উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
‘মেয়েরা আগে নিজে বুঝুক তারা স্বনির্ভর। মেয়েরা আগে নিজে জানুক তারা একাই একশো। তারপর সামাজিক মর্যাদা আপনি আসবে।’ বিবিসি-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কথাগুলো বলেছিলেন অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। সত্যি, বহুকাল আমরা মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষমতা বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলাম না। কিন্তু নারীর আত্মবিশ্বাস ক্রমশ বাড়ছে। তাই তো ঘরের চার দেওয়ালের ঘেরাটোপ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আজ মেয়েরাও হয়ে উঠেছেন রোজগেরে।
মানসিক ভরসা
তবু কেন মেয়েদের মানসিক স্বনির্ভরতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন ওঠে? আর্থিক স্বনির্ভরতা কেন তাঁদের স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারে না? বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সামান্য পূর্বকথন করলেন এন এস রাঘবন। এনএসআরসিইএল (এন এস রাঘবন সেন্টার ফর অনত্রোপ্রনিউরিয়াল লার্নিং) নামে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার তিনি। নারী উন্নয়ন নিয়ে তঁার বহুবিধ কাজ। তিনি বললেন, ‘নারী স্বাধীনতা হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কোনও বিষয় নয়। তার জন্য বিস্তর লড়াই করেছেন মেয়েরা। একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা আর্থিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর হলেও মানসিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি। আর তার কারণ তাঁদের বহু বছরের পরাধীন জীবন। মেয়েদের জীবনে শিক্ষার পরিধিটা আগে এতটাই সীমিত ছিল যে তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তাই বাইরে তো বটেই এমনকী ঘরেও পুরুষের অধীনেই ছিল মেয়েদের অনায়াস দিনযাপন। তারপর ক্রমশ সামাজিক বদল আর যুগের অগ্রগতির সঙ্গে এসেছে নারী উন্নয়ন। স্বাধীনতা তারও পরে। কিন্তু এই লম্বা পথচলায় মেয়েদের আর্থিক স্বনির্ভরতা এলেও মানসিক স্বাধীনতা পুরোপুরি আসেনি। তাই তো নারীরা আজও মনে মনে পুরুষের আধিপত্যের বেড়া ডিঙাতে পারেননি।’
আর মেয়েদের সেই মানসিকতার পরিবর্তন আনতে রাঘবন ও তাঁর সংস্থা উদ্যোগী হয়েছেন।
নারীর ক্ষমতায়ন তাই নারী স্বাধীনতার প্রথম ধাপ। ভারতের প্রেক্ষাপটে মহিলাদের সেই ক্ষমতায়নের পিছনে বেঙ্গালুরু নিবাসী এন এস রাঘবনের চিন্তাভাবনা অনেকটাই কাজ করেছে। তাঁর উদ্যোগেই শুরু হয়েছে মহিলা ব্যবসায়ীদের জন্য স্টার্ট আপ প্রোগ্রাম।
ক্ষমতায়নের প্রথম ধাপ
মহিলাদের নিজের পায়ে দাঁড় করানো বা আর্থিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর করাই রাঘবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না কোনও দিনই। বরং আর্থিক স্বনির্ভরতার মাধ্যমে মহিলাদের মানসিকভাবে স্বনির্ভর করে তুলতে চেয়েছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে রাঘবন জানান, মহিলাদের চাকরি করার বিষয়টি খুব একটা নতুন নয়। শহুরে জীবনে বেশ কয়েক দশক ধরেই মেয়েরা চাকরিরত। কিন্তু চাকরির বাইরে বেরিয়ে এসে মেয়েদের ক্ষমতায়ন কতটা সম্ভব? সেই ভাবনা থেকেই তিনি মহিলাদের জন্য প্রথমে স্টার্ট আপ প্রোগ্রামের কথা ভাবেন। সেই মতো মহিলাদের নিজস্ব ব্যবসায় নামার জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রামও স্থির করে তাঁর সংস্থা। নিজস্ব ছোটখাট ব্যবসা রয়েছে অথবা ব্যবসা করতে আগ্রহী এমন মহিলাদের নিয়ে একটা কর্মশালার আয়োজন করা হয়। সেই কর্মশালায় মহিলাদের বিপুল সাড়া পেয়ে রাঘবন অভিভূত হন এবং সিদ্ধান্ত নেন মহিলাদের জন্য একটা বিজনেস ট্রেনিং প্রোগ্রাম চালু করবেন। এই ট্রেনিংয়ে মহিলাদের ব্যবসা বিষয়ে খুঁটিনাটি তথ্য জানানো হয়। এই ট্রেনিংয়ের মধ্যে মেন্টরিং, স্কিল ডেভেলপমেন্ট ও ফিনানসিয়াল সাপোর্ট— এই তিনটি ভাগ থাকে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে একটা চেন সিেস্টমে নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব হয় বলে মনে করছেন সংস্থার অন্যতম প্রধান সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর মতে একজন মহিলা যখন একটা ব্যবসা শুরু করছেন, তখন সেটা চালাতে গিয়ে তিনি আরও অনেককে কাজে নিয়োগ করছেন। যার ফলে একাধিক কর্মসংস্থান সম্ভব হচ্ছে। এইভাবে চেন সিেস্টমে একজনের মাধ্যমে অনেকে উপকৃত হচ্ছেন।
ব্যবসায়িক নিয়ম
একজন মহিলা এই স্টার্ট আপ কর্মশালায় নিযুক্ত হলে প্রথমে তাঁর ব্যবসার বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চায় সংস্থা। তারপর সেই মতো তাঁকে একটা প্ল্যান ছকে দেওয়া হয় সংস্থার তরফে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী তিনি তাঁর ব্যবসা কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন এবং কোন পর্যায়ের পর তাঁকে নিজেকে সাপোর্ট ছাড়াই ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে হবে, সবই উল্লেখ করা থাকে। এছাড়াও ব্যবসা অনুযায়ী কিছু কোম্পানি সাপোর্টও দেওয়া হয়। অর্থাৎ ধরুন আপনি একটা হোম ডেলিভারি খুলতে চান। সেক্ষেত্রে কিছু হোম ডেলিভারি চেনের সঙ্গে আপনার ব্যবসাকে জুড়ে দিয়ে আপনাকে এই ব্যবসা বিষয়ে হাতেকলমে ট্রেনিং দেওয়া হয়। তার ফলে নিজের পরিকল্পিত ব্যবসা সম্পর্কে ধারণাটাও অনেকটা স্পষ্ট হয়ে যায় মহিলাদের কাছে। এরপর যখন সম্পূর্ণ একাই ব্যবসায় নামতে হয় তখন সেই পদক্ষেপ আরও সহজ হয়।
মহিলাদের সাড়া
রাঘবন বলেন তিনি যখন মহিলাদের স্বনির্ভর করার উদ্দেশ্যে একটা স্টার্ট আপ প্রোগ্রাম শুরু করার কথা ভেবেছিলেন, তখন তিনি কল্পনাও করেননি মহিলাদের কাছ থেকে এমন বিপুল সাড়া পাবেন। ২০১৬ সালে প্রথম এই প্রকল্পটি শুরু করেছিলেন রাঘবন। সেই সময় কর্ণাটক, কেরালা, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ থেকে বেশি সংখ্যক মহিলা এই প্রকল্পে নাম লেখান। তাঁদেরই মধ্যে গত দু’বছর যাবৎ সফলভাবে ব্যবসা করছেন উত্তরপ্রদেশের মেয়ে সোনাল সিং। প্রসাধনী বানিয়ে বিিক্র করেন সোনাল। তিনি বললেন ব্যবসা বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছিলেন নিজের বাগান থেকে। নানা রকম ফুলের গাছ ছিল তাঁর বাড়িতে। সেই ফুলের পাপড়ি বেটে, পাতা গুঁড়ো করে প্রসাধনী বানানোর কথা প্রথম তাঁর মাথায় আসে। সেই মতো পড়াশোনা করে প্রসাধনী বানিয়েও ফেলেন। কিন্তু তা দিয়ে ব্যবসা করবেন কী করে? রাঘবনের সংস্থায় নাম লিখিয়ে তিনি বিশেষভাবে উপকৃত এবং সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে করেন। সোনাল বললেন, ব্যবসার আসল কথাই মার্কেটিং। আর এই সংস্থার মাধ্যমে মার্কেটিংয়ে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ পেয়েছেন তিনি। সোনালের মতো রূপম কউরও রাঘবনের সংস্থার মাধ্যমেই নিজের ব্যবসাকে বাস্তব রূপ দিতে পেরেছেন। তাঁর ফাস্ট ফুড সেন্টারটি চালু করার পিছনে এনএসআরসিইএল সংস্থার অবদান অনেকটাই, বললেন রূপম। ফাস্ট ফুড সেন্টার চালতে গেলে প্রতিদিন কতটা খাবার মজুত রাখা দরকার, সেই খাবারের মধ্যে পুরোপুরি রান্না করা, হাফ কুকড এবং কাঁচা উপকরণ কতটা করে পরিমাণ রাখতে হবে, অর্ডার অনুযায়ী তাড়াতাড়ি রান্না করে দেওয়া কীভাবে সম্ভব— এই সবই তিনি শিখেছেন এনএসআরসিইএল সংস্থার মাধ্যমে। শুধু তাই নয়, খাবারের দাম কীভাবে নির্ধারণ করতে হয় যাতে লাভও থাকবে আবার নতুন ফুড ডেলিভারি জনপ্রিয়ও করা যাবে, এই ধরনের ছোটখাট বিষয় যে ব্যবসার ক্ষেত্রে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা-ও তিনি জেনেছেন সক্রিয় ট্রেনিংয়ের পর।
বাঁধা গত পেরিয়ে