উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
সে ছিল, সে আছে সে থাকবে। সে হল মানুষের মনের জমিতে আলপনা এঁকে ফুটে ওঠা কমলকলি। সে হল ভালোবাসা। সে হল প্রেমের উদ্ভাসন। ভালোবাসা এক অনুভব। মন সেই অনুভবে ময়ূরপঙ্খী নাও ভাসায়। কারণ ভালোবাসায় তো মানুষের মন নদী হয়ে যায়। সেই নদীতে ওঠা মাতাল ঢেউয়ে সে লিখে রাখে তার প্রিয় নাম। সেই ঢেউ হয়তো উথাল-পাথাল হয়। তাতে জাগে সূর্যের সাত রঙের বিচ্ছুরণ। চাঁদের কিরণ পিছনে এসে সেই নামটিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। ভালোবেসে মানুষ রঙিন হয়ে ওঠে। আর সেই অতল বর্ণ বোঝাতে বৈষ্ণব কবির গলায় শুনতে পাই—
‘লাখ লাখ যুগ
হিয়ে হিয়ে রাখলুঁ
তবু হিয়া জুড়ন না গেল।’
এমন কোনও তরুণ-তরুণী আছে ভালোবাসার মাতাল তরঙ্গে তার মন একবারও নদী হয়ে ওঠেনি? যার আকুল ব্যাকুল মন ছুটে যায়নি মনের মানুষটির কাছে?
ভালোবাসা জানানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ ‘শেষের কবিতা’-য় বলছেন, ‘দোহাই তোদের একটুকু চুপ কর/ ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর।’ আর এর জন্য তিনি কত অনায়াসে
জন ডানের কবিতার পংক্তি তুলে ধরলেন— ‘ফর গডস্ সেক, হোল্ড, ইওর টাং অ্যান্ড লেট
মি লাভ!’
ভালোবাসা জানানোর জন্য একটি দিন, একটি ক্ষণ চাই? তাই বুঝি আধুনিক প্রেমিক-প্রেমিকারা ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি খুঁজে নিয়েছে— যার নাম ‘ভ্যালেন্টাইন’স-ডে’। আর এই দিন আসার এক সপ্তাহ আগে থেকেই বিশেষ বিশেষ দিন বিশেষ বিশেষ নামে চিহ্নিত। যেমন, ৭ই রোজ ডে, ৮ই চকোলেট ডে, ১০ই টেডি ডে, ১১ই প্রমিস ডে, ১৩ই কিস ডে আর ১৪ই হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন’স-ডে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামে উৎসর্গীকৃত এই দিনে তারা হৃদয় উন্মোচন করে। তার আগেই ঠিক করে নেয় কীভাবে উচ্চারিত হবে সেই আদি-অকৃত্রিম চার অক্ষরের শব্দ। সোজা কথা নয় যে সে। মন ব্যক্ত হতে চলেছে— খুলতে চলেছে অন্তর কপাট!
তাই তো ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন’স-ডে (প্রেম দিবস) আসার অনেক আগে থেকেই বাজার ছেয়ে যায় ছোট-বড় নানা আকার প্রকারের ‘হৃদয়-রূপ’। সে ভেলভেটের হতে পারে, সিল্কের হতে পারে, হতে পারে টকটকে লাল গোলাপ দিয়ে বানানো আস্ত একটা হৃদয়।
কেউ বলে চুপি চুপি, কেউ বলে সোচ্চারে। কেউ গানে-গানে, কেউ কবিতায়-কবিতায়। কারও শুধুই চাহনি, কারও নীরব অভিব্যক্তি। আসল কথা ১৪ ফেব্রুয়ারি আকাশ-বাতাস ভালোবাসায় আমোদিত। হৃদয়ের সব কথা ধেয়ে চলে আর একটি হৃদয় পানে। হয়তো বা কিছু উহ্য কিন্তু গোপন নয়। কারণ সেটা যে ভালোবাসা প্রকাশেরই দিন। একটি প্রিয় দিন, উঠল হয়ে রঙিন। একটি প্রিয় রাতি, মনের ঘরে উঠছে জ্বলে হাজার প্রদীপ বাতি।
বাঙালি ছেলেমেয়েদের জীবনে ‘ভ্যালেন্টাইন’স ডে’ অনেকটাই নতুন। আগে প্রেমের দিন ছিল একটাই— সরস্বতী পুজোর দিন। সেই দিনটায় কত মন যে জুড়ত আর কত মন যে পুড়ত, তার হিসেব লেখা যেত না। তরুণীদের শাড়ি পরার আনাড়িপনায় লেগে থাকত অনন্ত মাধুর্য। যে মেয়ে সারা বছর প্রবল শাসনে ফ্রক, স্কার্ট-ব্লাউজ কিংবা সালোয়ার কামিজকে কব্জা করে রেখেছে, সে-ও সরস্বতী পুজোর দিন শাড়ির আঁচল সামলাতে ব্যস্ত। ‘তোমার ওই উত্তরীয়— আকাশে উড়ইায়া দিয়ো’ ভাব করতে করতে ছেলেরা কেবলই হোঁচট খেত। কার হৃদ্-কমলে ধাক্কা দিয়ে কোন সে আঁচল পাল তুলেছে, বুঝতে বুঝতেই ব্যগ্র যে তারা!
হবে না? মেয়েদের সাজগোজই সেদিন অন্যরকম থাকত তো! শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ, চতুর প্রসাধন ক্রিয়া-সজ্জা যেন লজ্জা না দেয়। আর সমস্তটায় মুড়ে রয়েছে মধুর ব্রীড়া।
আর ছেলের দল কাজ করা পাঞ্জাবি-চোস্ত-চুড়িদারে সেজে ডাইনে-বাঁয়ে জীবন্ত সরস্বতী সামলাচ্ছে। বীণাখানি যত্নে তুলে রেখে সিংহাসন ছেড়ে দেবী এত রূপে জনগণের মধ্যে মিশে গেল কী করে! সে কথা ভাবতেই ব্যস্ত ওরা।
সরস্বতী পুজোর অনেক আগে থাকতেই চলত মহড়া। যে ছেলে বা মেয়ে সারা বছর রবি ঠাকুর ছুঁয়েও দেখে না, সে-ই তখন গীতবিতানের খোঁজে দিশাহারা। তার সঙ্গে শেলি-কিটস-বায়রন নিয়েও টানাটানি চলত বেশ। ভালো ভালো লাইনগুলো লিখে রাখত হাতের পাতায়। সময়মতো যাতে গড়গড় করে বলে দেওয়া যায়। মুঠো ভরা অঞ্জলির সুবাস তাকে আরও মোহময় করে তুলত।
এই কলেজের ছেলেরা ওই কলেজের মেয়েদের সঙ্গে সরস্বতী দর্শন করছে। সেই কলেজের মেয়েরা ‘যেন কিছুই বুঝি না’ ভাব করে ছেলেদের কলেজে ঢুকে পড়ছে ঠাকুর দেখতে। ওই একটা দিন সহজ মেলামেশায় কোনও বাধানিষেধ নেই। কেবল আনন্দই-আনন্দ সেদিন।
একটা মজার গল্প বলে কথা শেষ করা যেতে পারে। এক সরস্বতী পুজোর শেষে, দু’টি হৃদয় বাঁধা পড়ল। সেই বাঁধা একদিন হলুদ সুতোয় গাঁথা হল। তারপর স্ত্রী একদিন স্বামীকে বলল, ‘সরস্বতী পুজোর দিন তোমার ডায়েরি থেকে নিজের লেখা বলে যে কবিতাগুলো পড়ে শুনিয়েছিলে— সেগুলো তো সব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা কবিতা। মিথ্যুক!’
স্বামী হেসে স্ত্রীর গলা জড়িয়ে বলল, ‘সরস্বতী পুজোর দিন অমন সব ভুল মাফ। মিথ্যুক আবার কী? আমার মনের কথা তোমাকে জানানোর জন্যই তো সেই কবি ওই কবিতাগুলো লিখেছিলেন।’ স্ত্রী ভুরু কোঁচকাল, কিন্তু হলুদ সুতোর বন্ধন শিথিল হল না। রাগ মিশে গেল হাসিতে।
সপ্তাহব্যাপী ভ্যালেন্টাইন’স উইকের দৌলতে আর নব্য আধুনিকতায় সরস্বতী পুজোর রং একটু ফিকে হয়ে গিয়েছে আজ। ১৪ ফেব্রুয়ারির ‘ভ্যালেন্টাইন’স-ডে’ এখন বেশি এগিয়ে। তাতে কী এসে যায়! দিনের ঠিকানা বদল হলেও তার মাধুর্য কমেনি। কমবেও না কোনও দিন। প্রেম-ভালোবাসা যে সবসময়ই মধুর। তাই সরস্বতী পুজো আর ভ্যালেন্টাইন’স-ডে, দুই-ই দীর্ঘজীবী হোক। চিরজীবী হোক ভালোবাসা।