পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
কী সেই কৌশল? সবচেয়ে নিরাপদ ছদ্মবেশ। বিমা কোম্পানির এজেন্ট। দেশে থাকতেই এই ব্যবস্থা করে গিয়েছেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। ‘ট্রপিক্যাল ইনস্যুরেন্স’। তার আড়ালে দেশজুড়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা। সেই ইতিহাসে যে নামটি সর্বাগ্রে উঠে আসে, সেটি ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘ইন্টেলিজেন্স ওয়ারফেয়ার’ শুরু হয় এই সংগঠনের হাত ধরেই। আসলে কয়েকজন সাহেব বা পুলিস অফিসারকে নিকেশ করে যে দেশের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়, সেটা জানতেন সুভাষচন্দ্র। বুঝেছিলেন, এর জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা। সেই কারণেই ১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেসকে সামনে রেখে তিনি তৈরি করেন— ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’। বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের অনুগামী সত্যরঞ্জন বক্সী, সত্য গুপ্ত, সুপতি রায়, রসময় শূর, নিকুঞ্জ সেন, জ্যোতিষ জোয়ারদাররা পরবর্তীকালে কাঁধে তুলে নেন সেই সংগঠনের দায়িত্ব। এক বছরের মধ্যেই ময়দানে নেমে পড়েন সেই স্বেচ্ছাসেবকরা। ১৯৩০ সালে ঢাকায় বিনয় বসুর লোম্যান হত্যা, অলিন্দ যুদ্ধ, মেদিনীপুরে তিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পেডি, ডগলাস ও বার্জকে হত্যা, কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট স্টিডেন্স হত্যার পাশাপাশি দেশজুড়ে চলতে থাকে সুভাষচন্দ্রের সংগঠনের কাজ।
১৯৩৫ থেকে ১৯৩৭, জেলবন্দি হলেন সংগঠনের সমস্ত নেতা। ১৯৩৮ সালে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষচন্দ্র। সঙ্গে সঙ্গেই ফের সক্রিয় হয়ে উঠল ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন। আন্তর্জাতিক রণক্ষেত্রের সঙ্গে ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামকে সম্পৃক্ত করতে সুভাষচন্দ্র রচনা করলেন প্রেক্ষাপট। কিন্তু এই কর্মকাণ্ডের জন্য যে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। তার জন্য বিশেষ এক কৌশল নিলেন তিনি। ব্রিটিশ সরকারের নাকের ডগা দিয়েই বৈধভাবে অর্থের সংস্থান হল। লালা শঙ্করলাল ছিলেন সুভাষচন্দ্রের বিশ্বস্ত সঙ্গী। তাঁকে দিয়েই পুনরুজ্জীবন হল ট্রপিক্যাল ইনস্যুরেন্সের। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৭ সালে। জাতীয়তাবাদী নেতা হাকিম আজমল খান, ডঃ মহম্মদ আনসারির হাত ধরে। কিন্তু সেটি বেশিদিন টেকেনি। তিনের দশকে শঙ্করলালকে দিয়ে তা আবার চালু করেন নেতাজি। স্বয়ং সুভাষচন্দ্র হলেন কোম্পানির বোর্ড অব ডিরেক্টর্সের চেয়ারম্যান। জেলফেরত বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের বিপ্লবীদের একটা নিরাপদ আশ্রয় প্রয়োজন। সকলে মিলে চাকরি নিলেন এই ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে। কারণ, বিমা এজেন্ট হিসেবে দেশজুড়ে কাজ করার সুবিধা মিলবে।
ভারতে কাজ করতে আসা সাহেব কর্মচারীদের বিমা করাতো ট্রপিক্যাল ইনস্যুরেন্স। সংস্থার নিত্য নতুন চটকে আকৃষ্ট হন অনেক উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ কর্তাও। সময়মতো ইনস্যুরেন্সের সুফলও পেতেন। ফলে কখনও কোনও সন্দেহ হয়নি। আর সেই বিমা কোম্পানির ছত্রছায়ায় একটু একটু করে বোনা হয়েছিল বিপ্লবের বীজ।
জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া সহ ইউরোপের একাধিক দেশের বহু কোম্পানি সেসময় ভারতে। তেমনই একটি সংস্থা, হ্যাভারো ট্রেডিং কোম্পানির ম্যানেজার হয়ে বোম্বাই শহরে পা রাখেন অসওয়াল্ড উখস্। প্রকাশ্যে কর্পোরেটের মুখোশ, আসল লক্ষ্য জার্মান সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামে সহায়তা করা। কারণ, ব্রিটেনকে ভারতীয় উপনিবেশে যুদ্ধে জড়াতে পারলে ইউরোপের রণাঙ্গনে তাদের পরাস্ত করা সহজ হবে। সেই সমীকরণ মাথায় রেখেই সুভাষচন্দ্রের নির্দেশে বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের প্রতিষ্ঠাতা হেমচন্দ্র ঘোষ গেলেন উখসের কাছে, সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে। ভারতের স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক শক্তির সাহায্য গ্রহণের চেষ্টা চলতে লাগল পুরোদমে।
কিছুদিনের মধ্যেই রচিত হল নিখুঁত পরিকল্পনা। মধ্যরাত্রে দেশ ছাড়লেন সুভাষচন্দ্র। বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের শীর্ষস্থানীয়রা প্রায় সকলেই জেলে। বাইরে কাজের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন যতীশ গুহ, সুবোধ চক্রবর্তী, ভবেশ নন্দী, নিরঞ্জীব রায়, মনোরঞ্জন সেন, ধীরেন ঘোষ, কালীপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল নন্দী, ক্ষিতি সেন, ফণী দাস, প্রফুল্ল ত্রিপাঠী, কামাখ্যা রায় প্রমুখ। কলকাতায় কাজ করছেন সত্যরঞ্জনের ভাই সুধীর বক্সী।
সুভাষচন্দ্র যে দিন ভারত ছাড়লেন, সেই দিনই অর্থাৎ ১৭ জানুয়ারি, ১৯৪১ ট্রপিক্যাল ইনস্যুরেন্সের সমস্ত কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা। তবে এই কোম্পানির মাথায় যে সুভাষচন্দ্র রয়েছেন, তা বুঝতে পুলিসের সময় লাগে পাক্কা ১০ দিন। দেশ ছাড়ার জন্য এই ১০ দিনই সময় ছিল নেতাজির হাতে। তিনি যে বহুদিন ধরে মহানিষ্ক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন, এই ঘটনাই তার প্রমাণ।
তদন্তে নেমে ট্রপিক্যাল ইনস্যুরেন্সের এজেন্ট তালিকায় থাকা বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের বিপ্লবীদের চিহ্নিত করে ব্রিটিশ পুলিস। রেহাই পাওয়ার উপায় ছিল না। প্রয়োজন পড়ে নতুন একটি ছদ্মবেশের। আগে থেকে তৈরি ছিল আরও একটি সংস্থা—‘ইউ. এন. দাস অ্যান্ড কোম্পানি’। সেটির ছত্রছায়াতেই ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত আজাদ হিন্দ ফৌজের সিক্রেট সার্ভিসের কাজ চালিয়ে যায় বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, ময়মনসিংহে এই সংগঠনের সদস্যরা নিজেদের বাড়ির বাইরে এই কোম্পানির একটা সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখতেন। তা দেখেই বিপ্লবীরা চিনে নিতেন নিরাপদ আশ্রয়। পূর্ববঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এভাবেই এমন সিক্রেট এজেন্টদের মধ্যে অন্যতম অমলেন্দু ঘোষ, অসিত ভৌমিক, অনিল সেন, চঞ্চল মজুমদার, ধীরেন সাহা রায়, অজিত রায় প্রমুখ।
কলকাতা, ঢাকা, বোম্বাই, উড়িষ্যা, দিল্লি, বিহার, উত্তরপ্রদেশে (তৎকালীন যুক্তপ্রদেশ) ওই বিমা কোম্পানির নামের আড়ালে আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে কাজ করতেন সুভাষ অনুগামীরা। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে নেতাজির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার দায়িত্ব ছিল কামাখ্যা রায়, যতীশ গুহ, রামকৃষ্ণ ক্ষেত্রী, হায়দার ইয়াকুব, আব্দুল রহমান, হরিবিষ্ণু কামাথের উপর। সুধীন পাল ও শান্তি গঙ্গোপাধ্যায়কে সেখানে প্রতিনিধি হিসেবেও পাঠানো হয়।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বে চলা বিপ্লবী আন্দোলনের প্রধান শক্তিই ছিল বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স। আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠার পর ভারতে ইন্টেলিজেন্স ওয়ারফেয়ারের দায়িত্ব স্বভাবতই তাদের কাঁধে অর্পণ করা হয়। আসলে আমরা যে সুভাষচন্দ্রকে জেনেছি, তার অন্তরালে কত বড় মাপের আন্তর্জাতিক নেতা ও ‘ইন্টেলিজেন্স কিং পিন’ লুকিয়ে, তার মূল্যায়ন এখনও হয়নি।