পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
তখনও বইমেলা ছিল ময়দানে। দুপুর পেরলেই দল বেঁধে ঢুকে পড়তেন পাঠককূল। শুধু কলকাতা নয়, মফস্বল থেকে ট্রেনে-বাসে চড়ে আসতেন বইপ্রেমিকের দল। বই দেখছেন, গন্ধ নিচ্ছেন নতুন বইয়ের। পকেটের রেস্ত বুঝে কিনছেন একের পর এক বই। চারপাশে স্টল, মাঝে প্রশস্ত অঙ্গন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে মাঠেই বসে পড়ছেন কেউ কেউ। ঝোলা থেকে টিফিনবাক্স বার করে খেয়ে নিচ্ছেন রুটি-তরকারি। কোনও পাঠক নিবিষ্ট হয়ে পড়ছেন সদ্য কেনা বইয়ের পাতায়। খেতে খেতেই পাশে বসা পাঠকের বইতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন অতি উৎসাহী কেউ। কেউ আবার বুকপকেটে রাখা লিস্ট মিলিয়ে দেখছেন, কোন বইগুলি এখনও কেনা বাকি। সবাই মশগুল বইয়ের অনন্ত ভুবনে।
বইমেলাজুড়ে জন্ম হয় টুকরো টুকরো দৃশ্যের। দ্রুতলয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক পাঠক। কোনও স্টলে অকাতরে নিজের বইতে সই করছেন খ্যাতনামা লেখক। সঙ্গে হাসিমুখে মেটাচ্ছেন ছবিস সেলফির আবদার। চিলড্রেন বুক ট্রাস্টের বিশাল প্যাভিলিয়নে কচিকাঁচাদের ভিড়। হাজার হাজার বইপ্রেমীর পদচারণায় তৈরি হচ্ছে ধুলোর বলয়। কানে ফোন নিয়ে ছোটাছুটি করছেন এক স্টল থেকে অন্য স্টলে। জমে উঠছে উৎসব। এই দিনক’টা আসলে পাঠকের। নতুন বই, নতুন কবি, নতুন লেখক, নতুন প্রকাশক—পুস্তক তালিকা...সব মিলিয়ে ব্যস্ততার শেষ নেই। কেউ খুঁজছেন বাচ্চাদের বই। কেউ বা মা-বাবার জন্য। বইমেলার দিনগুলি যে কোথা দিয়ে কেটে যায় ঝড়ের গতিতে!
চা কফি আর তেলেভাজা। ময়দানে প্রথম দিকের বইমেলায় এছাড়া তেমন আর কোনও খাবার পাওয়া যেত না। প্রথম বইমেলা শুরু হয় ভিক্টোরিয়ার পাশের প্রাঙ্গণে। দু’টি মেলা হতো তখন। একটি সরকারি পুস্তক মেলা। অপরটি প্রকাশকদের বইমেলা। পরে দুই মেলা মিলে হল আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। ময়দানে বহু বছর ধরে সেই মেলার উত্তাপে মন সেঁকে নিতেন পাঠকের দল। হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত সব মজা হতো মেলায়... —‘একটা অটোগ্রাফ দেবেন স্যর?’ —‘এই বইটার যিনি লেখক, তিনিই কি আমি!’ গম্ভীরভাবে প্রশ্ন কবির। সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। এগিয়ে এলেন কবিজায়া। —‘এটা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বই ভাই, ওঁর নয়।’
দূর থেকে বিষয়টির উপর নজর রাখছিলেন আরেক প্রখ্যাত কবি। প্রায় দৌড়ে এসে তিনি বইটায় সই করে দিলেন। কবিকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেললেন একমুখ দাড়িওয়ালা যাদবপুরের ফার্স্ট ইয়ার।—‘না বুঝে কার গ্রন্থে তুমি সই করে দিলে!’ বললেন কবিপত্নী।
অনর্গল বইমেলার স্বপ্ন-স্মৃতি-ইতিহাস। ১৯৯৭ সালে বইমেলা চলাকালীন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। পুড়ে ছাই হয়ে যায় লক্ষাধিক বই। মাত্র তিনদিন পরেই আবার নতুন করে শুরু হয় বইমেলা। এ যেন ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম। পরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের আপত্তিতে ময়দান থেকে মেলা সরে আসে সল্টলেক স্টেডিয়ামে। সেখান থেকে সায়েন্স সিটির পাশে, মিলনমেলায়। শেষ পর্যন্ত স্থায়ী জায়গা পেল সল্টলেকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে বইমেলা। বদলেছে পাঠকও । পরিবর্তন অনিবার্য। তবু পুরনো বইমেলার দিনগুলির কিছু মায়া জেগে আছে আজও।
সংগঠিতভাবে মেলা পরিচালনা করে গিল্ড। বইমেলায় আগের থেকে স্টলের সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। বেড়েছে কবি, লেখক, প্রকাশকের সংখ্যা। আর পাঠক—বইমেলা প্রাঙ্গণজুড়ে উপচে পড়া জনসমাগমে হাঁটাই দায়। লটারিতে ভালো জায়গা পান যে সব প্রকাশক, তাঁদের কেউ কেউ নাস্তিক হলেও জোড়া পাঁঠা মানত করে বসেন মা কালীকে! আর যাঁদের স্টল সেভাবে চোখে পড়ছে না, তাঁদের মুখ শুকনো—‘খরচটাও উঠবে না এবার।’
বইমেলার দিনগুলিতে স্টলে স্টলে চলে নতুন বইপ্রকাশের অনুষ্ঠান। স্টলকে পিছনে রেখে লেখক ও প্রকাশকের হাতে বই সহ ছবি। ফেসবুক লাইভ। প্রকাশক একটু বড় হলে সেকাজের জন্য ভাড়া নেন প্রেস কর্নার। অনেক নতুন ভালো প্রকাশক এসেছেন গত দুই দশকে। লাস্ত্রাদা, ৯ঋকাল, তবুও প্রয়াস, মান্দাস, সুপ্রকাশ, গুরুচণ্ডা৯, কেতাবি, ধানসিঁড়ি, বুক ফার্ম, মনচাষা, মনফকিরা। এঁদের বই বেশিরভাগই উঁচু মানের। চমকে দেওয়া অলঙ্করণ। বই হাতে নিলেই ভরে ওঠে প্রাণ। একের পর এক অসাধারণ বই প্রকাশ করে চমকে দিচ্ছিল তালপাতা। হঠাৎ করে যে কেন হারিয়ে গেল!
বইমেলা থাকলে বইচোরও থাকবে। স্টলে ঢুকে বই দেখতে দেখতে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলা তাদের বিশেষ কেরামতি। একবার বমাল ধরা পড়েছে এক বইচোর। প্রকাশককে দেখতে অনেকটা টেনিদার স্রষ্টা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো। রসিক মানুষ। বইচোরকে বসালেন নিজের পাশের চেয়ারে।—‘বসুন ভাই, আরাম করে বসুন। একজন বিখ্যাত বইচোরের নাম বলুন দেখি!’ —‘মার্ক টোয়েন।’—‘আপনি দেখছি সামান্য বইচোর নন! ওরে কে আছিস, এই মহান পুস্তকদস্যুকে একুশ কাপ কফি খাওয়া।’—‘সেরেছে! বইমেলাতেও একুশে আইন! ঘাবড়ে গিয়েছেন বইচোর।—‘অন্তত তিনকাপ তো খান। আর যে বইটি ঝোলায় ঢুকেছে, তার সঙ্গে আরও দু’টি বই ফ্রি!’ অন্য এক প্রকাশক অবশ্য ততটা সদয় ছিলেন না। তিনি একবার বইচোরকে ধরার পর ময়দান থেকে নাপিত ডেকে এনেছিলেন। তারপর একদিকের গোঁফ আর একদিকের জুলফি কামিয়ে বই সহ ছেড়ে দেন চোরকে! সেইসব দিন না থাকলেও সল্টলেকের বইমেলা এখন জমে রাবড়ি। বিমলকৃষ্ণ মতিলাল স্মারক বক্তৃতা দিচ্ছেন প্রখ্যাত দার্শনিক। উদ্বোধন হচ্ছে অসংখ্য নতুন লেখকের নতুন বইয়ের। নামী লেখকরা স্টলে স্টলে সই করছেন নিজেদের বইতে। বড় স্টলগুলির বাইরে সর্পিল লাইন। এত লক্ষ লক্ষ পুস্তকপ্রেমীর ভিড় বাংলাদেশের একুশের বইমেলা বাদে আর কোথায় হয়?
ভিড়ের ভেতর থেকে নিঃশব্দে সটকে পড়ছে জোড়ায় জোড়ায় যুবক যুবতী। খাবারের স্টলেও প্রবল ভিড়। এদিক ওদিক সুন্দরীদের দেখতে দেখতে পুরুষদের বুক ধড়ফড়। সইশিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন এক নামজাদা কবি। দু’ব্যাগ ভর্তি বই কিনেছেন এক প্রৌঢ় শিক্ষক। সেন্ট্রাল পার্কের লেক লাগোয়া আঁকাবাঁকা পথে বসে শিল্পীরা। তাঁদের থেকে ছবি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। গিটার বাজিয়ে গান গাইছে একদল ছাত্র—‘হিংসা নয় দ্বন্দ্ব নয়, ফুল ফোটাও গন্ধ দাও...।’ রণপা পায়ে হেঁটে যাচ্ছেন ওরা কারা! জিজ্ঞাসা করার আগেই লম্বা লম্বা পা ফেলে উধাও। গিল্ডের অফিসে গোগ্রাসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলেন এক গুঁফো লেখক। এক কামড় বসিয়ে বলেছেন, ‘বই কিনে কেউ ফতুর হয় না।’ পাশ থেকে ফুট কাটলেন অন্য এক গল্পকার, ‘মুজতবা আলীর কথাটা নিজের বলে চালিয়ে দিচ্ছেন দাদা!’
‘সেলিব্রিটি কাছে এলে প্রকৃত পাঠক সরে যায়’, কবিতার স্টল থেকে ভেসে আসছে কবিদের উত্তালধ্বনি। ‘হাল্কা খাদ্য খান, বই কিনুন বেশি’, হাতচোঙা ফুকছেন এক ঘটিগরম চানাচুরওয়ালা। ঘটিগরমের চারপাশে থিকথিকে ভিড়!
‘বই কিনুন,বই পড়ুন, বই উপহার দিন’, শোনা যাচ্ছে মধুর আহ্বান। আর মুখোমুখি দু’টি স্টলের চিৎকারে টনটন করছে মাথা। এর মধ্যেই বইপ্রেমীদের প্রশ্নের ঢেউ, ‘সতীনাথ ভাদুড়ীর গ্রন্থাবলী কোথায় পাব? হাজার চুরাশির মা কাদের?’
—‘আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের স্টলটা কোন দিকে?’
—‘রবীন্দ্রনাথ কোনওদিন বইমেলায় স্টল দেননি!’ চিৎকার করে উঠলেন এক রবীন্দ্রপ্রেমী।
—‘না, মানে জানতে চাইছি রবীন্দ্রনাথের বই কোথায় পাব?’
—‘সোজা গিয়ে ডানদিকে গলি পেরিয়ে বাঁদিকে বিশ্বভারতীর স্টলে।’
—‘শিবরাম চক্রবর্তীকে কোথায় পাওয়া যাবে?’
—‘আর পাবেন কোথায়! রোজ রোজ রাবড়ি খেতে খেতে হাসতে হাসতে উনি মিশে গিয়েছেন হাওয়ায়!’
—‘শিবরামের বই চাইছেন তো? স্টলগুলোর নাম বলছি , পেয়ে যাবেন।’
—‘লাখ টাকার বই কিনলে গাড়ি উপহার পাওয়া যাবে?’
—‘লাখ নয়, কোটি!’
—‘বাপরে! কোটি টাকার বই!’
—আরে, ঘরে টাকা রাখলেই বাড়িতে রেইড! বই কিনলে টেনশন ফ্রি!’
আত্মপ্রতিকৃতি আঁকাতে বসে গেছেন সেলফি-ক্লান্ত নরনারীর দল। কাত হয়ে সেলফি তুলতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন এক যুবতী। যুবক এসে বাঁচালেন। ‘তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, মেলার মাঠে আমি তোমাকে চাই’, কে একটা গেয়ে উঠতেই পাশ থেকে আরেকটা রেওয়াজ করা গলা, ‘বারোমাস ধরে আমি বইকে চাই, মনখারাপের দিনে আমি বইকে চাই, শেষ পর্যন্ত বইকে চাই।’
বইমেলা ডাকছে। চলুন, অনন্তযৌবনা বইয়ের কাছে ফিরি।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : উজ্জ্বল দাস