পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
তখন আমার ক্লাস ফাইভ। থাকতাম উত্তর কলকাতার এক মফস্সল অঞ্চলে। মনে আছে, এপ্রিল মাসের শুরুর দিকে জেঠিমার সঙ্গে বাজার করতে গিয়েছিলাম স্টেশন লাগোয়া নিউ মার্কেটে। ম্যাক্সি বিক্রি করছিলেন এক দোকানদার। কানে আজও বাজে দোকান মালিকের সেই অমোঘ আবাহন ধ্বনি। মার্কেটিংয়ের ভাষায় সেলস স্পিচ। দোকানদারের কাব্যদোষ ছিল কি না জানি না। হ্যাঙারে ঝোলানো এক ঝাঁক ম্যাক্সি নিয়ে প্রাক বৈশাখী বিকেলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, ‘চৈত্রতে দেখা হল দু’জনায়। বৈশাখে হবে পরিচয়। আশি টাকা। আশি টাকা। ওনলি এইট্টি!’ দেওয়ালের এক কোণে এখন কালো ফ্রেমে বন্দি আমার জেঠিমা। তিনিও রসিক ছিলেন বড়। দুটো লাইন জুড়ে দিয়েছিলেন তৎক্ষণাৎ। বলেছিলেন, ‘আসছে আষাঢ় মাস। তিনবার ধোব। দেখব কী হয়। কী জানি কী হয়। ও ভাই! ন্যাতা হয়ে যাবে না তো?’ দোকানদার বলেছিলেন, ‘রঙের গ্যারান্টি আছে মাসিমা। ফিকে হবে না, টিকে যাবে। সবুজটা নিন। এটা চিরহরিৎ বৃক্ষের মতো আমার কথা রাখবে।’
উত্তর কলকাতায় রয়ে গেলেও আমার স্থানবদল ঘটেছে দু’দশক আগে। মানে, বাসা বদলেছে। সপ্তাহখানেক আগে বিশেষ কাজে যেতে হয়েছিল আদিভূমে। আমার কাছে দেশের বাড়ি তো ওটাই! মাথায় একরাশ ভাবনা-দুর্ভাবনা নিয়ে হনহন করে হাঁটার সময় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল ওই দোকানদারের সঙ্গে। আজ তিনি পক্বকেশ। চোখে মোটা চশমা। বয়সের ভারে মুখের রেখায় ত্রিকোণমিতি। পয়লা বৈশাখের বাকি মাত্র আর কয়েকদিন। দেখলাম, বাজারে ভিড় নেই মোটে। আমার মুখের ভাষা দেখে হয়তো কিছু আন্দাজ করতে পেরেছিলেন উনি। সামনে মেলে ধরা খবরের কাগজে ছিল পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন। নিবেদনে কোনও অনলাইন বিপণি। সত্তর ছুঁইছুঁই ভদ্রলোক সেদিকে চেয়ে বলছিলেন, ‘শপিং মল আর অনলাইন মিলে আমাদের বিক্রিটা খেল।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘এই সময়ের জন্য নতুন স্টক আনিয়ে রাখেননি কিছু?’ উনি আকাশের দিকে চেয়ে বললেন, কী হবে এনে? কার জন্য করব বৃথা এ আয়োজন?’ সামনে রাখা বোতলটা থেকে ঢকঢক করে জল খেলেন। একটু থামলেন। ঠক করে বোতলটা রেখে দিয়ে বললেন, ‘একটা সময় থামতে জানতে হয়। একসময় বেচেছি অনেক। এখন তো আমার অবসর। বাজার করার পুরনো ট্রেন্ডও হয়তো এখন পেনশনভোগী। সবসময় পিপাসা, হায় নাহি মিটিল করে দুঃখ করলে চলবে কেন! তবে এ বাজারে নতুন দোকান করা ইয়ং ছেলেমেয়েগুলোর জন্য বড় কষ্ট লাগে।’
সেলের আধুনিক বাজারে ‘এসো হে বৈশাখ’-এর সঙ্গে অনেক টার্গেট-গ্রাফ-চার্ট জুড়ে থাকে। জামাকাপড়ের এক সর্বভারতীয় খুচরো বিপণিতে কাজ করা আমার এক বন্ধু জানাল, পয়লা বৈশাখের ৪৫ দিন আগে থেকে চালু করে দেওয়া হয় একটি সেলস ট্র্যাকার। গত বছরের প্রাকবৈশাখী বিক্রির খতিয়ানের সঙ্গে প্রতিদিন মিলিয়ে দেখা হয় এ বছরের হিসেবনিকেশ। বন্ধুটি যাঁকে রিপোর্ট করে, তিনি আবার দক্ষিণী। সাবটাইটেল দেওয়া ‘গভীরে যাও, আরও গভীরে যাও’ গানটি শুনে তার নিহিত অর্থকেই জীবনের ব্রত করেছেন ওই কর্মযোগী। ‘বাই টু গেট থার্টি পার্সেন্ট অফ’ ট্যাগধারী দুধ-সাদা সুতির জামার বিক্রির গ্রাফ নিম্নমুখী হওয়ায় আমার বন্ধুকে একহাত নিয়েছেন সম্প্রতি। বলেছেন, ‘ডিপ ডাইভ করার মানসিকতা একেবারে নেই তোমাদের।’ দৈনিক সেলস রিপোর্টে এবার থেকে জুড়ে দিতে বলেছেন তাপমাত্রাও। গত বছর আজকের তারিখের তাপমাত্রার সঙ্গে যদি এ বছরের ওই তারিখের পারদ বেশি উঠে থাকে, আর দৈবাৎ যদি সাদা জামার বিক্রি এ বছরের ওই দিনে কম হয়, তাহলে আমার বন্ধুবরের আর রক্ষা নেই। উল্টোপাল্টা দেখলেই ফেলে আসা বছরের দিনগুলোর উষ্ণতা বাড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল আমার সুহৃদ। চটজলদি জবাব দিত, ‘লাস্ট ইয়ার জাদা গরমি থা স্যার। উসি লিয়ে জাদা বিকা।’ দক্ষিণী মানুষটি রাত রাত জেগে গুগল ঘেঁটে, আবহাওয়া সম্পর্কিত বিভিন্ন ওয়েবসাইটের গভীরে দিয়ে দৈনিক তাপমাত্রার তথ্য সংগ্রহ করেছেন। উষ্ণতা নিয়ে আমার বন্ধু ‘খেলা’ করায় বসবাহাদুরের উষ্ণতা গিয়েছে অনেক বেড়ে। বন্ধুটি পরিচিতবৃত্তে সিভি পাঠানো শুরু করেছে লিফলেট বিলি করার মতো।
শ্রীকৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনামের মতো চৈত্র সেলের নয়া নাম দেখি ফি বছর। সুপার ডুপার বৈশাখ, এন্ড চৈত্র মহা ক্লিয়ারেন্স সেলস, ঝিনচ্যাক গার্মেন্টসে নতুনে মাতুন— এসব তো ছিলই। তবে সম্প্রতি কোথায় যেন চোখে পড়েছিল, ‘দ্য বেস্টেস্ট এভার নিউ ইয়ার ধমাকা।’ বিজ্ঞাপনের ফ্রেমের দু’কোনা দিয়ে দুটো ঢাক ঢুকিয়ে দিতে পারলেই বাংলার সুঘ্রাণওয়ালা ডিওডোরেন্ট তার কাজ শুরু করে দেয়। আর আমরা মজি। কালের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চৈত্র সেলের ‘সাবেকিয়ানা’ আজ অনেকটাই ধূসর। বিশেষ দিনগুলোয় খদ্দের টানার জন্য দোকানদারদের সম্মোহনী স্লোগানগুলো ফিসফাস হয়ে যাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরে।
হাইপারলিঙ্কে ক্লিক করার মতো কয়েকটা স্মৃতি মাথায় এসে গেল। ১৯৯৩ সাল। চৈত্র সেলের বাজারে এক গামছা বিক্রেতা নিকটবর্তী ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে গামছার একটি প্রান্ত বেঁধে দিয়ে অন্য প্রান্ত ধরে প্রবল জোরে টানছিলেন। গাইছিলেন, ‘যদি ভাব ছিঁড়বে আমায়, ভুল ভেবেছ!’ দুটো পাপোশের সঙ্গে একটা পাপোশ ফ্রি প্রচারের উদ্দেশ্যে বিক্রেতা সুর ধরেছিলেন, ‘একে একে দুই, দুইয়ে একে তিন হয়েছি।’ বেস্টেস্ট এভার সেলের মোহে এমন প্রচারবাণীর গায়ে আজ কর্পূরের গুঁড়ো।
মাঝেমধ্যে মনখারাপের মাছিটা ভনভন করলে ওর গায়ে ফুঁ দিই। পালায়। আবার আসে। আবার ফুঁ দিই।
যুগ বদলেছে। বদলাতে হবে আমাকেও। যেমন বদলাচ্ছে সবাই।
বেশ করেছি, সেল করেছি, করবই তো।