সাংগঠনিক কর্মে বড় সাফল্য পেতে পারেন। উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের জোরে কার্যোদ্ধার। বিদ্যায় সাফল্য। ... বিশদ
ব্রিটিশ সরকার প্রাণপণে চাইছে হারানো জমি ফিরে পেতে। বার্মার আরাকান এলাকায় আবার আক্রমণের চেষ্টাও করা হল কয়েকবার। কিন্তু লাভ হয়নি। জাপানি সেনার হাতে ফের পরাস্ত হতে হয়েছে। পিছু হটল ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা। এবার কী করা হবে? সুযোগের অপেক্ষা? ১৯৪৩ সালের প্রথমার্ধে এরকম বারকয়েক ধাক্কা খাওয়ার পর ব্রিটিশ সামান্য বিরতি দিল। অন্য ফ্রন্টে অক্ষশক্তির দুর্বল হওয়ার অপেক্ষা। দেখা যাক। তবে সামরিক বাহিনীকে বদল করা দরকার। একটু ডায়নামিক কোনও অফিসার এলে হয়তো প্ল্যানিং বদলে যেতে পারে। অনেক ভেবে লন্ডনে থাকা ওয়ার ক্যাবিনেট স্থির করল, উইলিয়ম স্লিমকে বর্মায় থাকা ফোর্সের জেনারেল করা যেতে পারে। সেটাই হল। উইলিয়ম স্লিম হলেন প্রথমে বার্মার ফোর্সের জেনারেল। তারপর ফোরটিন্থ আর্মির কমান্ডার। এবং ক্রমেই বার্মার গোটা ফোর্সের চিফ কমান্ডার।
সমস্যা হল, এরপর কী সেটা জাপানী ফোর্স স্থির করতে পারছে না। অথাৎ আরাকান দখল হয়েছে। এবার পরবর্তী পদক্ষেপ কী? মালয়, সিঙ্গাপুর, বার্মা, একের পর এক এলাকা ব্রিটিশদের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জাপানীরা দুটি বিষয়ে নিশ্চিত। তারা জঙ্গল যুদ্ধে অনেক অভিজ্ঞ হয়েছে। আর দ্বিতীয়ত এই তিনটি এলাকা দখলের সময়ই বোঝা গিয়েছে ব্রিটিশ যোদ্ধারা এখনও এই নদী আর জঙ্গলের ওয়ারফেয়ারে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারেনি। অতএব সবথেকে যা বিপজ্জনক সেটাই গ্রাস করছে ক্রমেই জাপানকে। সেটি হল, অতি আত্মবিশ্বাস! জেনারেল রেনে মুতাগুচ্চি জাপানের ফিফটিন্থ আর্মির কমান্ডার। তিনি সর্বাধিক সাহসী ও আত্মবিশ্বাস। বার্মা ফ্রন্ট থেকে ইন্ডিয়ায় অ্যাটাক করার প্ল্যান নিয়ে যখন একাধিকবার প্ল্যান বদল, স্থগিত, বাতিল আবাব বদল এবং বিরতি ইত্যাদি সিদ্ধান্তহীনতা চলতেই থাকছে, তখন একমাত্র জেনারেল মুতাগুচ্চি বললেন, সাপ্লাই, কমিউনিকেশন সমস্যা, আকাশযুদ্ধে মিত্রশক্তি এগিয়ে, বর্ষা আসছে, এসব নিয়ে বেশি ভাবলে আমাদের সাম্রাজ্যকে আর সম্প্রসারিত করতে পারব না। অতএব এই সমস্যাগুলির আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও তিনি চান বার্মা থেকে বর্ডার ক্রস করে ভারতে ঢুকতে। কী করা উচিত? ঠিক সেই সময় প্রধানমন্ত্রী তোজোর বার্তা এল। তিনি চাইছেন সীমান্ত পেরনোই হোক। তাঁর কাছে যা ইনটেলিজেন্স রিপোর্ট আছে, সেটা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এখন মিত্রশক্তির জাপানী ফোর্সকে প্রতিহত করার মতো নিপূণ প্রশিক্ষণ নেই। সময় লাগবে ট্রেনিংএ। অতএব এটাই সময়!
সুভাষচন্দ্র বসু সবদিক থেকে তৈরি। কিন্তু তাঁর একটা সন্দেহ হচ্ছে। জাপানীদের নিয়ে। তাঁর বাহিনীর প্রধানদের থেকেও রিপোর্ট পাচ্ছেন। সমস্যা সেই একই। জার্মানীর সঙ্গে যা হয়েছিল। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ ফৌজকে জাপান মিলিটারি যুদ্ধের সঙ্গী হিসেবে পরিচয় দিতে যেন দ্বিধাগ্রস্ত। জাপানের সিংহভাগ অংশের মনোভাব অনেকটা যেন আজাদ হিন্দ বাহিনী তাদের অনুগত। কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর মতো মানুষ এই মনোভাব মানবেন কেন? তাঁর সাফল শর্ত, ভারতে যে কোনওরকম অভিযান যখন হবে, তখন ব্রিটিশদের পরাস্ত করে যে অঞ্চলই দখল করা হোক, সেটা আজাদ হিন্দ সরকারের অধীনে হবে। জাপানের নয়। ১৯৪৪ সালে সুভাষচন্দ্র তাঁর সরকার ও বাহিনীর সদর দপ্তর নিয়ে গেলেন রেঙ্গুন।
তার আগে ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবরই গঠন করা হয়ে গিয়েছে প্রভিশনাল গভর্ণমেন্ট অফ আজাদ হিন্দ। প্রথম স্বাধীন ভারত সরকার। পাঁচজন মন্ত্রী। আজাদ হিন্দ ফৌজের ৮ জন সমস্য সরকারে আছেন। সরকারে প্রধানমন্ত্রীর নাম সুভাষচন্দ্র বসু। যুদ্ধ ও বিদেশনীতি সংক্রান্ত মন্ত্রকও তাঁর অধীনে। অর্থমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট কর্নে.ল এ সি চ্যাটার্জি। জার্মানী, ইতালি, ক্রোয়েশিয়া, মাঞ্চুকুয়ো, নানকিং, ফিলিপাইনস, থাইল্যান্ড বার্মার পক্ষ থেকে এসেছে সরকারের স্বীকৃতি।
জাপান রাজি হয়েছে ভারত আক্রমণে। যে কোনও সময়। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের কাছে সবথেকে বড় শঙ্কা হল, সাপ্লাই। খাবার, ওষুধ আর চিকিৎসা সরঞ্জাম পর্যাপ্ত নেই। বোঝাই যাচ্ছে। একবার সরাসরি যুদ্ধে প্রবেশ করলে কীভাবে সম্ভব এই সমস্যাগুলির সমাধান? রেঙ্গুনের স্থায়ী বাসিন্দা জোরা সিং রাজি হলেন। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে যে বাহিনী বার্মায় এসেছে, তাদের খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করবেন জোরা সিং। কিন্তু একার পক্ষে কি করা সম্ভব এত মানুষের খাদ্য সংগ্রহ? সিঙ্গাপুর থেকে আসছে কিছু সাপ্লাই। কিন্তু যথেষ্ট নয়। আর ওষুধের আকাল এতটাই যে, কালোবাজারে সোনার বিনিময়ে যোগাড় করতে হচ্ছে ওষুধ। কে দিল সেনা? প্রবাসী ও স্বদেশী ভারতীয়েরা যখন যেমন যেভাবে পেরেছেন সহায়তা করছেন তাঁদের নয়নের মণি সুভাষচন্দ্রকে।
জাপানের কমান্ডার মুতাগুচ্চিকে সুভাষচন্দ্র বললেন, একবার জাপানী বাহিনী যদি ভারতে প্রবেশ যায় এবং আজাদ হিন্দ বাহিনীকে সামনে অগ্রসর হতে সাহায্য করে, তাহলে ভারতের মানুষ এবং ব্রিটিশ ভারতীয় সেনায় থাকা ভারতীয় সেনা ও অফিসাররা কিন্তু তৎক্ষণাৎ আজাদ হিন্দ বাহিনীর দিকেই চলে আসবে। সেই বিশ্বাস আছে। সেটা অবিশ্বাস করার কারণ নেই। কিন্তু মুতাগুচ্চির বাহিনীর বৈঠকে আলোচনা করা হল, ব্রিটিশ শক্তি অন্তত দেড় লক্ষ। আজাদ হিন্দ বাহিনীর এই মুহূর্তে যারা সীমান্ত ক্রস করবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি হলে ৮ থেকে ১০ হাজার। ভারতের যে এলাকা দখল করা হবে, সেটা কি ধরে রাখা সম্ভব হবে? তার থেকে বরং আজাদ হিন্দ বাহিনীকে নিছক প্রচার এবং প্রোপাগান্ডার ভূমিকা দেওয়া হোক এখন। রাজি নন সুভাষচন্দ্র। তিনি দুই পক্ষের সমান মর্যাদা।
ফিল্ড মার্শাল কাউন্ট তেরৌচি রাজি হলেন। তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীকে সঙ্গে নিতে রাজি। ১০ হাজার আজাদ বাহিনীকে তিনটি রেজিমেন্টে বিভাজিত করা হল। আজাদ হিন্দের বাহাদুর গ্রুপ (স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপ) বার্মা সীমান্ত ছাড়িয়ে মণিপুরের দিকে অগ্রসর হবে। তারা পথ দেখাবে জাপানী সেনাকে। এভাবেই সমান মর্যাদা, সম্মান এবং লড়াইয়ের স্বীকৃতি আদায় করলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বের এক মহাশক্তিমান রাষ্ট্রের কাছে। সামান্য নত না হয়ে।
আজাদ হিন্দের প্রথম গেরিলা রেজিমেন্ট রেঙ্গুন ছেড়ে অগ্রসর হল ফেব্রুয়ারিতে। যাবে প্রোম। সেখান থেকে চিন হিলস। বাধা এল কমনওয়েলথ আফ্রিকান ইউনিটের কাছ। তুমুল যুদ্ধ। কিন্তু কমনওয়েলথ ইউনিট পরাস্ত হল। এই ইউনিট এরপর চট্টগ্রামের কাছে থাকা মোডক দখল করবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যাটেলিয়নের নেতৃত্বে কর্ণেল শাহ নওয়াজ খান। সেই বাহিনী টপকে গেল ছিন্দউইন নদী। এভাবে তারা একা নয়। এএকর পর এক ইউনিট ওই নদী ক্রস করে গেল। আর তারপর সূত্রপাত সেই মহাসন্ধিক্ষণের। বার্মা সীমান্ত থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর ভারত প্রবেশ। ১৮ মার্চ।
এই পজিশন থেকে দ্বিতীয় ব্যাটেলিয়নের একটি ইউনিট সরে গেল ফালামের দিকে। আর অন্য একটি বাহিনী হাকা অভিমুখে। আর তৃতীয় ব্যাটেলিয়ন ততদিনে ফোর্ট হোয়াইট টোনজাং অভিমুখে গিয়েছে। এই তিন এলাকা থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর শুরু হয়ে গেল সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। অ্যামবুশ, হিট অ্যান্ড রান এবং গেরিলা ওয়ারফেয়ার। যা ব্রিটিশ সেনাকে চরম নাজেহাল করল। মুতাগুচ্চির তিনটি ডিভিশন ইম্ফল দখলের দিকে অগ্রসর হয়েছে। তাদের সঙ্গে আজাদ হিন্দ বাহিনীর একটি ফোর্স।
দ্বিতীয় রেজিমেন্ট একইভাবে একটি কাজ করল। ছিন্দউইন নদী ক্রস করে তারা চলে গেল টামুর দিকে। হঠাৎ জানা গেল, পালেল এয়ারফিল্ডে জাপানী কমান্ডার ইয়ামামোতোর বাহিনী আক্রমণ করবে। আজাদ হিন্দ বাহিনীকে দরকার। কিন্তু ততক্ষণে দ্বিতীয় রেজিমেন্ট বেশ দূরে। বাছাই করা ৩০০ জনের একটি পৃথক বাহিনী তৈরি করা হল। যার নেতৃত্বে থাকবেন মেজর প্রীতম সিং। সেভাবে হাতে ভারী অস্ত্র নেই। বুকে আছে সাহস। পদে পদে বাধা পেতে হল। প্রীতম সিং এর বাহিনী তোয়াক্কা করল না। চরম কাউন্টার অ্যাটাকে ছত্রভঙ্গ হল ব্রিটিশ বাহিনী। কয়েকদিনের যুদ্ধের পর আকাশপথের বোমাবর্ষণে এই বাহিনীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে গেল।
আর সুভাষচন্দ্র বসুর সিক্রেট সার্ভিস গ্রুপ কী করছে? তারা ব্রিটিশ সেনার বন্ধু ও ইনফর্মার সেজে ভারতীয় সেনাদের মধ্যে দেশপ্রেমের আগুন জ্বালাচ্ছে! ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে থাকা বহু ভারতীয় এই গোপন অপারেশনে সাড়াও দিয়েছে। তারা গোপন অভিযানে করেছে ভূমিকা বদল। অর্থাৎ আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দিয়েছে অথবা পরিণত হয়েছে ডাবল এজেন্টে। ব্রিটিশ ভেবেছে এরা তাদের স্পাই। আসলে এরা আজাদ হিন্দের স্পাই!
ইম্ফল, কোহিমা, মৈরং হয়তো বেশিদিন দখলে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ অনেক। খাদ্যাভাব। অস্ত্রাভাব। অসুস্থতা। কিন্তু স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করা সম্ভব হয়েছিল। আবেদন নিবেদন অথবা আলোচনার মাধ্যমে নয়। যুদ্ধের মাধ্যমে। সেই গৌরব নিছক আবেগ ছিল না। ব্রিটিশের অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ভারতীয়রা যে যুদ্ধে তাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে তৈরি ও পারঙ্গম, সেই বার্তা পেয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। অতএব ক্ষমতা হস্তান্তর পর্ব ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা!
১৯৪৪ সালের মার্চ মাসের এই গৌরবগাথাটি ইতিহাস বইয়ের পাশাপাশি ভারতীয়দের হৃদয়ে চিরকালের জন্য স্থাপন করলেন কে? একটি অগ্নিশিখা! নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।