শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন। কর্মক্ষেত্রে উন্নতির সম্ভাবনা। গুপ্তশত্রুতার মোকাবিলায় সতর্কতা প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষায় বিলম্বিত সাফল্য।প্রতিকার: ... বিশদ
আমি সঙ্গে সঙ্গে একটি শেয়ারের অটো নিয়ে ভবানী মণ্ডপে চলে এলাম। এখানে এসে খোঁজখবর নিয়ে মন্দিরের পূর্ব-দরজা পার হয়ে অতীব সুন্দর ‘শ্রীলছমি কৃপা’ লজে পৌঁছলাম। তখন একটি সিঙ্গেল বেডরুমের ঘরের ভাড়া ছিল মাত্র পনেরো টাকা।
যাইহোক, লজে মালপত্তর রেখে ফ্রেশ হয়ে যাঁর পদপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি প্রথমেই সেই মহালক্ষ্মীকে দর্শন করলাম। তারপর এদিক সেদিক ঘুরে আবার চলে এলাম মন্দির এলাকায়। সেখানে রাতের খাওয়া সেরে পূর্ণ বিশ্রাম।
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে চা-পর্ব সেরে চলে এলাম কোলহাপুরের সুসজ্জিত জনপদের ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুরী পর্বতের কোলে পঞ্চগঙ্গার তীরে। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অতি মনোরম। ব্রহ্মপুরী অবশ্য টিলাকৃতি পর্বত। এখানে ব্রাহ্মণদের শেষকৃত্য হয়। পদ্মপুরাণে করবীর মাহাত্ম্যে আছে মহালক্ষ্মীর মহাস্থানে নারায়ণ করবীর রক্ষার্থে সতত বিরাজমান। পবিত্র পঞ্চগঙ্গা এই ক্ষেত্রকে দুই দিকে বেড় দিয়ে আছে। এর আট দিকে আট শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠিত। আর পূর্ব দিকে আছেন ঔজ্জ্বল্য দেবী, পশ্চিমে সিদ্ধবটুকেশ মহাদেব, দক্ষিণে কাত্যায়নী ও উত্তরে রত্নেশ্বর। এই পঞ্চগঙ্গা দর্শনমাত্রেই মোক্ষলাভ। কাশ্যপমুনি এই পঞ্চগঙ্গার তীরে সহস্রবর্ষ তপস্যা করেন। মার্কণ্ডেয় মুনির তপোপ্রভাবে দেবাদিদেব মহাদেব এই পঞ্চগঙ্গায় পবিত্র জলরূপে প্রবহমান। এখানে পাষাণরূপে রয়েছেন ভগবান বিষ্ণু, বৃক্ষরূপে সমস্ত দেবতা এবং বালুকারূপে মুনিগণ। এখানকার কোটিতীর্থের কুণ্ড স্নানে জীবের জন্মান্তর রহিত হয়। আমি পঞ্চগঙ্গা স্নানের জন্য তৈরি হয়ে এসেছিলাম। তাই স্নান করে মন্দিরে গেলাম পুজো দিতে।
এখানকার মন্দিরে ভোর চারটে থেকেই পূজাপাঠ ও ভক্তসমাগম শুরু হয়ে যায়। এরপর সারাটা দিন ধরে দলে দলে তীর্থযাত্রীরা আসেন এখানে।
যাইহোক, আমি দু’চোখ ভরে মহালক্ষ্মীর মহারূপ দেখে ধন্য হলাম। মহালক্ষ্মী হলেন দেবী দুর্গা। মহিষাসুর বধের পূর্বে দেবী যে যে রূপ ধারণ করেন তার মধ্যে মহালক্ষ্মী একটি। এখানে পাণ্ডার কোনও উপদ্রব নেই। মন্দিরের পূজারীরাই সব। তাঁদেরই একজনের মুখে শুনলাম এখানকার মহালক্ষ্মী নাকি সম্পর্কে তিরুপতি বালাজির বোন। তাই প্রতি বছর বালাজির উৎসবের সময় একটি করে বেনারসি ও চোলি দেবীর জন্য নিয়ে আসেন বালাজির পূজারীরা। কোলহাপুরের মহালক্ষ্মী এক অতি প্রাচীন শক্তিপীঠ। এর উল্লেখ কাশীখণ্ড, পদ্মপুরাণ, দেবী ভাগবত, হরিবংশ পুরাণ, স্কন্দপুরাণ সবেতেই আছে। কাশীখণ্ডে একে দক্ষিণকাশী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। করবীর মাহাত্ম্যে আছে, ‘বারাণস্যাধিকং ক্ষেত্রং করবীরপুরং মহৎ।’
দেবীর কৃপায় বিভিন্ন সময়ে রাজন্যবর্গের দানে মহালক্ষ্মীর ভাণ্ডার আজ কুবেরের ভাণ্ডারে পরিণত। ১২৪০ শকে যাদব রাজারা মহালক্ষ্মীর পুজো দিতে এসে প্রচুর ধনরত্ন দান করেন। রাজা ভোজদেব ১১১২ শকে এই মন্দিরে উমামহেশ্বর সহ পঞ্চোপচারে পূজা করেন ও প্রচুর ব্রাহ্মণাদি ভোজন করান। পরে দেবীর জীর্ণদ্বার সংস্কার করে দেন তিনি। চালুক্যরাজ ত্রিভুবনমল্ল ১২২৮ শকে তাঁর পত্নী লঘুমা দেবীকে নিয়ে মহালক্ষ্মী দর্শনে আসেন এবং ৪ একর জমি প্রদান করেন। শালিবাহন শকে চালুক্য রাজবংশের কর্ণদেব কোঙ্কণের মলুকগিরি যাওয়ার পথে এখানে আসেন এবং দীর্ঘদিন এখানে অবস্থান করেন। কর্ণদেব মহালক্ষ্মীর মন্দির সংলগ্ন বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মন্দির এখানে নির্মাণ করিয়ে দেন। ১২১২ সালে তৈলম নামে এক যাদব রাজা এই মন্দিরের মহাদ্বার নির্মাণ করিয়ে প্রচুর ধনরত্ন দান করেন এবং ইনি মহালক্ষ্মীর প্রাচীন মূর্তিটির বজ্রলেপ করান। ফলে মূর্তিটি বিশেষ স্পষ্টতা লাভ করে। রত্নগিরি দুর্গ দখলের পর ১৭১২ সালের ২১ নভেম্বর শিবাজী দেবীর মন্দির চূড়ায় একটি সোনার কলস বসিয়ে দেন। ১৫১০-১১ শকে শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুও এখানে মহালক্ষ্মী দর্শনে আসেন।
কোলহাপুর নিবাসীদের কাছে মহালক্ষ্মী অপরিহার্য। মহালক্ষ্মীর বিশাল মন্দির প্রাঙ্গণ সবিস্ময়ে দেখার মতো। অনেকটা আয়ুন্ধ নাগনাথের মতো। অনেকগুলি ছোট-বড় স্তম্ভের উপর নির্ভর করে এই মন্দির স্থাপন করা হয়েছে। স্তম্ভগুলি এমনভাবে সাজানো যে গুনতে গেলে খেই হারিয়ে যায়। এই সুবিশাল মন্দিরে উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমে বিশাল তোরণ। দেবী এখানে দক্ষিণমুখী। দক্ষিণ তোরণে বহুদূর থেকে লক্ষাধিক লোকের ভিড়েও দেবীদর্শন হয়।
কথিত আছে, এই মহালক্ষ্মীর মন্দির শ্রীবিষ্ণু জয় ও বিজয় নামে দুই কারিগরকে দিয়ে এক রাতের মধ্যে নির্মাণ করান। পরে জয়-বিজয় পাথর হয়ে মন্দিরের অভ্যন্তরে দ্বারীরূপে বিরাজ করতে থাকেন। ছয় ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট জয়-বিজয়ের মূর্তি দেখবার মতো। কিংবদন্তি অনুসারে, স্বয়ং নারায়ণ এই মন্দিরকে সবসময় পাহারা দিচ্ছেন এবং সে জন্যই নাকি আরঙ্গজেবের রোষবহ্নিও এই মন্দিরকে স্পর্শ করতে পারেনি। তবুও কপিল তীর্থের এক পূজারী মুঘল আক্রমণের সময়ে এখানকার কোটি তীর্থের জলে লুকিয়ে রেখেছিলেন মহালক্ষ্মীকে। তবে তার আগেই দেবী মহিমায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে মুঘল বাহিনী স্থানত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
কোলহাপুরের মহালক্ষ্মীকে দর্শনের পর আমার যেন আবার নতুন করে ভাগ্যোদ্বয় হল।
(ক্রমশ)