পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
বাংলা কি তবে ব্রাত্য হয়ে গেল?
দোরগোড়ায় আরও একটা একুশে ফেব্রুয়ারি। মুহূর্তে বিবেক চলকে ওঠার দিন। কেমন আছে আজকের বাংলা ও বাঙালি? চণ্ডীমণ্ডপ কবেই উঠে গিয়েছে। নেই রোয়াকের আড্ডাও। তার জায়গা নিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপ চালাচালি। এককথায় অনলাইন আড্ডা। তবু বাংলা বেঁচে আছে গ্রামে, মফস্সলে, লেখকদের ভাষায়।
উপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয় বা দেশবন্ধু পাঠাগারের টিমটিমে আলোয় একুশে ফেব্রুয়ারির মিটিং বসেছিল সেদিন। শুধু সঙ্গীত, নৃত্য, শ্রুতিনাটক, কবিতার আলোচনা। রামধন লেনের রোয়াকেও তখন জোর আড্ডা জমেছে। এর মধ্যে বাজার ফিরতি অমূল্যবাবু আচমকা বিল্টুকে দেখে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, ‘কেমন আছ?’ উত্তর এল, ‘বিন্দাস জ্যেঠু।’ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন অমূল্যবাবু। সামলে নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ভালো? না খারাপ?’ একগাল হেসে বিল্টু বলল— ‘এত ব্যাকডেটেড হলে হবে জ্যাঠামশাই? দুনিয়া পাল্টাচ্ছে, পৃথিবী হাতের মুঠোয়। এখনই তো ফান্ডা মারার সময়...।’ বিল্টুদের কথার ফাঁকে ফাঁকে কত যে দুই, তিন বা চার অক্ষরের শব্দ ধেয়ে আসে তার ইয়ত্তা নেই। এককালের অশ্রাব্য গালি যে এখন টিন-এজ বাঙালির সম্পদ!
বাংলা ভাষার হাত ধরেই বাঙালি একসময় আন্তর্জাতিক হয়েছিল। সাহিত্য, সিনেমা সর্বত্র। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির মূলে ছিল বাংলা কাব্যগ্রন্থ ‘গীতাঞ্জলি’। ১৯৫৫ সালে সত্যজিৎ রায়ের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, সেও তো বাংলা ছবি ‘পথের পাঁচালী’র সৌজন্যে। সবশেষে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের মোট ১৮৮টি দেশে দিনটি পালিত হচ্ছে। পৃথিবীর সকল মায়ের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষার উৎসব একুশে ফেব্রুয়ারি, যার মূলে রয়েছে ‘আ’মরি বাংলা ভাষা’।
ইতিহাস বলছে, সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে বারংবার যুদ্ধ হয়েছে পৃথিবীতে। কিন্তু ভাষার জন্য যুদ্ধ ছিল সেই প্রথম। বাংলাদেশের মানুষ গত শতাব্দীতে দু’টি শ্রেষ্ঠ জিনিস পেয়েছিল—১৯৭১’এ স্বাধীনতা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার স্বীকৃতি। দু’টি আন্দোলনই ছিল রক্তক্ষয়ী। স্বাধীনতা অর্জনে প্রাণ দিয়েছিলেন হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা। আর মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায়ে শহিদ হন বরকত, রফিক, সালাম, আব্দুল জব্বার প্রমুখ। ১৯৫২ সালের সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামকে মনে রেখে লেখা হয়েছে অসংখ্য কবিতা, গান, নাটক, উপন্যাস।
বাংলা ভাষা রক্ষায় কেবলমাত্র বাংলাদেশের মানুষই নয়, শিলচরের ভাষা বিপ্লবীরাও প্রাণ দিয়েছিল। সেদিন ছিল ১৯৬১-এর ১৯ মে। অসম রাইফেলসের গুলিতে শিলচর স্টেশনে ঝাঁঝরা হয়েছিল ১১ জন। জখম হয়েছিল অসংখ্য। সেই দলের কমলা ভট্টাচার্য ছিলেন পৃথিবীর প্রথম মহিলা ভাষা শহিদ। এই আন্দোলনের ফলেই বর্তমানে বরাক উপত্যকার মূল ভাষা হয়েছে বাংলা। অসমের দ্বিতীয় ভাষা হয়েছে বাংলা। কিন্তু দুর্ভাগ্যের, বরাক উপত্যকায় বসবাসকারী বাঙালিদের দাবি আজও অধরা রয়ে গেছে। সেটি হল, শিলচর স্টেশনের নাম রাখা হোক ‘ভাষা শহিদ’ স্টেশন।
বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রাচীনতার কথা বললে প্রথমেই মনে পড়ে মানভূমের কথা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ছিল দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন। ১৯১২ সালে শুরু হলেও ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬-র মধ্যে এই আন্দোলন তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল এখানকার বাঙালিদের মধ্যে। সেখানকার স্কুল-কলেজ এবং সরকারি দপ্তরে রাজনৈতিকভাবে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আন্দোলনের ফলে অবশেষে ১৯৫৬ সালে মানভূম জেলা ভেঙে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাকে ‘পুরুলিয়া’ নাম দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কথা বলার নিরিখে বাংলা ভাষার স্থান পৃথিবীতে চতুর্থ। ইংরেজি, চিনা, স্প্যানিশ ভাষার পরই বাংলার স্থান। বর্তমান বিশ্বে প্রায় তিরিশ কোটি মানুষের মুখের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আন্দামান নিকোবর দীপপুঞ্জ, দণ্ডকারণ্য ও ত্রিপুরার প্রায় সবাই-ই বাংলায় কথা বলে। পাশাপাশি অসম, মেঘালয়, ঝাড়খণ্ড, বিহার ইত্যাদির অধিকাংশ মানুষই কথা বলে বাংলায়। মায়ানমারের আরাকান এলাকার রোহিঙ্গাদের প্রধান ভাষা বাংলা। একসময় আরাকান রাজসভায় বাংলা ভাষার প্রবল চর্চা হয়েছিল। সেই হিসেবে দৌলত কাজি ও সৈয়দ আলাওলের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ভারতের বাইরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউনাইটেড কিংডম-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্ম, ব্যবসা ও পড়াশোনার সূত্রে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাঙালিরা। সেইসব দেশের নির্দিষ্ট ভাষার পাশাপাশি উৎসব-অনুষ্ঠান, পুজোআচ্চা, ঘরোয়া আলাপে প্রবাসীরা টিকিয়ে রেখেছে বাংলা ভাষাকে। এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়, পশ্চিম আফ্রিকার দেশ রিপাবলিক অব সিয়েরা লিওনের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হল বাংলা। পৃথিবীর বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য ও বাংলা ভাষা পড়ানো হয়।
তবুও আমরা মাঝে মাঝেই ভুলে যাই রবীন্দ্রনাথকে। দু’টি দেশের জাতীয় সঙ্গীত লিখেছেন যিনি বাংলায়। ভারতের জন্য ‘জনগণমন অধিনায়ক জয় হে…’ আর বাংলাদেশের ‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি…’। নীরব থাকি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র সম্পর্কেও। যিনি আমাদের জাতীয় স্তোত্র ‘বন্দেমাতরম’ লিখেছিলেন বাংলায়। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ‘বন্দেমাতরম’-ই ছিল বিপ্লবীদের মূলমন্ত্র।
কিন্তু বাংলা-সহ অনেক মাতৃভাষাই বিপন্ন। আগামী একশো বছরের মধ্যে, ২০০৯ সালে রাষ্ট্রসংঘ কর্তৃক তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে প্রচলিত ৬ হাজার ভাষার মধ্যে ৩ হাজার লুপ্ত হয়ে যাবে। পৃথিবীতে ৫১টি ভাষা আছে, যেখানে ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১ জন করে। তাদের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে যাবে সেইসব মাতৃভাষা। যে সব মাতৃভাষার নিজস্ব লিপি নেই তারাও ক্রমশ বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি ভাষার মৃত্যু মানেই একটি সংস্কৃতির মৃত্যু, জ্ঞানের মৃত্যু। ভাষায় সৃষ্ট সাহিত্য বা সংস্কৃতির মধ্যে লুকিয়ে থাকে জ্ঞান, লুকিয়ে থাকে ভাষার ক্রমবিকাশের ধারা। সাহিত্যরূপ মৃতসঞ্জীবনী পাঠ করলে অতীতের ফেলে আসা ইতিহাস দেখা যায়।
যে কোনও ভাষামৃত্যুর মূল কারণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা। যে ভাষাভাষী মানুষের দল রাজনীতি ও অর্থনীতির দিক থেকে ক্ষমতাশালী তারা রাঘব বোয়ালের মতো গ্রাস করছে চুনোপুঁটিসম মাতৃভাষাকে। তাদের কাছে অন্য ভাষার আবেগ, ভালোবাসা ইত্যাদির কোনও মূল্য নেই। একদল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ হারিয়ে যাওয়া ভাষার পুনরুদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়েছে। তারাই আবার লুপ্তপ্রায় ভাষার সংরক্ষণের জন্য সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, তাদের থেকে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা ঢের বেশি। তাই ভাষার পুনরুদ্ধার বা সংরক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে খাতায় কলমে থেকে যাচ্ছে।
ভারতে বাংলা নামক মাতৃভাষা ক্রমশই হিন্দি ভাষার কাছে হেরে যাচ্ছে। পাশাপাশি রয়েছে হিন্দি বিনোদন জগতের অতি সক্রিয়তা। কিছু বাঙালি সরাসরি বা টেলিফোনে হিন্দি ভাষায় কথা বলার সুযোগ পেলে নিজের মাতৃভাষা বেমালুম ভুলে ভুলভাল হিন্দি বলাতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। বিষয়টি অবাঙালি বলয়ে হলে বিশেষ কথা হত না, খোদ বাঙালি বলয়েও হিন্দি বলার পটুত্বে নিজেকে বড্ড গৌরবান্বিত মনে করে কিছু বাঙালি। দুর্ভাগ্যের, সেই হিন্দিভাষী মানুষটি অন্য ভাষা জানলেও তার প্রয়োগে কোনও আগ্রহ দেখায় না।
কিন্তু একসময় এই বাংলাই ছিল ভারতীয় সিনেমার পথ-প্রদর্শক। রাজনীতি, বুদ্ধিমত্তা, শিল্পসংস্কৃতি, বিজ্ঞানচর্চা সবক্ষেত্রেই ছিল বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এগিয়ে। এখন প্রায় সবক্ষেত্রেই বিশেষত সিনেমা, রিয়ালিটি শো-তে হিন্দির জয়জয়কার। বাংলা ভাষাকে স্থানচ্যুত করার জন্য আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ডে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলি ক্রমশ উঠে যাচ্ছে। অভিযোগ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য পড়ার ছাত্রছাত্রী নেই। রব উঠেছে বাংলা নিয়ে পড়লে আগামী দিনে তার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। বাইরের প্রদেশ কেন, খোদ পশ্চিম বাংলাতে বাঙালিরা আশঙ্কায় রয়েছে বাংলা নিয়ে পড়লে আদৌ কী ভবিষ্যতে কিছু করা যাবে! পরিসংখ্যান বলছে, এই কারণেই খোদ পশ্চিমবঙ্গে বাংলা মিডিয়াম স্কুলের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তার জায়গায় ক্রমশ দখল নিচ্ছে ইংরেজি বা হিন্দি মিডিয়াম স্কুল। ব্যাঙের ছাতার মতো পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠছে এই ধরনের স্কুল। অনেকে অভিযোগ করছেন পরিষেবা বা মানুষকে শিক্ষিত করা নয়, স্কুল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি দেওয়াই তাদের আসল ব্যবসা।
শুধু অবাঙালিরাই নয়, অনেক বাঙালি ব্যবসায়ী নিজের মাতৃভাষাকে ধুলিসাৎ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তার পরোক্ষ প্রভাব পড়ছে ছাত্রছাত্রীদের মনে। তাই ‘শুভ জন্মদিন’-এর জায়গায় স্থান পেয়েছে ‘Happy Birth Day’, সংক্ষেপে HBD. সাতসকালে চেনা পরিচিতদের কাউকে দেখলে ‘Hi’, ‘Hello!’ অথবা ‘Have a Nice Day!’ বিদায়কালে ‘Bye… See U Soon’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের সমাহার।
প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি বা ১৯-মে এলেই আমরা বাংলা ভাষার প্রতি গদ্গদ্ হয়ে যাই। দৈনিক কাগজে স্পেশাল ইস্যু বেরোয়। টিভির পর্দায় বাংলা ভাষাকে বাঁচাতে অথবা বাংলার উৎকর্ষ সাধনে যুদ্ধ বেঁধে যায়। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২১ ফেব্রুয়ারির সকালে পরিশীলিত পোশাকে প্রভাতফেরির ঘটনা নিশ্চিতরূপে আনন্দের। বাংলা ভাষাকে শপথ করে বক্তৃতার ঝড়ে যেন শোনা যায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ময়দানে পাকিস্তানি রাইফেল বাহিনির ছোড়া গুলির শব্দ। যে গুলির ঘায়ে একে একে বলি হচ্ছে বরকত, রফিক, সালেমরা। মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকের অভিনয়ের পাশাপাশি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ আব্দুল গফ্ফর চৌধুরীর কথায় আলতাফ মাহমুদের সুরে অসাধারণ লাগে ‘আমি কি ভুলতে পারি’! সমান্তরালভাবে চলে রবীন্দ্রনাথের ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল’, অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা’ এইরকম কত গান! এইদিনে বেশ মানানসহ লাগে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘আমি বাংলায় গান গাই’-এর সঙ্গে সমবেত নৃত্য। তারপর দিন অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি সব উধাও হয়ে যায় বাঙালির মন থেকে। বাংলা ভাষার উৎকর্ষসাধন নিয়ে তখন আর কোনও নামগন্ধ অবশিষ্ট থাকে না। তখন ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের লেখা একটি কবিতার লাইন মুখ্য হয়ে ওঠে জনমানসে ‘জানেন দাদা, আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’। তাই বিভিন্ন পার্বণকে সামনে রেখে টিন-এজ বাঙালিদের মধ্যে চলে কথা চালাচালি। ফেসবুক মেসেঞ্জারে অনবরত চলে ‘পিং’। আর হোয়াটসঅ্যাপে ‘Good Morning’-এর বন্যা। সব ক্ষেত্রেই হ্যাপির ছড়াছড়ি। যেমন— ‘Happy Poushparbon’, ‘Happy Saraswati Puja’, ‘Happy Poila Fagun’, ‘Happy Chaitrasankranti’, ‘Happy Bengali New Year’s Day’ ইত্যাদি। অদ্ভুত ব্যাপার, মহালয়ার ভোর থেকে ‘Happy Mahalaya’-য় ভরে যায় মোবাইলের স্ক্রিন।
অনেক বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ইংরেজি মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার বন্দোবস্ত থাকলেও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে বাংলায় পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। মাস্টার ডিগ্রিতে বাংলা বিভাগ ছাড়া বেশিরভাগ বিভাগেই বাংলা মাধ্যমে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে যাবতীয় নোটিশ, সারকুলার সবই হয় ইংরেজিতে। কোথায় মাতৃভাষাপ্রীতি! উচ্চ শিক্ষার স্তরেই যদি মাতৃভাষার পথ রুদ্ধ হয়ে যায় তবে ২১ ফেব্রুয়ারি বা ১৯ মে শপথ করার প্রয়োজনীয়তা কোথায়!
অনেকের মতে, বেশিরভাগ বাঙালিই বিশ্বাস করে একদিনের বাঙালিয়ানা। পয়লা বৈশাখের সকালে হাতে শাঁখা-পলা, সিঁথিতে সিঁদুরের সঙ্গে পরনে ঢাকাই জামদানি শাড়ি বেশ মানানসই লাগে। দুপুরে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে মাটি ও কলাপাতার বাসনে রেস্টুরেন্টে বাঙালিয়ানা ভোজ। দোল পূর্ণিমায় রং খেলা, ২৫ মে দিনভর শুধুই নজরুলচর্চা। পঁচিশে বৈশাখ বা বাইশে শ্রাবণে রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কেউ থাকতে পারেন সাহিত্য জগতে, অনেক বাঙালি ভাবতেই পারে না। অনেকে এতটাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ—দুর্গাপুজো, ভাইফোঁটা ইত্যাদিতেও বাঙালিয়ানা রক্ষায় বৈশাখের প্রথম দিনের মতো মাটি ও কলাপাতার বাসনে বাঙালিয়ানার ভোজ খেয়ে জব্বর ঢেকুর তোলে। তবে এটা ঠিক, পার্বণের দিনগুলো বাদ দিলে প্রতি সন্ধ্যায় মোটরবাইকের পিছনে বাঁধা খাবারে (পিৎজা, বিরিয়ানি, চাউমিন, থাই স্যুপ ইত্যাদি) মেতে ওঠে অনেক বাঙালিই।
হিন্দিতে প্রচলিত আছে, ‘আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা’। অর্থাৎ নিজের রুচি অনুযায়ী খাও আর পরের পছন্দ মতো পোশাক পরো। যেদিন থেকে বাজার অর্থনীতি হিন্দি ভাষার দিকে ঝুঁকেছে, সেদিন থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর বিপর্যয় নেমে এসেছে। অনেকে বলেছেন, এই কারণে অনেক বাঙালি নিজের রুচি বদল করে পিৎজা, বিরিয়ানিকে সঙ্গী করেছে। ট্র্যাডিশনাল সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে অনেক বাঙালিই রিয়ালিটি শোয়ের দিকে ঝুঁকেছে। হিন্দি নাচা-গানাই এখন বহু টিন-এজ বাঙালির জাতীয় সম্পদ। ভাষার ক্ষেত্রে অযাচিতভাবে হিন্দি শব্দের অনুপ্রবেশই শুধু হয়নি, বাংলা ভাষাকে হিন্দির অনুরূপ করে ফেলেছে অনেক বাঙালিই। রবীন্দ্রনাথ তো কবেই বলেছেন, ‘আধুনিকতা সময় নিয়ে নয়, মর্জি নিয়ে।’ নতুন কিছুকে স্বাগত জানানোর মধ্যেই তো লুকিয়ে রয়েছে আধুনিকতা। কথাটা একদমই ঠিক। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয় মদতে হিন্দি ভাষা যখন নিজের লক্ষ্যে পৌঁছনোর চেষ্টা করে তখন অন্য সংস্কৃতি, অন্য ভাষা গুরুত্বহীন হয়ে যায়। ইংরেজি, আরবি, ফারসি, পর্তুগিজ ইত্যাদি ভাষা থেকে অসংখ্য শব্দ একসময় বাংলা ভাষায় এসেছে। সেগুলি বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছে। এখন অনেক বাঙালিই নিজস্ব সংস্কৃতি আত্মস্থ না করে ‘Hi’, ‘Hello’ ইত্যাদি শব্দের অযাচিত ব্যবহারে বাংলাকে পীড়িত করছে।
বৌদ্ধ কবিদের লেখা চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বহুবার বাংলা ভাষার বাঁক বদল হয়েছে। আধুনিককালে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ এই বাঁক বদলে হাত লাগিয়েছেন। সেই বদল ছিল আধুনিক। এই আধুনিকতা বাঙালি হারাতে বসেছে। অনেকের মতে, নাগরিক মনন না বুঝে বাঙালিয়ানা নিয়ে নাচানাচি করার ফলে নিজের শেকড় নিজেই কেটে চলেছে তারা। অন্তর্নিহিত আন্তর্জাতিকতা থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে বাংলা ভাষা। কারণ বর্তমান বাজার অর্থনীতি বাংলা ভাষার টিকে থাকার জন্য পরিকাঠামো দিতে অপারগ। তাই বাংলা ভাষার বাণিজ্যিক বা প্রশাসনিক প্রয়োগের ব্যাপারে অন্য রাজ্যের কথা বাদই দিলাম, খোদ পশ্চিমবঙ্গেই নেই। তবুও বাংলা ভাষা বেঁচে আছে। তার একমাত্র কারণ এই ভাষার কথ্য ও লেখ্য দুটি রূপই বর্তমান। নিজস্ব বর্ণমালা আছে। আছে নিজস্ব লিপিপদ্ধতি। সঙ্গে রয়েছে সমৃদ্ধ শব্দভাণ্ডার। তাই তো বইমেলায় বাংলা বই কেনার জন্য ভিড় উপচে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের গানের কথা বা সুরের বিকৃতি করলে সোচ্চার প্রতিবাদ হয়। তখন মনে হয়, বাংলা ভাষা বেঁচে আছে। থাকবেও।
ছবি: লেখক