পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
—প্রথমেই বলতে হবে, মোদিজি আমাদের দেশকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে গিয়েছেন। জি-২০ করেছেন।
—আপনার উপকার হয়েছে এমন...।
—বলছি, বলছি... রামমন্দির।
—রামমন্দিরে সরাসরি আপনার উপকার হয়েছে?
—না, তা হলেও। ৫৫০ বছরের ডিসপুট মিটিয়েছেন মোদিজি।
—তাহলে সেটাকেই আম জনতার রোজকার কাজে লাগার মতো বিষয় ধরতে পারি?
—না, তা নয়। আচ্ছা তিন তালাক!
—আপনি মুসলিম?
—না।
—তাহলে তিন তালাক রদ আপনাকে কীভাবে সাহায্য করল?
—ঠিক আছে, ঠিক আছে। তাহলে কাশ্মীরে ৩৭০।
—সে কী, আপনি তো থাকেন কোচবিহারে। কাশ্মীরে ৩৭০ খারিজ হওয়ায় আপনার কী লাভ হল?
—জয় শ্রী রাম।
ইন্টারভিউ শেষ। এই ছবি কিন্তু দেশের সর্বত্র। নরেন্দ্র মোদির ক্যারিশমা নিয়ে বহু মানুষই উদ্বাহু হতে পারেন, তাঁর জমানায় সাধারণ মানুষের সরাসরি কী উপকার হয়েছে, সেই উত্তর খুঁজতে ভক্তকুলও মাথা কুটছে। আগামী শুক্রবার উত্তরবঙ্গের তিনটি কেন্দ্রে ভোট। আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি। লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফা। আর তার প্রাক-মুহূর্তে আম ভোটারের মনে জেগে ওঠা অকাট্য প্রশ্নটা হল, কোন কোন প্রতিশ্রুতি এই পাঁচ বছরে পূরণ হয়েছে? ২০১৯ এবং ২০২১ সালের ভোটে উত্তরবঙ্গের এই জেলাগুলিতেই পায়ের তলার জমি শক্ত করেছিল বিজেপি। ফলে মোদি ব্রিগেডের পক্ষ থেকে যে যে প্রতিশ্রুতি উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য থালায় সাজিয়ে এসেছিল, সেগুলির বাস্তবায়ন নিয়েই তো প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। দুর্গাপুজোয় ভোগের দায়িত্ব যাঁকে দেওয়া হয়েছে, রান্না খারাপ হলে পাড়ার লোক তো তাঁকেই ধরবে। পাশের পাড়ার রাঁধুনিকে নিশ্চয়ই নয়। পাঁচ বছর ধরে ‘আস্থা’ রাখার পর কয়েকটি অমৃত ভারত স্টেশন ছাড়া উত্তরবঙ্গের মানুষের জন্য কিছুই জোটেনি। গোর্খাল্যান্ড? হয়নি এবং অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার মতো কোনও সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তা যে দলই সরকারে আসুক না কেন। চা-বাগানের স্বার্থ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমির পাট্টার ব্যবস্থা করেছেন, চা-সুন্দরী প্রকল্পের মাধ্যমে মাথার উপর ছাদের উদ্যোগ নিয়েছেন, শ্রমিকদের বর্ধিত মজুরি সুনিশ্চিত করেছেন। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার এই পাঁচ বছরে চা-বাগানের জন্য কী করেছে? আলিপুরদুয়ারের ভোটভাগ্য কিন্তু এই ‘নজরকাড়া’ প্রশ্নের উপর অনেকটাই দাঁড়িয়ে আছে। আর এখানেই পেনিট্রেট করার চেষ্টায় আছে সঙ্ঘ। আরএসএস দীর্ঘদিন ধরেই এই কেন্দ্রে বিজেপির সম্ভাবনা পাকাপোক্ত করার জন্য সমাজের একেবারে নিচুতলায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। উনিশের নির্বাচনে গোটা রাজ্যেই এই কাজটা চালিয়েছিল সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা। সেটা অবশ্য এখন সব জেলায় হচ্ছে না। বাছাই করা কিছু কেন্দ্রের জন্য তুলে রাখা হয়েছে। কেন? প্রার্থী নিয়ে মন কষাকষি? বঙ্গ বিজেপির বিশেষ কোনও নেতার প্রতি অ্যালার্জি? উত্তর স্পষ্ট নয়। তবে আলিপুরদুয়ারে তলায় তলায় কাজটা চালিয়ে যাচ্ছে সঙ্ঘ। কারণ, এখানকার বিজেপি প্রার্থী মনোজ টিগ্গা। গেরুয়া শিবিরের একের পর এক প্রতিশ্রুতি এই জেলাতেও ফেল করেছে। গতবারের এমপি জন বারলা বিক্ষুব্ধ। মনোজ টিগ্গার বিরুদ্ধে তিনি প্রথম থেকেই তোপ দেগে গিয়েছেন। চা-বাগানের সংগঠনের অন্দরেও তাঁর ভালোরকম প্রভাব। তার উপর ভোটের ময়দানে প্রবল খাটছেন তৃণমূল প্রার্থী প্রকাশচিক বরাইকও। ঠিক যেখানে যেখানে মোদির গ্যারান্টির ফাঁক রয়েছে, সেই জায়গাগুলোই ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তিনি। তার উপর গঙ্গাপ্রসাদ শর্মা বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। এই জেলায় গেরুয়া সংগঠনের অনেকটাই তাঁর হাত ধরে তৈরি। ফলে গঙ্গাপ্রসাদের দল ছেড়ে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে বিজেপির জন্য বড় লোকসান। কোথায় কোথায় হাতুড়ি মারলে কাজ হবে, সেটা তিনি বিলক্ষণ জানেন। আপাতত সেটাই করে চলেছেন গঙ্গাপ্রসাদ। এই সব সমীকরণের প্রভাব যাতে ইভিএমে না পড়ে, তার জন্য ড্যামেজ কন্ট্রোলের খুব প্রয়োজন ছিল। সেই চেষ্টাটাই করছে আরএসএস। চা-বাগানের ইউনিয়নকে তারা বুঝিয়েছে, এবার ভোটটা উতরে দাও। সরকারে এলে তোমাদের দাবিদাওয়া বুঝে নেব। কী সেই দাবি? চা-বাগানের লভ্যাংশ। অধিকার। কিন্তু তাতেও কি বিজেপির পক্ষে পরিস্থিতি খুব অনুকূল হয়েছে? তেমনটাও বলা যাচ্ছে না। তার সবচেয়ে বড় কারণ, বিজেপির কাছে নতুন করে দেওয়ার মতো আর কোনও প্রতিশ্রুতিও নেই। আর এটা শুধু আলিপুরদুয়ার নয়, সমস্যা কোচবিহারেরও। এই কেন্দ্রের এমপি নিজেই আবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর বিরুদ্ধে কতগুলো অভিযোগ রয়েছে, সেটা ভোটের বাজারে অপ্রাসঙ্গিক। সে তো আগেরবারও ছিল। তারপরও নিশীথ প্রামাণিক জিতেছেন। স্রেফ বিজেপি হাওয়ায়। এবারও তেমন একটা হাওয়া-টাওয়া তোলার চেষ্টা চলছে। কারণ বিজেপির অন্দরমহল জানে, নিশীথের উপর ক্ষোভ রয়েছে এলাকার মানুষের। একে তো পাঁচ বছরে ক’দিন তাঁকে সাধারণ মানুষ চোখের সামনে পেয়েছে, তা এক তালুর করেই গুনে বের করা যায়। সেটাও মেনে নেওয়া যেত। কারণ তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। হিল্লি-দিল্লি করতেই পারেন। কিন্তু যাঁরা তাঁকে ভোট দিয়ে দিল্লি পাঠিয়েছেন, তাঁদের কি কিছুই প্রাপ্য নেই জনপ্রতিনিধির কাছে? যদিও বা চোখের দেখা মিলল, কাছে ঘেঁষাই দায়। সব সময় খান আষ্টেক ব্ল্যাক ক্যাট কমান্ডো ঘিরে রেখেছে তাঁকে। চেষ্টা করলে শাহরুখ খানের সঙ্গেও হাত মেলানো যায়। কিন্তু কোচবিহারের এমপি? ভাবতেই ভয়। উপরন্তু আবার বিস্তর চটেছেন অনন্ত মহারাজ। বিজেপি তাঁকে জামাই আদর করে রাজ্যসভায় নিয়ে গিয়েছে। টার্গেট ছিল, লোকসভা ভোটে রাজবংশী সমর্থন সবটা গেরুয়া শিবিরে আসবে। পদ্মপার্টির পাতায় পা রেখেই অনন্ত মহারাজ বুঝেছেন, এ মোটেই সহজ ঠাঁই নয়। পা হড়কে যাবেই যাবে। প্রতিশ্রুতি যা শোনা গিয়েছিল, তার সবটাই কথায় কথায়। কাগজে-কলমে কোনওটাই আসবে না। রাজবংশীদের জন্য আশ্বাস। বাস্তবায়িত হচ্ছে না। পৃথক রাজ্যের স্বপ্নও ধোঁয়া ধোঁয়া। ফলে অনন্ত মহারাজের ক্ষোভ থাকাটা স্বাভাবিক। সেটাই হচ্ছে। এখানেই ছাড়া সুতোটা গুটাতে শুরু করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ এবং উদয়ন গুহ। রবিবাবু বেশ কয়েক বছর ধরে তৃণমূলের সংগঠনটা কোচবিহার জেলায় ধরে রেখেছেন। আসন হাত থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। তারপরও হাল ছাড়েননি তিনি। শুধু অপেক্ষা করে গিয়েছেন। উদয়ন গুহ আবার একটু স্টেপ আউট করে খেলতে পছন্দ করেন। নিশীথ প্রামাণিকের সঙ্গে ঠোকাঠুকি করেই তাঁর দিন গুজরান। কিন্তু সেটা যতটা কথায় কথায় হয়, ততই ভালো। হাত-পা চলাটা কোচবিহারবাসী পছন্দ করেন না। সেটা তাই উদয়নবাবুকে খানিক মাথায় রাখতে হচ্ছে। তবে সব মিলিয়ে কোচবিহার আসনটা বেশ আকর্ষক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। দু’পক্ষই মনে করছে, জেতাটা সময়ের অপেক্ষা। একটা ব্যাপার নিশ্চিত, দিনহাটা সহ দু’-তিনটি পুর এলাকা শেষ মুহূর্তে নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়াবে। ইতিমধ্যেই দিল্লি শিবিরের বিরুদ্ধে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে। তৃণমূলও চেষ্টা চালাচ্ছে যাবতীয় ‘ড্যামেজ’ আটকানোর। এক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের প্রধান সুবিধার জায়গাটা হল স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লাগাতার কোচবিহারে সভা ও পদযাত্রা করে চলেছেন। বারবার তাঁর বক্তব্যে উঠে আসছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, বিজেপির অপশাসন, চা-বাগানের মানুষের জন্য জমির পাট্টার প্রসঙ্গ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিণত রাজনীতিক। তিনি জানেন, একটি বিষয় মানুষকে বিশ্বাস করাতে গেলে বারবার বলে যেতে হবে। মানুষের মনে সেই ইস্যু দিয়ে আঘাত করতে হবে। আর সেটাই তিনি করছেন। জগদীশচন্দ্র বসুনিয়াকে প্রত্যেক পদক্ষেপে পাশে রাখছেন তিনি। বোঝাচ্ছেন, বসুনিয়াকে ভোট দেওয়া মানে তাঁকেই দেওয়া। জগদীশবাবুর ইমেজও এলাকায় বেশ ভালো। ফলে ভোটারদের মনে সেটা রীতিমতো পজিটিভ প্রভাব ফেলছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সামনে হয়তো ডার্ক হর্স হিসেবেই নেমেছেন তিনি। কিন্তু ফারাকটা ঘুচিয়ে দিচ্ছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। দলের কর্মীদের তো বটেই, নিজেকেও মমতা বলে দিয়েছেন... এই তিনটি আসনই তাঁর চাই।
তৃতীয় আসন, অর্থাৎ জলপাইগুড়ি। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, জয়ন্ত রায়কে এবার আর প্রার্থী করছে না বিজেপি। কারণ, দলের অন্দরের ক্ষোভ। বঙ্গ বিজেপির বেশ কয়েকটি অংশ থেকে জয়ন্তবাবুকে প্রার্থী করা নিয়ে আপত্তি জানানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর নামেই সিলমোহর দিয়েছেন দিল্লির নেতৃত্ব। ফলে প্রচার ও কর্মী-সমর্থনের নিরিখে প্রথমেই মাইনাস থেকে শুরু করতে হয়েছে তাঁকে। উল্টোদিকে তৃণমূলের নির্মলচন্দ্র রায় রাজনৈতিক দিক থেকে বেশ ভালো ক্যান্ডিডেট। সমাজে ইমেজ তাঁরও পরিষ্কার। ফলে এখানেও অ্যাডভান্টেজ তৃণমূল। আর একটা ফ্যাক্টর এই জেলায় কাজ করছে। সেটা হল, বাম ভোট। বহু বছর পর বামফ্রন্টকে এই জেলায় অন্তত কিছুটা আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। যদি নিজেদের ভোটব্যাঙ্কের বেশ খানিকটা তারা ফিরিয়ে আনতে পারে, সেটা বড় ড্যামেজ করবে বিজেপির। কারণ, সেক্ষেত্রে ভোট কাটাকাটিতে এগিয়ে যাবে তৃণমূল। তবে হ্যাঁ, বাম-কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক এবার অন্য দুটো জেলাতেও নজরে থাকবে। বামের ভোট রামে—এই তত্ত্ব শেষ দু’টি বড় ভোটের পর ফিকে হতে শুরু করেছে। সেটা যেমন তৃণমূলের কাছে আশার, নরেন্দ্র মোদির কাছে আশঙ্কার। তাই তিনিও আসছেন উত্তরবঙ্গে। সভা করছেন। কিন্তু সন্দেশখালি বা সিএএ ছাড়া প্রচারের ইস্যু পাচ্ছেন না। কারণ ওই এক... বলার কিছু নেই। বিজেপিও তাই উত্তরবঙ্গ জুড়ে তলায় তলায় এখন প্রচারে নেমেছে, ‘এটা তো মোদির ভোট। বড় ভোট।’ অর্থাৎ, দিল্লির ভোট মোদিকে দাও। রাজ্যের ভোট দিদিকে। আপাতত তো লোকসভাটা উতরে নেওয়া যাক! বিধানসভার কথা পরে ভাবা যাবে।
মাস পয়লা পেরিয়ে গিয়েছে। তারপরও কিন্তু এখন বিজেপির শিয়রে সংক্রান্তি। তারা জানে, উত্তরে ফল বিগড়ে গেলে দক্ষিণেও বড় ধস নামবে। ডাবল ইঞ্জিন হয়নি, সেক্ষেত্রে ডাবল ডিজিট হওয়াও মুশকিল হয়ে যাবে। সিএএ পিছনের সারিতে চলে গিয়েছে। যতটুকু চার্জ দিচ্ছে, রামমন্দির। কিন্তু সে দিয়ে তো আর ২১টা বিধানসভাকে কাবু করা যাবে না! তাই শেষ লগ্নের মরিয়া প্রচার চলছে, তৃণমূল জিতলে সব ক্ষীর কলকাতা খেয়ে নেবে। উত্তরবঙ্গের জন্য কিছু থাকবে না। সত্যিই কি তাই? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিন্তু বলার জন্য জমির পাট্টা থেকে চা-সুন্দরী, সবই আছে। নরেন্দ্র মোদির বলার মতো কিছু আছে তো? যা উত্তরবঙ্গের মানুষকে সরাসরি উপকৃত করেছে?