পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
গুড মর্নিং স্যর, হ্যাপি বেঙ্গলি নিউ ইয়ার।
আমি—আজকের এই শুভ দিনে তো ‘শুভ নববর্ষ’ বলতে পারতেন! শুনতে মিষ্টি লাগে, বলতেও।
চণ্ডীবাবু—আরে আমিও তো তাই চাই। মিষ্টি মিষ্টি সম্পর্ক। অনেকটা আপনার আর আমার বন্ধুত্বের মতোই। ইংরেজি আর বাংলা ভাষা হাত ধরাধরি করে চলবে, সাহিত্য করবে, গান করবে, নাটক করবে—আহা একটা বেশ ব্যাপারের মতো ব্যাপার।
আমি—হ্যাঁ, তা হয়তো ঠিকই। তবে এখন বেশিরভাগ শিক্ষিত বাঙালি তো বাংলাটাই ঠিকঠাক করে বলতে পারেন না। অনেকে আবার বলতে চানও না। একটা অদ্ভুত মিশ্র ভাষায় কথা বলেন। খেলোয়াড়,অভিনেতাদের সাক্ষাৎকারগুলি শুনেছেন তো! প্রায় সবাই এই মিশ্র ভাষায় কথা বলেন। আর টিভিতে এইসব দেখেশুনে পাড়ায় পাড়ায় ছেলেমেয়েদের মধ্যেও হিড়িক পড়ে গিয়েছে এইভাবে কথা বলার। আসলে অদ্ভুতভাবে বাংলা বলে নিজেকে একটু হটকে দেখানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছেন অনেকে।
চণ্ডীবাবু—কী আর করবেন বলুন? এই ফ্যাশনের বয়সটারও তো শতবর্ষ হয়ে গেল। এবার তো উদ্যাপন করা দরকার।
আমি—মানে?
চণ্ডীবাবু—এই সেদিন একটা লেখা পড়ছিলাম। সেখানে একটি বিখ্যাত পত্রিকার ১৯৩৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংখ্যার সম্পাদকীয়টি রেফার হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাতে কী লেখা হয়েছিল জানেন—‘মাতৃভাষায় কথা বলিতে শিক্ষিত বাঙালি পারে না। সে যে শিক্ষিত, তাহা ইংরেজি মেশানো বাঙলা বলিয়া প্রকাশ করে। ইংরেজি শিক্ষিত এমন বাঙালি অতি অল্পই দেখিয়াছি, যাঁহারা পরস্পরের সহিত সম্পূর্ণ বাঙলায় কথা বলেন। মিশ্র ভাষায় কথা বলাটা যেন সভ্যতার লক্ষণ হইয়া দাঁড়াইয়াছে।’ তাহলে কী দাঁড়াল, শতবর্ষ হচ্ছে কি না? চলুন, একটা উৎসব লাগিয়ে দেওয়া যাক। একটা মিটিং ডাকুন। ছোট্ট একটা কার্যকরী কমিটি। আপনি আহ্বায়ক। এর সঙ্গে দরকার একটা বেশ ক্যাচি নাম। এই যেমন ধরুন, ‘বাঙালির মিশ্রভাষার শতবর্ষ উদযাপন উৎসব।’কেমন হবে বলুন তো? একটু ভাবুন। তারপর ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে সদস্যপদের জন্য আহ্বান। উফ্ফ...জমে যাবে, জমে যাবে। চারদিকে একটা হই হই, রই রই পড়ে যাবে।
চণ্ডীবাবু এরকমই। চায়ের দোকানে এসে আমাকে দেখলেই ওঁনার মাথায় নানান বিষয় নড়েচড়ে ওঠে। তারপর তর্ক-বিতর্ক। মাঝে মাঝে একটু গরমাগরমও হয়। যাঁরা সে সময় উপস্থিত থাকেন, তাঁরাও বেশ উপভোগ করেন। কেউ কেউ আবার মাঝেমধ্যে কিছু কিছু মন্তব্যও ছুড়ে দেন।
আর রয়েছে ‘বাচ্চা’ গোপাল। আমাদের যাঁর যেরকম চা পছন্দের, সেটা বেশ ভালো মনে রাখে। আর নানান হিন্দি সিনেমার গান নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়ে গাইতে থাকে। সেই গান গাইতে গাইতেই হাজির হয় চা নিয়ে। এই যেমন এখন, গান শোনা যাচ্ছে গোপালের গলায়— ‘চাহিয়ে, গরম চায়, থোড়া চায় চাহিয়ে...।’
গানটা শুনতে শুনতেই মাথায় একটা ভাবনা ঘুরছিল।
আমি—এখন বাংলা ভাষা তো বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দি, তিনটি ভাষার মিশ্রণ হয়ে উঠেছে।
গোপাল—(আমাদের হাতে চায়ের কাপ দিতে দিতে) পিজিয়ে, গরম চায়ে, গরম চায়ে পিজিয়ে...।
গান গাইতে গাইতে বাচ্চা চলে যেতেই মুখচেনা জনৈক ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ‘তা চণ্ডীবাবু এই মিশ্র ভাষাটির বয়স কত হল? এটা কি আপনার সমবয়সি?’
সেকথা শুনে সমস্বরে হেসে উঠলেন সবাই। চণ্ডীবাবু একটু দমে গিয়ে বললেন, শুনুন, শুনুন। ১৯৩৭ সালে এখানে যে বাংলা সরকার তৈরি হয়েছিল, তার আইনসভায় প্রায় প্রথম থেকেই অনেক সদস্য বাংলা ভাষায় বক্তব্য রাখতে আরম্ভ করেছিলেন।
আমি—ঠিকই। তবে সেই বক্তব্য তো বাংলায় লিপিবদ্ধ করা হতো না। ইংরেজিতে অনুবাদ করা হতো। এমনকী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকেও অধ্যক্ষ বলেছিলেন,‘মি. দত্ত, ইউ মাস্ট স্পিক ইন ইংলিশ।’
চণ্ডীবাবু—কিন্তু তাতে কি আইনসভার সদস্যরা দমে গিয়েছিলেন? বরং ক্রমশ বাংলা ভাষায় বক্তার সংখ্যা বাড়তে থাকায় বাংলা ভাষা ও বাংলা হরফে তা লিপিবদ্ধ করার কাজও শুরু হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, ইংরেজিতে বলতে গিয়ে কেউ যদি একটু আটকে যেতেন, তখনই অন্য বাঙালি সদস্যরাই হাসাহাসি করতেন। শুধু তাই নয়, ‘বাংলায় বলুন, বাংলায় বলুন’ চিৎকারও জুড়ে দিতেন।
আমি—হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। সেদিনই অধ্যক্ষ মহাশয় বলেছিলেন যে বাংলাতে বলতে না দিলে আইনসভার বিতর্কগুলিও ঠিক বিতর্ক হয়ে ওঠে না। সবাই অংশগ্রহণ করবেন, তবেই না ঠিকঠাক বিতর্ক হবে। কিন্তু উনি অপারগ। একদিকে ভারত সরকারের আইন আর অন্যদিকে বাংলা ভাষায় শর্টহ্যান্ড জানা কর্মীর অভাব। আর তা না হলে উনি বাংলায় বক্তব্য রাখার ক্ষেত্রে বরং উৎসাহই দিতেন।
চণ্ডীবাবু—এই একটা মোক্ষম কথা বলেছেন। ৮ জুলাই, ১৯৪৩—অর্থাৎ পরাধীন ভারতের আইনসভায় দেওয়া সেই জবাব কিন্তু স্বাধীন ভারতের স্বাধীন বাংলার বিধানসভায় বোধহয় এখনও দেওয়া হয়।
আমি—হ্যাঁ। এমনকী স্বাধীন বাংলার বিধানসভায় বাংলা ভাষায় আলোচিত বিষয়গুলি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পাঠানো হতো না। এনিয়ে প্রশ্ন করাতে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘উই হ্যাভ নো ফান্ডস টু ট্রানস্লেট দ্যাট।’ অন্যদিকে, ‘পশ্চিমবঙ্গের স্বাধীনতার চতুর্থ বার্ষিকী’ উদ্যাপন করার জন্য এবং এই সময়কালে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কাজ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য ২ হাজার কপি পুস্তিকা ছাপানো হয়েছিল। এবং তা হয়েছিল ইংরেজি ভাষায় (২৪ সেপ্টেম্বর,১৯৫১)। আর বাংলা ভাষা নিয়ে প্রশ্ন করলেই সেই ৮ জুলাই,১৯৪৩ সালের উত্তরের ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। যেমন, ১৯৫৮ সালে জ্যোতি বসুর প্রশ্নের উত্তরে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বলেছিলেন, ‘বাংলা স্টেনোগ্রাফার, টাইপিস্ট আর টাইপরাইটারের অভাব।’ তার ২১ বছর পর ১৯৭৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। এবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি বললেন, ‘টাইপিস্ট, স্টেনোগ্রাফারের সমস্যা আছে।’ কিন্তু ১৩৮৬ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ জ্যোতি বসু ঘোষণা করলেন, ‘এদিন থেকে রাজ্য সরকারের সমস্ত কাজকর্মে বাংলা চালু হয়েছে।’ এরও ২২ বছর পরে ১৪০৮ সালের ১লা বৈশাখে ফের বলা হল, ‘এদিন থেকে পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনিক কাজকর্ম বাংলা ভাষায় চালু করা হচ্ছে।’
চণ্ডীবাবু—আজও ১লা বৈশাখ। আরও ২৩টা বছর!
জনৈক ভদ্রলোক—আরে মশাই কেবল ‘বাংলা চাই, বাংলা চাই’ বলে চিৎকার করলেই তো আর হয় না! উপযুক্ত পরিভাষা কোথায়? সেই সময়টা তো দিতে হবে।
আমি—জানেন কি, স্বাধীনতার ঠিক পরেই, মানে সেই ১৯৪৭ সালেই বাংলা ভাষা প্রচলনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আর ১৩৫৫ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখেই মানে ১৯৪৮ সালে এই ‘পরিভাষা সংসদ’ তার প্রথম ‘স্তবক’ প্রকাশ করে?
জনৈক ভদ্রলোক —প্রথম স্তবক! মানে? ঠিক বুঝতে পারলাম না।
আমি—মানে ‘প্রথম খণ্ড।’ এবং তারপর থেকে ২১ বছর ধরে ২৭ জুলাই, ১৯৬৯ অবধি আরও পাঁচটি পরিভাষা স্তবক মানে পাঁচ খণ্ড বই প্রকাশিত হয়।
জনৈক ভদ্রলোক—তা সরাসরি প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় খণ্ড না বলে প্রথম স্তবক, দ্বিতীয় স্তবক বলার মানে কী?
আমি—প্রথম খণ্ডের ভূমিকায় তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে যে কেন ‘অধিক মাত্রায়’ সংস্কৃত ভাষার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। ফলে সরকারি আধিকারিক বা সাধারণ মানুষ, কেউই এই পরিভাষা ব্যবহার করতেই পারলেন না। এবার পুরো বিষয়টা একসঙ্গে ভাবুন। প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে বাদ দিলে তার পরের সব মুখ্যমন্ত্রীরাই, তা সে যে রাজনৈতিক দলেরই হোক না কেন, কখনও টাইপরাইটার, টাইপিস্ট আর শর্টহ্যান্ড প্রশিক্ষিত কর্মী না থাকার অজুহাতে বা কখনও অর্থের অভাবের অজুহাতে বাংলা ভাষাকে সর্বস্তরের প্রশাসনিক ভাষার মর্যাদা দিল না। আর তার সঙ্গে রয়েছে পিলে চমকে যাবার মতো পরিভাষা। অতএব আমার-আপনার মতো শিক্ষিত কর্মচারী এবং আধিকারিকরা যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ ইংরেজি ভাষাতেই চালিয়ে যাচ্ছেন। আর সাধারণ মানুষরা সেসব কিছুই বুঝতে না পেরে ভোট ছাড়া আর কোনও ক্ষেত্রেই সরাসরি সরকারের সিদ্ধান্তে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। শুধু ভয় পাচ্ছেন।
চণ্ডীবাবু—আরে, সেই কথাটাই তো প্রথম থেকে বলছি। ইংরেজি-বাংলা ভাই-ভাই।
আমি—ভাই-ভাই আর হলাম কোথায়! সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা সবাই এই স্বাধীন ভারতের তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। যাঁরা ইংরেজি জানেন, তাঁরা প্রথম শ্রেণি, যাঁরা হিন্দি জানেন, তাঁরা দ্বিতীয় আর অবশিষ্ট সব ভাষাগোষ্ঠীর নাগরিকরা তৃতীয় শ্রেণির।
জনৈক ভদ্রলোক —‘হিন্দি’ দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যাপারটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে এসব কথা বলা কি ঠিক? একটা দেশ, তার একটা নাম থাকবে, পতাকা থাকবে, ধর্ম থাকবে, ভাষা থাকবে—এটাই তো স্বাভাবিক।
চণ্ডীবাবু—আপনার এই মন্তব্য বড়ই আপত্তিকর। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড একটা দেশের সীমারেখা। তার একটা নাম অবশ্যই থাকবে। স্বাধীনতার চিহ্ন হিসেবে একটা পতাকাও থাকবে। কিন্তু দেশ তো মানুষের। তাদের সবার এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক ধর্ম, বিনোদন, খেলাধূলা, পোশাক পরিচ্ছদ—সবকিছুই কি এক হতে পারে? মানুষ কি ফ্যাক্টরি প্রোডাক্ট যে সবাই এক রকম হবে? বৈচিত্র্যই তো বৈশিষ্ট্য। সেটাই স্বাভাবিক। আপনার মতামতটা নয়।
বছরের প্রথম দিন। পরিবেশটা একটু গম্ভীর হয়ে ওঠার দিকেই যাচ্ছিল। কিন্তু বাঁচিয়ে দিল গোপাল। কাপ নিতে এসেই একটা ডায়লগ ঝেড়ে দিল— ‘আরে সাহেব, টেনশন লেনে কা নেহি, দেনে কা হ্যায়।’ আরও কিছু হয়তো বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ধমক দেওয়ায় কাপ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফিচেল হেসে চলে গেল। আর এই ফাঁকে আমি ঢুকে পড়লাম আলোচনায়।
আমি—আসলে কী জানেন, ২০১১ সালের শেষ সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২৬.৬১ শতাংশ নাগরিক হিন্দি ভাষাকে তাঁদের মাতৃভাষা বলে ঘোষণা করেছেন।
জনৈক ভদ্রলোক—কী যে বলেন! ভারতের অর্ধেকের বেশি জনগণের ভাষা হল হিন্দি।
আমি—আপনি ঠিকই বলছেন। ২০১১ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, হিন্দিকে মাতৃভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন মাত্র ২৬.৬১ শতাংশ ভারতীয়। তবে এর সঙ্গে আরও ৫৫টি মাতৃভাষা এবং প্রায় দেড় কোটি অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠীর নাগরিকদের যুক্ত করে ৪৩.৬৩ শতাংশ করে দেওয়া হল। তারপর আরও নানান ফন্দি-ফিকির করে আরও বাড়িয়ে দেখানো হল।
চণ্ডীবাবু—সত্যিই অবাক লাগে। ওপার বাংলায় ভাষার জন্য বাঙালি প্রাণ দিচ্ছেন। আর এপার বাংলায় বাঙালি জনপ্রতিনিধিদের কেউ বলছেন তাঁকে রাষ্ট্র ভাষায় বক্তব্য রাখতে দেওয়া হোক, তো কেউ বলছেন হিন্দি না শিখলে পিছিয়ে পড়তে হবে। সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!!
জনৈক ভদ্রলোক—ঠিকই তো বলেছেন। রাষ্ট্রভাষাতে কথা তো বলতেই হবে। আর সবাইকে জানতেও হবে।
চণ্ডীবাবু—আরে দূর মশাই, ভারতে ইংরেজি আর হিন্দি—দুটোই তো সরকারি যোগাযোগের ভাষা। রাষ্ট্রভাষা কোথায়! তা যাঁরা সরকারিভাবে যোগাযোগ করবেন, তাঁরা তাঁদের সুবিধামতো ভাষা ব্যবহার করবেন। জবরদস্তি করার কী আছে? তবে কে কার কথা শোনে! ১৯৪৯ সালের ভাষা বিতর্কটা একবার সার্চ করে দেখুন, পড়ুন। দেখবেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথাও সেদিন মানা হয়নি। আমরা তো কোন ছাড়!
আমি—যাকগে, যাকগে। এই জন্যই বলেছিলাম যে আমরা সবাই তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক। বিষয়টা তো পুরোপুরি রাজনৈতিক। ভারতের মাত্র পাঁচ- ছ’টি রাজ্যের তথাকথিত হিন্দিভাষীর জনসংখ্যাই তো ভারতের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। অতএব এঁদের সুযোগ-সুবিধা দিলে পরে দিল্লির মসনদ বেশি দূরে থাকে না।
চণ্ডীবাবু—তা বটে। আর আমাদের এখানে বাংলার সরকার বাঙালিদের অধিকার রক্ষায় যদি কোনও উদ্যোগ নেয়, তখনই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, কীভাবে সেই উদ্যোগকে আটকে দেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে ধর্মকেও হাতিয়ার করতেও পিছপা হন না তাঁরা। এই দেখুন না, এই বাংলাতেই ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় বা শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে বাধ্যতামূলক করা যাবে না। পশ্চিমবঙ্গের নাম পাল্টে ‘বাংলা’ করার স্বীকৃতি আজও পর্যন্ত এল না। আমরা নাকি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা, এই বাংলা পৃথিবীর ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা, আমাদের বাংলা ভাষা নাকি পৃথিবীর মধুরতম ভাষা!! ধুত্তেরি, ঘেন্না ধরে গেল মশাই!
আমি—আরে না না। ঘেন্না ধরার তো কিছু নেই। সেই যে কবে কবি বলেছেন, ‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?’ যাই হোক, আপনি তো বললেন ‘বাংলা মিশ্র ভাষার শতবর্ষ’ উদযাপন করবেন। ব্যস, হয়ে গেল...কত নাচা-গানা হবে, কত কবি কবিতা পড়বেন, আবৃত্তি হবে, নাটক হবে। আনন্দ ধারা বহিছে ভুবনে।...মন খারাপ করলে চলবে? সব হবে, সব হচ্ছেও। শুধু আমাদের মাতৃভাষাটা আমাদের জীবন-জীবিকার ভাষা হয়ে উঠছে না!
চণ্ডীবাবু—আপনি কি ওটা সিরিয়াসলি নিলেন নাকি? জানেনই তো, আপনাকে দেখলেই আমার কেমন যেন একটা তর্ক-বিতর্ক জুড়ে দিতে ইচ্ছে করে। এটা তো একটা রসিকতা। সত্যিই সবাই যদি নিজের নিজের মাতৃভাষায় আর ইংরেজিতে চৌখস হয়ে উঠতে পারতেন, তাহলে দেশীয় ক্ষেত্রেই হোক বা আন্তর্জাতিক—ভারতবাসীকে কেউ আটকাতে পারত না। তবে রাজনীতির কারবারিদের খুব অসুবিধা হতো। সমস্যার সমাধান হয়ে গেলে চলবে কীভাবে? ওটাকে তো বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আর ভোটের আগে ‘দিচ্ছি, দেব’ করে যেতেই হবে। দেশকে নিয়ে কে আর ভাবছে বলুন! পুরো দেশটাই তো এখন নানান পার্টি অফিসের সমষ্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দূর থেকে ভেসে আসছে গোপালের গলা, ‘লুটে লে, লুটে লে, আও,আও, লুটে লে ...।’
গোপাল—অনেক ঝাড়াঝাড়ি হল। আজকে শুভ নববর্ষের দিনে আরও এক রাউন্ড চা হবে নাকি স্যর?
আমি—নিয়ে আয়, নিয়ে আয়। দেরি করবি না। আজ আবার বাড়িতে অনেক কাজ।
সেই ভদ্রলোক উঠে চলে যাচ্ছিলেন। চণ্ডীবাবুই হাত ধরে বসালেন।
চণ্ডীবাবু—আরে মশাই, একটু বসে যান। আরেকবার না হয় ‘চা-টা’ খেয়েই যান। চায়ের কিন্তু ফিউচার আছে। আর তার ‘গ্যারান্টি’ও আছে।