শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পুত্র, ব্রাহ্ম নেতা,আচার্য, দানবীর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের শেষ উইলটি এবার করবেন। তাঁর মন আজকে বড়ই শান্ত, কাকে কী দেবেন তা পূর্ব রাত্রেই ঠিক করে ফেলেছেন। মনে আর কোনও দ্বিধা বা সংশয় নেই। কারণ তিনিও যে তার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। মৃত্যুর পায়ের শব্দ— দিন ফুরিয়ে এল, এবার ফেরার পালা! তাই তিনি আজ বড়ই ব্যস্ত। সমস্ত কর্ম শেষ করতে হবে খুব শীঘ্রই। হাতে আছে আর মাত্র কয়েকটা বছর। তারপরই শেষ হবে এপারের সমস্ত খেলা।
সাল ১৮৯৯, ৮ সেপ্টেম্বর। উইল করলেন মহর্ষি। ওড়িশার সম্পত্তি পেলেন তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ। দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ— তিনজনে মিলে পেলেন নদীয়ার বিরাহিমপুর ও রাজশাহীর কালীগ্রাম। কনিষ্ঠভ্রাতা নগেন্দ্রনাথের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী দেবীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে এক হাজার টাকা। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিঃসন্তান, তাই মাসিক বারোশো পঞ্চাশ টাকা তাঁর জন্য ধার্য হল। সব মিলিয়ে ঠাকুর পরিবারের তহবিল থেকে এর জন্য খরচ নির্ধারিত হয়েছিল বাহান্ন হাজার চারশো টাকা।
সাল ১৯০৫। ঠাকুর পরিবারে আবার এক আঘাত নেমে এল। পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর সেই মৃত্যুর হাত ধরেই পরিবারে প্রবেশ করল বিচ্ছেদ-বেদনা। জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের বিখ্যাত সন্তানরা ছড়িয়ে পড়লেন নানা দিকে। পিতার উইল অনুসারে জমিদারির মালিক হলেন তিনজন— দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর উইল অনুসারে মাসে পেতেন মাত্র বারোশো পঞ্চাশ টাকা।
পিতার মৃত্যুর ঠিক তিন বছর বাদে ১৯০৮ সালে স্বেচ্ছা নির্বাসনকেই বরণ করে নিলেন ঠাকুর পরিবারের অন্যতম আর এক কৃতী, সুদর্শন সন্তান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি একদিনে ছিঁড়ে ফেললেন সমস্ত মায়ার বন্ধন! কেন এই অহেতুক অভিমান! তিনিও কী তাঁর বারো বছরের ছোট প্রাণাধিক প্রিয় ভাইকে নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী বলে মনে করতেন! না! এ ব্যাপারে দুপক্ষের কেউই কিছু লিখে রেখে যাননি। ফলে পুরোটাই রয়ে গেল অন্ধকারে, কালের খাতায় চিরতরে বন্দি হয়ে!
বারোশো পঞ্চাশ টাকা— এই সামান্য অর্থ সম্বল করে পিতার মৃত্যুর তিনবছর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ জোড়াসাঁকো থেকে চিরবিদায় নিলেন। তিনি চলে গেলেন রাঁচিতে। মোরাবাদী পাহাড়ে নবনির্মিত শান্তিধামেই তিনি কাটাবেন তাঁর জীবনের বাকি দিনগুলি।
ভেঙে গেল হাট! কলকোলাহল মুখর জোড়াসাঁকোর সেই বিখ্যাত বাড়ি থেকে একে একে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়লেন পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা। রবীন্দ্রনাথ গেলেন জমিদারি পরিদর্শনে। কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে অনুসরণ করলেন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দ্বিজেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথ নতুন বাড়ি তৈরি করে জোড়াসাঁকো থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইতিমধ্যে মারা গিয়েছেন মহর্ষির তৃতীয় পুত্র হেমেন্দ্রনাথ। চতুর্থ ও সপ্তম পুত্র বীরেন্দ্রনাথ ও সোমেন্দ্রনাথ আক্রান্ত হলেন মানসিক ব্যাধিতে।
শিলাইদহ থেকে রবীন্দ্রনাথ চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। ১৯০৮ সাল, সেই শেষবার। তারপর আর দুজনের কখনও দেখা হয়নি। কবির অত্যন্ত প্রিয় জ্যোতিদাদাও কখনও শান্তিনিকেতনে যাওয়ার কথা ভাবেননি এবং রবীন্দ্রনাথও চেষ্টা করেননি কখনও রাঁচিতে যাওয়ার। দুই ভাই নিজেদের মধ্যে কী কারণে কেন যে এক অদৃশ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন তা আমরা আজও জানি না।
ছোটভাই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিশ্চুপ হয়ে বসেছিলেন, ভাইকে চিঠি লিখে অভিনন্দন পর্যন্ত জানাননি। অথচ একসময় এই বারো বছরের ছোটভাইকে তিনি কত না প্রশ্রয় দিয়েছেন। সরোজিনী নাটকের প্রুফ পড়া হচ্ছে। ঘরে আছেন কিশোর রবীন্দ্রনাথ। তিনি তখন তাঁর নতুন দাদার ছায়াসঙ্গী। সরোজিনী পুরোটা শোনার পর রবীন্দ্রনাথ নতুনদাদাকে বললেন, উপসংহারে একটা গান থাকলে ভালো হতো। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ সম্মতি জানিয়ে পিয়ানোতে বসে সুর তুললেন, আর রবীন্দ্রনাথ সেই সুরে বসালেন বাণী—‘জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ, পরান সঁপিবে বিধবাবালা।’ কনিষ্ঠ ভ্রাতার পারদর্শিতায় মুগ্ধ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ সরোজিনী প্রকাশের পর হইতেই আমরা রবিকে প্রমোশন দিয়া আমাদের সমশ্রেণীতে উঠাইয়া লইলাম। এখন হইতে সংগীত ও সাহিত্য চর্চাতে আমরা হইলাম তিনজন— অক্ষয় চৌধুরী, রবি ও আমি।’
সেই অসম্ভব মধুর দিনগুলির কথা বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরবর্তীকালে বলেছিলেন, ‘এইবার ছুটল আমার গানের ফোয়ারা। জ্যোতিদাদা পিয়ানোর ওপর হাত চালিয়ে নতুন নতুন ভঙ্গীতে ঝমাঝম সুর তৈরি করে যেতেন, আমাকে রাখতেন পাশে। তখনি তখনি ছুটে চলা সুরে কথা বসিয়ে বেঁধে রাখবার কাজ ছিল আমার।’
কোথায় হারিয়ে গেল সেইসব সুখের দিন। দুই ভাই সরে গেলেন দুদিকে দুপ্রান্তে। তবে শেষ বেলায়, ১৯২৫ সালে ছোটভাইকে শেষ বারের মতো দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। তিনি একবার রাঁচিতে আসবার জন্য ভাইকে চিঠিও লেখেন। খুব সম্ভবত সেই চিঠি রবীন্দ্রনাথের হাতে পৌঁছয়নি। ফলে এই পৃথিবীর বুকে আর কোনওদিন দেখা হয়নি দুই ভাইয়ের।
অত্যন্ত প্রিয় নতুন দাদার মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ বারে বারে প্ল্যানচেটে তাঁকে ডেকেছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথও এসেছেন, নানা উপদেশ দিয়েছেন প্রিয় ভাইকে।
সাল ১৯২৯। চার বছর আগে রাঁচির শান্তিধামে মারা গেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। চার বছর পরে নতুন দাদা দ্বিতীয়বার এলেন ভাইয়ের আহ্বানে, মিডিয়ামের মাধ্যমে।
রবীন্দ্রনাথ জানতে চাইলেন— ‘কে?
— পাঠিয়ে দিলেন তোমার নতুন বৌঠান।
জ্যোতিদাদা। সেদিন আপনার কথা শুনে আমার খুব উপকার হয়েছে— মনকে শান্ত করতে পেরেছি।
— তুমি পারবে আমি জানি।
মৃত্যুর পরমুহূর্তে পরলোকের সঙ্গে সম্বন্ধ কী উপায়ে হয়?
— সে একটা আছন্ন ভাবের ভিতর দিয়ে আসি। ঠিক যেন ঘুম থেকে জাগি। সমস্ত জীবনটাই গত রাত্রের স্বপ্ন বলে মনে হয়।
আমাকে এইমাত্র শমী বলল, একটা পৃথিবী তৈরি করেছে। খুব মজা লাগছে তার। সেটা কী?
— করেছে বটে, কিন্তু ও বলতে নিষেধ করেছে।
আমাকে বলেছে ‘শমীর পৃথিবী’ বলে কিছু একটা রচনা করতে।
— বেশ তো, লিখে দাও না। ওর মনে সত্যই অনেক কিছু খেলছে। ও যেন নতুন আলোক দেখতে পেয়েছে। আমাদের বুড়ো চোখে তা ধরা পড়ে না।...’
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দুবার এসেছিলেন ভাইয়ের পরলোক চর্চার আসরে। প্রথমবার আসেন ৫ নভেম্বর, দ্বিতীয়বার ২৮ নভেম্বর।
ছবিতে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাদম্বরী দেবী ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর।
(ক্রমশ)