সালে নিজের কন্যা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে লিখলেন, ‘কাল সমস্তক্ষণ বেলার শৈশবস্মৃতি আমার মনে পড়ছিল। তাকে কত যত্নে আমি নিজের হাতে মানুষ করেছিলুম। তখন সে তাকিয়াগুলোর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে কি রকম দৌরাত্ম্য করত। সমবয়সী ছোট ছেলে পেলেই কি রকম হুংকার দিয়ে তার উপর গিয়ে পড়ত, কি রকম লোভী অথচ ভালোমানুষ ছিল— আমি ওকে নিজে পার্কস্ট্রীটের বাড়িতে স্নান করিয়ে দিতুম। দারজিলিঙে রাত্রে উঠিয়ে উঠিয়ে দুধ গরম করে খাওয়াতুম।’
দিদিকে যে বাবা তাদের থেকে একটু বেশি স্নেহ করেন তা কবির অন্যান্য পুত্রকন্যারাও বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারতেন এবং তা নিয়ে তাদের মধ্যে কোনও ক্ষোভ বা বেদনা ছিল না। পরবর্তীকালে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’ গ্রন্থে লিখছেন, ‘ আর-সব ছেলেমেয়েদের চেয়ে বাবা দিদিকে বেশি ভালোবাসতেন। আমরা সেটা খুবই জানতুম, কিন্তু তার জন্য কোনোদিন ঈর্ষা বোধ করিনি, কেন না আমরাও সকলে দিদিকে অত্যন্ত ভালোবাসতুম এবং মানতুম। দিদির বুদ্ধি যে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি তা মানতে আমাদের লজ্জাবোধ হত না। তিনি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন ছেলেবেলা থেকেই। সেইজন্য বাড়ির সকলের কাছ থেকে প্রচুর আদর পেতেন, সকলের প্রিয় ছিলেন। শিলাইদহে আমাদের যখন পড়াশুনা আরম্ভ হল, দিদি আমাদের ছাড়িয়ে অনেক এগিয়ে যেতে লাগলেন। বাবা তাঁকে নিজে পৃথক করে পড়াতে শুরু করলেন। তখন থেকেই বুঝেছিলেন দিদির লেখবার বেশ ক্ষমতা আছে। বাবা তাঁকে উৎসাহ দেওয়াতে তিনি কয়েকটা গল্পও লিখেছিলেন।’
মাধবীলতার অন্যতম লেখাগুলি হল— ‘সুরো’, ‘মামা ভাগ্নী’, ‘সৎপাত্র’, ‘দ্বীপনিবাস’, ‘অনাদৃতা’, ‘চোর’,‘ চামরুর গল্প’, ‘মাধুরীলতার গল্প’। তাঁর লেখা সবুজপত্র ছাড়াও ভারতী ও বঙ্গদর্শন (নবপর্যায়) পত্রিকাতেও প্রকাশিত হতো। ১৩২২ সালে সবুজপত্রের শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হল তাঁর ‘অনাদৃতা’ গল্পটি—‘দুইটি কন্যা ও তিনটি পুত্রের ভার স্বামীর হাতে সঁপিয়া দিয়া হরমণি যখন চির অবসর গ্রহণ করিল, নীলু বড় ফাঁপড়ে পড়িয়া গেল। সে বেচারা ছাপাখানায় কাজ করিত, বেতন যাহা পাইত মাসে মাসে স্ত্রীর হাতে দিয়া নিশ্চিন্ত থাকিত, সামান্য ২০ টাকায় কি করিয়া এতগুলি প্রাণীর ভরণপোষণ সম্ভব তাহা তাহাকে একদিনও ভাবিতে হয় নাই । প্রত্যহ নিয়মিত ৯ । ১০ টার সময় সে ডাক দিত, “বড় বৌ, ভাত বাড়, আমি নাইতে যাচ্ছি ।” স্নান সারিয়া যেখানে হর পাখা হাতে ভাত আগলাইয়া মাছি তাড়াইতেছে সেখানে বসিয়া গিয়া সপাসপ্ নাকে মুখে ভাত গুঁজিয়া পানটি হাতে লইয়া আপিসের দিকে চলিয়া যাইত । নীলুর খাওয়ার কোন কষ্ট ছিল না, মাছটি তরকারীটি যে সময়কার যা পাওয়া যাইত, নীলুর পাতে পড়িতই পড়িত, পরিবারের সকলেই তাহার মত রাজভোগে আছে সে বিষয়ে তাহার কোন সন্দেহ ছিল না এবং মধ্যে মধ্যে স্ত্রীলোকের যে আহার সম্বন্ধে অতিরিক্ত লোভ আছে এবং সেটা যে অত্যন্ত নিন্দনীয় সে কথা চাণক্যের শ্লোক মিশাইয়া স্ত্রীকে বুঝাইয়া দিত.......’।
তবে লেখার ব্যাপারে মাধুরীলতা দেবীর খুব একটা উৎসাহ ছিল না। আর এই কারণে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট দুঃখ পেতেন। তাই প্রশান্ত মহলানবীশকে একটি চিঠিতে মাধুরীলতার রচনাশক্তি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন –‘ওর ক্ষমতা ছিল... কিন্তু লিখত না।’
কবির বড় আদরের এই প্রাণের কন্যা মাধুরীলতার সঙ্গে বিবাহ হল নতুন বৌঠানের প্রিয় কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর পুত্র মজফফরপুরের উকিল শরৎচন্দ্র চক্রবর্তীর।
মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়িতে রেখে শান্তিনিকেতনে ফিরে রবীন্দ্রনাথ স্ত্রীকে একটি পত্রে লিখলেন, ‘ভাই ছুটি, বেলাকে রেখে এলুম। তোমরা দূরে থেকে যতটা কল্পনা করছ ততটা নয়— বেলা সেখানে বেশ প্রসন্ন মনেই আছে— নতুন জীবনযাত্রা তার যে বেশ ভালোই লাগছে তার আর সন্দেহ নেই। এখন আমরা তার পক্ষে আর প্রয়োজনীয় নই। আমি ভেবে দেখলুম, বিবাহের পরে অন্তত কিছুকাল বাপমায়ের সংসর্গ থেকে দূরে থেকে সম্পূর্ণভাবে স্বামীর সঙ্গে মিলিত হবার অবাধ অবসর মেয়েদের দরকার। বাপ মা এই মিলনের মাঝখানে থাকলে তার ব্যাঘাত ঘটে।’
বিয়ের পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর বড় জামাইকে ব্যারিস্টারি পড়তে বিলেতে পাঠালেন। বিলেত থেকে ফিরে আসার পর তাঁরা উঠেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতেই। তবে এই সুখ মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হল না। শরৎচন্দ্রের সঙ্গে খটামটি শুরু হল তাঁর ছোট ভায়রাভাই নগেন্দ্রনাথের।
রবীন্দ্রনাথের এই অকর্মণ্য ছোট জামাইটির আচার আচরণ মোটেই সুবিধার ছিল না। তিনি ছিলেন উদ্ধত ও অহংকারী প্রকৃতির মানুষ। শুধু শরৎচন্দ্র নন, তাঁর ব্যবহারে কবি-বন্ধুরাও বারেবারে ব্যথা পেয়েছেন।
তবে এই অশান্তির বীজ কবি নিজের হাতেই বপন করেছিলেন তাঁর পরিবারের ভূমিতে। আবার বিদেশে যাবেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি যাত্রার পূর্বে জমিদারি, আদি ব্রাহ্মসমাজ, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ও জোড়াসাঁকো বাড়ির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়ে যান ছোটজামাই নগেন্দ্রনাথের হাতে। শরৎচন্দ্র মুখে কিছু না বললেও শ্বশুরমশাইয়ের এহেন ব্যবহারে মনে হয়তো বড়ই আঘাত পেয়েছিলেন।
সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল একদিন, ভয়ঙ্কর ভাবে। সকালের খবরের কাগজ কোন জামাতার ঘরে আগে দেওয়া হবে তাই নিয়েই শুরু হল মনোমালিন্য। ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর হাত ধরে পথে নামলেন। জোঁড়াসাঁকোর বাড়ি ছেড়ে তাঁরা গিয়ে উঠলেন ২৭/১ ডিহি শ্রীরামপুরের ভাড়া বাড়িতে।
সামান্য কাগজ নিয়ে এতবড় অশান্তি? পরবর্তী কালে কেউ কেউ হেমলতা দেবীর জবানিতে জানিয়েছেন, নগেন্দ্রনাথ খরচ কমানোর নামে ভায়রাভাই শরৎকুমারের জন্য নির্দিষ্ট স্টেটসম্যান কাগজ বন্ধ করে দেন। সংবাদপত্রের অনুরক্ত পাঠক শরৎকুমার এতে যার-পর নাই অপমানিত বোধ করেন। তারপর কলহের সংক্রমণ।
এই বিবাদ সৃষ্টি করল এক বিশ্রী পরিস্থিতির। দুই বোনের মধ্যে কথা বলা এবং মুখ দেখাদেখি ও বন্ধ হয়ে গেল। তাতেও বিন্দুমাত্র দমলেন না উদ্ধত, ক্ষমতালোভী, অহংকারী নগেন্দ্রনাথ। আর বেলা! তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিলেন পিতার বৃহৎ বৃত্ত থেকে। (ক্রমশ)
ছবিতে রথীন্দ্রনাথ, মাধুরীলতা, মীরা ও রেণুকা।
অলংকরণ: চন্দন পাল