শরীর ভালো যাবে না। সাংসারিক কলহবৃদ্ধি। প্রেমে সফলতা। শত্রুর সঙ্গে সন্তোষজনক সমঝোতা। সন্তানের সাফল্যে মানসিক ... বিশদ
১৯৮৭ সাল। আমি তখন পুনেতে। মিগ-২৯ স্কোয়াড্রনে পোস্টিং। মিগ-২৯ বায়ুসেনায় যুক্ত করা হয় ১৯৮৭ সালেই। এই যুদ্ধবিমানের ন্যাটো নাম হচ্ছে ফ্যালক্রাম। ভারতে এর নাম দেওয়া হয়েছে বাজ। অর্থাৎ বাংলায় বাজপাখি। মিগ-২৯ এর ক্ষিপ্রতা দেখেই এই নাম দেওয়া হয়েছিল। এর দক্ষতা, প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে নিজের কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করা এবং আকাশপথে লড়াইয়ে শত্রুপক্ষকে নিকেশ করার মতো ক্ষমতা অত্যন্ত ভালো। একইসঙ্গে, সর্বাধুনিক রেডার, অত্যাধুনিক অস্ত্রবহনের মতো বিষয়গুলি যুক্ত থাকায় মিগ-২৯ আমাদের শক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। বলা ভালো, এফ-১৬ এর থেকে অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন মিগ-২৯। আর সেজন্যই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে এই যুদ্ধবিমান কেনার প্রস্তাব দেয়। আমি ছিলাম প্রথম ব্যাচে। সোভিয়েতে গিয়ে রীতিমতো প্রশিক্ষণের নেওয়ার পর মিগ-২৯ নিয়ে ভারতে আসি। পুনেতে স্কোয়াড্রন তৈরি করা হয়।
দেশে ফিরে শুরু হয় মিগ-২৯ এর প্রশিক্ষণ। আমাদের স্কোয়াড্রনকে পাঠানো হয় শ্রীনগরে। দুর্গম পার্বত্য এলাকা, সেখানকার আবহাওয়া-পরিবেশের সঙ্গে যাতে মিগ-২৯ ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে, তার দায়িত্ব দেওয়া হয় আমার উপরে। আমি ছিলাম স্কোয়াড্রন লিডার। সময়টা ছিল ১৯৮৭ সালের একদম শেষের দিকে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে হয়তো মিগ-২৯ সেখানে রাখা হতোই। কিন্তু তার আগে এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান কতটা মানিয়ে নিতে পারছে, তা দেখে নেওয়াও প্রয়োজন ছিল।
১৯৮৮ সালের মে মাস। সকাল ১০টা। আমি এবং আমার এক জুনিয়র ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট প্রায় ৮৫০ কিলোমিটার গতিতে বিমান নিয়ে উড়ান শুরু করি। ওই এলাকায় আবহাওয়া খুব দ্রুত বদলে যায়। লে-লাদাখ এলাকায় সিন্ধু নদের উপত্যকা (ইন্দাস ভ্যালি) দিয়ে কিছুটা এগতেই দেখি, মেঘ অনেকটাই নেমে এসেছে। ফলে আমাদেরও কিছুটা নীচ দিয়েই যেতে হচ্ছিল। ১২-১৩ হাজার ফুট উচ্চতার উপত্যকা থেকে মাত্র ৩০০ মিটার উঁচু দিয়ে বিমান নিয়ে যাচ্ছি। যখন দ্রাস সেক্টরে পৌঁছলাম, দেখলাম উপত্যকার পাহাড়গুলি অত্যন্ত ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে। অর্থাৎ, দু’টি পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার জায়গায় অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। মেঘ ঘিরে রেখেছে। আমি সামনের আয়না (রিয়ার ভিউ মিরর) দিয়ে পিছনের বিমানে আসা জুনিয়রকে লক্ষ্য রাখছিলাম। কারণ, ভ্যালি ফ্লাইংয়ে জুনিয়র কোনও সমস্যায় পড়ছে কি না, বা তাঁর নিরাপত্তা আমাদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
সঙ্কীর্ণ রাস্তা এবং মেঘ নীচে নেমে আসা আমরা বিমানটিকে ৩০০ মিটার থেকে নামিয়ে ১০০ মিটারে নিয়ে এলাম। সামান্য অমনোযোগী হলেই মৃত্যু অবধারিত। আবার পথ হারালে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে যাব। সবদিকেই বিপদ। এরপর শুরু ঘন ঘন তুষারপাত। ধীরে ধীরে দৃশ্যমানতা কমতে থাকল। দু’পাশে পাহাড়, মেঘ এবং সঙ্গে অনবরত তুষারপাত। পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে। রিয়ার ভিউ মিরর দিয়ে জুনিয়র পাইলটকে দেখে বুঝতে পারলাম খুব একটা স্বস্তিজনক অবস্থায় ও নেই। কী করবে বুঝতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে ওকে নির্দেশ দিই, বাইরের দিকে না দেখে ককপিটের ইনস্ট্রুমেন্টের দিকে নজর রাখো। সঙ্গে বলি, রি-হিট (ইঞ্জিনের পাওয়ার বাড়ানো) দিতে। যাতে বিমানের গতি বাড়ে। এরপর পিচিং করানোর নির্দেশ দিই। পিচিং অর্থাৎ বিমানকে নাক উঁচু করে উপরের দিকে চালানো। সোজা কথায়, রি-হিটে বিমানটি পিচিং করে সোজা উপরে ওঠাতে হবে। ওকে বলেছিলাম, মেঘ থেকে বেরিয়ে ও যেন আমায় রিপোর্ট করে। প্রায় এক মিনিট পর ওই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জানাল, সে আমার নির্দেশমতো প্রায় ৩০ ডিগ্রি নাক উঁচু করে উপরে চলে এসেছে। মেঘ কাটিয়ে প্রায় ৭ কিলোমিটার উপরে। তিন-চারটি তুষারাবৃত চূড়া দেখতে পাচ্ছে। আমি আমার জুনিয়রের রিপোর্টে খুব খুশি হলাম। বুঝলাম, এখন ও নিরাপদ। ওকে বললাম, যেখানে আছো, সেখানেই চক্কর দাও। ওই ফ্লাইট লেফটেন্যান্টের পথ ধরে আমিও উপরে উঠে এলাম। এরপর দু’জনে একত্র হয়ে শ্রীনগর বায়ুসেনা ছাউনিতে গিয়ে নামলাম।
একটা কথাই শুধু বলতে চাই। এই সঙ্কটপূর্ণ আবওয়ার সঙ্গে দুর্গম পার্বত্য উপত্যকা দিয়ে বিমান ওড়ানো এবং সর্বশেষে সাফল্যের সঙ্গে বেরিয়ে আসা, তা অন্য কোনও ঝুঁকি তুলনায় কোনও অংশেই কম নয়। আরও একটি বিষয়, এধরনের কোনও সঙ্কটে আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ, খুব কম সময় থাকে আমাদের হাতে। যুদ্ধ আর প্রশিক্ষণ—দু’টি ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। কিন্তু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। মিগ-২৯ খুবই অত্যাধুনিক বিমান ছিল। ইঞ্জিনও খুব শক্তিশালী। যে কারণে আমরা সুবিধা পেয়েছিলাম। ঠিক বালাকোটে যেমন মিরাজ ২০০০ সাফল্য পেয়েছে। সর্বশেষে একটা কথা বলতে চাই, কার্গিল লড়াইয়ে মিরাজ ২০০০ শত্রুপক্ষের ঘরে ঢুকে নিকেশ করেছে। আর মিগ-২৯ ছিল সীমান্ত প্রহরায়। এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান পাক বায়ুসেনার এফ-১৬ ভারতের সীমান্ত পেরনোর ক্ষমতা দেখাতে পারেনি।
প্রদীপকুমার চট্টোপাধ্যায় (অবসরপ্রাপ্ত ভাইস অ্যাডমিরাল): স্থলপথে বা আকাশপথে, যুদ্ধ হোক অথবা শত্রুপক্ষকে নিকেশ, এসব প্রকাশ্যে চোখে দেখা যায়। কিন্তু জলের তলায় লড়াই! সেটা হয় সবার নজরের আড়ালেই। যা কোনও কোনও অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ধরা যাক, কোথাও যদি শত্রুপক্ষের সঙ্গে আমাদের আকাশপথে বা স্থলপথে লড়াই হচ্ছে। জেনে রাখুন, জলের তলায় আগে থেকেই আমাদের ডুবোজাহাজ প্রস্তুত রয়েছে। কোনও যুদ্ধ বা লড়াইয়ে ডুবোজাহাজ সবার আগে জলের তলায় দিয়ে সীমান্তে গিয়ে প্রস্তুত থাকে। কিন্তু লড়াই থামার বেশ কয়েক মাস পর সেখান থেকে ফেরত আসে। লড়াই (কনফ্লিক্ট) যদি বড়সড় যুদ্ধে পরিণত হয়, তখনই বোঝা যাবে, ডুবোজাহাজ শত্রুপক্ষের কতটা ক্ষতি করেছে বা জলের তলায় সীমানা রক্ষায় কতটা দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পেরেছে। তবে ‘পিস টাইম’ (শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান) হোক অথবা যুদ্ধের সময়, ডুবোজাহাজ একবার জলে নেমে পড়লে, কেউ জানে না তা কতদিনের জন্য।
ডুবোজাহাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে, সেটা সাবমেরিনের এক জুনিয়র কর্মী হিসেবে হোক বা কমান্ডিং অফিসার হিসেবেই হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই অনুধাবন করেছি। কার্গিল লড়াইয়ে আমি দেশের পশ্চিম উপকূলে সাবমেরিনের কমান্ডিং অফিসার (কম কস) হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম। লড়াই শুরুর পরই আমাকে দেশের নৌসেনা প্রধান নির্দেশ দিয়েছিলেন, তৈরি হোন। সেইমতো আমরা তৈরি হয়ে সাবমেরিন নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। যদিও কার্গিল লড়াইয়ে জলপথে যুদ্ধের কোনও প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি।
সাবমেরিনে জলায় তলায় যখন থাকতাম, তখন আমাদের কাছে দিন বা রাত বলে কিছু থাকত না। রাত বোঝানো হতো সাবমেরিনের ভিতরে লাল আলো জ্বালিয়ে। আবার সকালবেলা নির্দিষ্ট করা হতো অন্য আলো জ্বালিয়ে। আমরা জলের তলায় দিনকে রাত এবং রাতকে দিন ধরে সময় নির্দিষ্ট করতাম। কারণ, রাতের বেলাতেই সতর্কতা বেশি থাকে। আমাদের যদি কোনও অপারেশন থাকে, সেটা আমরা সেই সময়ই করে থাকি। তাই রাতের সময়টা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এখন অনেক কিছুতেই দেখানো হয়, জলের তলায় ডুবোজাহাজ থেকে বাইরের অনেক কিছু দেখা যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল। ডুবোজাহাজ নিয়ন্ত্রিত সম্পূর্ণ উন্নত ইনারশিয়াল নেভিগেশন প্রযুক্তিতে। বর্তমানে যত আধুনিক ডুবোজাহাজ তৈরি হচ্ছে, তার নেভিগেশন ব্যবস্থা ততই উন্নত। জলের তলায় আমাদের সর্বক্ষণ চোখ-কান খোলা রাখতে হতো। কারণ সামান্য ভুলত্রুটিতেই হতে পারে বিপদ। সেটা দেশের পক্ষে ভালো নয়। তাই উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমেই শত্রুপক্ষের বিচরণ নজরদারিতে রাখা হয়। আর একটা কথা বলতে চাই। সাবমেরিন কখনও জোরে যায় না। কারণ, জলের এতটাই গভীরে থাকে ডুবোজাহাজ, যদি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চললে তার ব্যাটারির চার্জ শেষ হয়ে যায়। অ্যাকশন এরিয়ায় থাকলে সবদিক থেকে তৈরি থাকতে হয়।
আমি ১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি ভারতীয় নৌসেনায় যোগ দিই। ১৯৭৮ সালে সাবমেরিনে জুনিয়র অফিসার হিসেবে যোগ। সেই যোগ দিয়ে আমি পর পর চারটি রাশিয়ান সাবমেরিনে বিভিন্ন পদে কাজ করি। ১৯৮৪ সালে অক্টোবর মাসে জার্মানি গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের প্রশিক্ষণ হয়। কোনও ডুবোজাহাজ নৌবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার আগে একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে। জার্মানি থেকে আমরা ১৯৮৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘আইএনএস শিশুমার’ সাবমেরিন নিয়ে ভারতে ফিরি। তারপরই আমাকে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। দু’-তিনমাস পরই চলে গেলাম অপারেশনে। তখন আমি লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। তবে জানতাম না, আমাদের কোথায় পাঠানো হবে। আমাদের অপারেশন কী হবে, তা ডুবোজাহাজের ভিতরে সিল করা থাকে। সেটা ওখানে গিয়েই দেখতে হয়। এটাকে বলে ‘সিক্রেসি এসেন্স অব সাবমেরিন অপারেশন।’ জানতে পারলাম শ্রীলঙ্কায় অপারেশনে যেতে হবে। ১৯৮৭ সালের শ্রীলঙ্কা অপারেশনে আমাদের একটা গোপন টাস্ক দেওয়া হয়। বলা হয়েছিল, কোনও তৃতীয় দেশ যাতে কোনওভাবে ওই লড়াইয়ে যুক্ত হতে না পারে, সেব্যাপারে নজর রাখতে হবে। ২৪ ঘণ্টা সেই নজরদারিতেই ছিলাম আমরা। তখন স্যাটেলাইট ব্যবস্থা এখনকার মতো এত উন্নত ছিল না। প্রায় একমাসেরও বেশি সেখানে ছিলাম।
আমি ১৯৯২ সালে প্রথম ডুবোজাহাজ কমান্ড করেছিলাম। নাম ছিল আইএনএস শঙ্কুস। ১৯৯৪ সালে কমান্ডিং অফিসার ছিলাম আইএনএস শঙ্কুল নামক ডুবোজাহাজে। এই ডুবোজাহাজ ভারতেই তৈরি হয়েছিল। ডুবোজাহাজের অভিজ্ঞতা বলা শুরু হলে তা শেষ করা যাবে না। বিশাখাপত্তনমে সাবমেরিন সদর দপ্তরে ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ডুবোজাহাজের ফ্ল্যাগ অফিসার ছিলাম। তখন আমি রিয়ার অ্যাডমিরাল পদে। তারপর মুম্বই এবং সেখান থেকে পদোন্নতি পেয়ে দিল্লি চলে গেলাম ভাইস অ্যাডমিরাল পদে। ওখানে গিয়েই আমি আইএনএস অরিহন্ত, আইএনএস চক্র নিয়ন্ত্রণ করতাম। এছাড়াও প্রচুর জটিল বিষয় ছিল। ২০০৯ সালে আমি আইজি নিউক্লিয়ার সেফটি পদের দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। এরপর ২০১২ সালের জুন মাসে আমাকে ডেপুটি চিফ করা হয়। দু’বছর সেই দায়িত্বের পর ২০১৪ সালে আন্দামান নিকোবর কমান্ডে কমান্ডার ইন চিফ পদে এলাম। আমার জীবনের অন্যতম বড় সাফল্য আইএনএস রাজপুত থেকে সুপারসনিক ক্রুজ মিসাইল ব্রহ্মস উৎক্ষেপণ করা। এতদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, যিনি সাবমেরিন কমান্ড করবেন, তিনি যুদ্ধজাহাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কিন্তু যিনি শুধু যুদ্ধজাহাজ নিয়ন্ত্রণ করবেন, তিনি সাবমেরিন কমান্ড করতে পারবেন না। কারণ, গোপনীয়তা বজায় রেখে জলের তলায় সতর্কিত পদক্ষেপ করাই আমাদের অন্যতম কর্তব্য।
অরুণ রায় (অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল): পূর্ববঙ্গের মানুষ তখন মুক্তির স্বাদ পেতে শুরু করেছেন ধীরে ধীরে। তবে পাকিস্তানও যে ছেড়ে দেবে না, সেটা আমরা জানতাম। কামড় তারা দেবেই। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল, পূর্ববঙ্গে খান-সেনার উপরে হামলা করবে ভারতীয় বাহিনী। পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের দিক থেকে প্রস্তুতিও শুরু হয়ে গিয়েছিল। এর পাল্টা হিসেবে পাক সেনাও সেই সময় জম্মুর দিক থেকে ভারতের উপরে হামলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর বা ৩০ নভেম্বর। আমি তখন জম্মুর ছাম্ব সেক্টরে। এইট জেএকে মিলিশিয়ার ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন। আমার কমান্ডিং অফিসার (সিও) কর্নেল জসবিন সিং রান্ধওয়া নির্দেশ দিলেন, নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে কোথায় ‘ফার্ম বেস’ তৈরি করা যায়, সেই জায়গা স্থির করতে। ‘ফার্ম বেস’-কে সেনাবাহিনীর পরিভাষায় লঞ্চপ্যাডও বলা যেতে পারে। সেই ফার্ম বেসের থেকেই শত্রুপক্ষের উপরে হামলা করতে হবে। সিও’র নির্দেশমতো আমি বাহিনী নিয়ে এগতে শুরু করলাম। দু’টি দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলাম। মানওয়ার তহি নদী টপকে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে দু’-তিন কিলোমিটার ভিতরে ঢুকে পড়ি। একটু একটু করে এগিয়েছি, আর পাথর ও গাছের উপর মার্কিং করেছি। যাতে এই রাস্তা ধরে ফিরে আসতে অসুবিধা না হয়। কিন্তু কিছুদূর এগতেই আমরা অবাক। কারণ, পাক বাহিনী ভারতের উপরে বড়সড় হামলার প্রস্তুতি প্রায় নিয়েই ফেলেছে। ট্যাঙ্ক, সুসজ্জিত যুদ্ধাস্ত্রে পাক বাহিনী তৈরি। দেখেই বুঝতে পারলাম, এখানে ফার্ম বেস তৈরি করা যাবে না। কারণ, ধারেভারে ওরা অনেক এগিয়ে পরিকল্পনা শুরু করে দিয়েছে।
ফিরে এসে পুরো বিষয়টি সিও’কে জানালাম। তিনিও বিভিন্ন সূত্রমারফৎ খোঁজ নিয়ে জানতে পারলেন, আমরা যেটুকু দেখেছি, তার থেকেও অনেক বেশিভাবে নিজেদের প্রস্তুত করছে পাক বাহিনী। সঙ্গে সঙ্গে তিনি দিল্লি গিয়ে সেনা সদরদপ্তরে বিষয়টি জানান। আমাকে নির্দেশ দেওয়া হয়, ফার্ম বেস নয়, বরং নদীর ধার বরাবর অংশে ভিত শক্ত করে তৈরি করতে হবে। জানতাম যে কোনও সময়ে হামলা হবে। তাই আমরাও নিজেদের আর্টিলারি ব্যবস্থা তৈরি করতে থাকি।
৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা। আচমকাই পাক বাহিনী হামলা করল। বোমা-গোলা বর্ষণে কেঁপে উঠল চারপাশ। দিনরাত গুলি-গ্রেনেড। সঙ্গে রকেট লঞ্চার আছড়ে পড়ছে। প্রথমদিকে কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করলাম। ব্যাটেলিয়নকে বলেছিলাম, জায়গা ছাড়া চলবে না। পাক বাহিনীকে কড়া জবাব দিতে হবে। আমি জানতাম, ওই অংশটি ছাড়লে চলবে না। কারণ, একবার পাক বাহিনী এই অংশ দিয়ে ঢুকে পড়লে সোজা আখনুর সেক্টরে পৌঁছে যাবে। আর সেখানে পৌঁছতে পারলেই, রাজৌরি, নৌসেরা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে। তাই দাঁতে দাঁত চেপে জায়গা ধরে রাখার লড়াই শুরু করি। পাক বাহিনীর হামলায় আমাদের বাঙ্কারগুলো গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল। একের পর এক জওয়ান শহিদ হচ্ছেন। কম পরিসরে হলেও আমরাও পাল্টা দিচ্ছিলাম।
উল্লেখ করা উচিত, ৭১’র যুদ্ধে একমাত্র ছাম্ব সেক্টরেই সংগঠিতভাবে হামলা করেছিল পাক বাহিনী। লড়াই যখন চার-পাঁচদিন কেটে গিয়েছে, তখন আকাশপথে হামলা শুরু করলাম আমরা। বায়ুসেনার বিমান একের পর এক বোমা নিক্ষেপ করতে শুরু করল পাক বাহিনীর উপরে। ওদের ট্যাঙ্ক গুঁড়িয়ে যেতে থাকল। পাল্টা পাক বায়ুসেনাও আমাদের উপরে হামলা করল। বোমাবর্ষণে কাঁপছিল গোটা ছাম্ব।
তবে মানওয়ার তহি নদীর ওপারে ছাম্ব সেক্টরের যে অংশে আমরা ছিলাম, সেখান থেকে প্রায় ৩-৪ কিলোমিটার পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলাম। পাক বাহিনী সেটা দখল করল। কিন্তু দেওয়া, নাথওয়ার টিব্বার কাছে আমাদের ব্যাটালিয়ন নিজেদের জায়গা ছাড়েনি। লালিয়ালি, ৭০৭, ৭০৪, ৭০৩ নম্বর পয়েন্টগুলি রক্ষা করাই ছিল আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ। আমরা তুলনামূলকভাবে পাহাড়ের একটু উপরের দিকে ছিলাম। মানওয়ার তহির উপরে একটি ব্রিজ ছিল। সেখান দিয়ে পাক বাহিনীর ট্যাঙ্ক পারাপারের পরিকল্পনা নিয়েছিল। তাই সেই সেতুটি উড়িয়ে দেওয়া হয়। ছাম্ব সেক্টরের সামান্য জায়গা ওরা দখল করে। কিন্তু ওই লড়াইয়ে আমরা আখনুর সেক্টরকে রক্ষা করতে পেরেছিলাম। পাক বাহিনীকে থামিয়ে দিয়েছিলাম নদীর ওপারে। ১৩ দিনের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা হয়। মানওয়ার তহির চারপাশ বারুদের গন্ধে ভরপুর। জানতে পারলাম, মুক্তিযুদ্ধে জয় এবং পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা। বর্তমানে মানওয়ার তহি নদীর উপর দিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখা গিয়েছে। ছাম্ব সেক্টরে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাক বাহিনীকে ১৩ দিন ধরে এক জায়গায় থামিয়ে রাখার কারণে ব্যাটালিয়নকে সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান দেওয়া হয়। বীরচক্রে ভূষিত হয়েছিলেন সিও কর্নেল জসবিন সিং রান্ধওয়া।
গ্রাফিক্স : সোমনাথ পাল
সহযোগিতায় : স্বাগত মুখোপাধ্যায়