প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
যে রাস্তায় পা রাখলে তুমি, সেখানে তুমিই ‘প্রথম’ কি না, তাতে কিছু আসে যায় না। বরং দেখতে হবে, এই পথে যাতে তুমিই ‘শেষজন’ না হয়ে যাও। কিশোরী কন্যা কমলাকে প্রায়শই এই কথাটা বলতেন শ্যামলা হ্যারিস। দুই মেয়ের মা শ্যামলার তখন সবে বিচ্ছেদ হয়েছে প্রেম করে বিয়ে করা জামাইকান স্বামীর সঙ্গে। দেশ ছেড়ে একলা অভিবাসিনী হয়ে আসা শ্যামলার মার্কিন মুলুকে মাটি পাওয়ার গল্পটা তাই অবশ্যই এক আদ্যোপান্ত লড়াইয়ের দলিল। আমেরিকার হবু ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা আদতে সেই লড়াইয়ের ফসল। মায়ের ওই লড়াকু দর্শনটাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কমলার কাছে। লড়াইয়ের নিয়মই হল, সে যখন কারও জীবনে আসে, তখন তঁার চারপাশের সকলকেই সে লড়াই লড়তে হয়। কমলা হ্যারিস, যিনি একটি গানের চরণকে সম্ভাবনাময় সত্য করে তুলেছেন, ‘যেখানে নারীরা থাকবে জুড়ে পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ’! তিনি আমেরিকার প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি মার্কিন মুলুকের প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম অভিবাসী ভাইস প্রেসিডেন্ট। কমলা যেন ‘রেকর্ড রমণী’!
কিন্তু রেকর্ডের উল্টো পিঠটাই তো রিয়্যালিটি! সেই বাস্তবের শুরু হতে আর মাত্র চারটে দিন বাকি। ২০ জানুয়ারি, কমলা যখন সেই বিরাট সাদা বাড়িটার অফিসে গিয়ে বসবেন। বাচ্চার মুখ থেকে চুষিকাঠিটা না সরানো পর্যন্ত তো আর বোঝা যায় না যে, সে হাসনরাজা না ছিঁচকাঁদুনে!
বাস্তব হল, কমলা কিন্তু আপামর আমেরিকার ‘অটোম্যাটিক চয়েস’ নন। কারণ, তিনি মহিলা। ‘মহিলাপ্রার্থী’ বলেই আগেরবারের প্রেসিডেন্ট ভোটে হিলারি ক্লিন্টন বিপক্ষের সাদামাটা প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারাতে পারেননি। চার বছর বাদেই আমেরিকা হঠাৎ ‘নারীপ্রেমিক’ হয়ে উঠেছে, সেটা ভাবার কোনও কারণ নেই। বিশ্বের বাকি অংশে সেই কবে থেকে মহিলারা রাজসিংহাসনে বসতে শুরু করেছেন। অথচ তথাকথিত প্রথম বিশ্বে, যেখানে একদা দুনিয়ার নারীমুক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, সেই আমেরিকা কদাপি ‘মহিলা শাসন’ মেনে নিতে পারেনি। এবারও কমলা জিততেন না, যদি না তিনি দেশের হবু প্রেসিডেন্ট জো বিডেনের পুচ্ছটি ধরতেন। এবং, যদি না ট্রাম্পের বিরুদ্ধে বিডেন ব্যালটবাক্স উপচে পড়া ‘ঘৃণাভোট’ পেতেন! এমনকী বিডেনও ‘মহিলা অবতার’ ভেবে কমলাকে কাছে টেনে নেননি। নিন্দুকরা বলে, অভিবাসীদের ভোট টানতে কমলাকে শিখণ্ডী খাড়া করেছিলেন তিনি। কমলার গায়ে ভারত-জামাইকার রক্ত বইছে। এই দুই সত্তার মিশেলে কমলা এমন একটা ‘ঢিল’, যার ঘায়ে দুই পাখি মরে! যদিও আসল ছবিটা অন্যরকম। শ্যামলা হ্যারিসের যথেষ্টই ‘ভারতীয় ভালবাসা’ ছিল বটে! কিন্তু কমলা-সহ তাঁর দুই কন্যার হাবেভাবে তেমন কোনও ‘ভারত প্রেমকথা’ ছিল বলে শোনা যায় না। পড়ুয়া কিংবা পেশাগত জীবনে কৃষ্ণাঙ্গদের কোনও সামাজিক আন্দোলন বা কর্মসূচির ব্যাপারেও কমলার তেমন সক্রিয়তা চোখে পড়েনি কখনও। এমনকী, কমলা কোনওদিন ‘বিপ্লবী নারীবাদী’ হিসেবে নিজের ভাবমূর্তিক গড়ে তুলতেও চাননি। কাজেই সমালোচকরা বলতেই পারেন যে, কমলাকে ভোটে নামানোটা একটা ‘রাজনৈতিক কৌশল’ মাত্র!
জিতে যাওয়ার পরে বরং বিডেন-কমলার কাজেকম্মে একটা ‘গুডি গুডি’ ব্যাপার ফুটে উঠছে। তা তো হবেই, জেতার পরে সব মানুষই একটু বেশিরকম ভালো হয়ে যায়! তা ‘ভালো’টা কী? ভাবী এক নম্বর আর দুই নম্বরের ‘কিচেন ক্যাবিনেট’ আলো করে মহিলারা ঢুকছেন। সিসিলিয়া রাউস, জেয়ারড বার্নস্টাইন, হিদার বাউস, কেট বেডিংফিলড, জেনিফার সাকি, জেনেট ইয়েলিন প্রমুখ। ‘ভারতীয় কোটা’-তে আরও তিন মহিলা আছেন, নীরা ট্যান্ডন, মালা আদ্দিগা এবং আয়েশা শাহ। মিছিল শেষ আরও দুই ভারতীয়কে দিয়ে। এবার পুরুষের পালা— বিবেক মূর্তি, বেদান্ত প্যাটেল আর অরুণাভ মজুমদার। তবে এ সবের সঙ্গে ‘নারীমুক্তি’ বা ‘মেরা ভারত মহান’-এর কি কোনও সম্পর্ক আছে! যে মহিলারা বিডেন-কমলার সংসারে ‘গদি’ পাচ্ছেন, তাঁরা শিক্ষাসংস্কৃতি, পেশাদারি অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানে অনেক এগিয়ে। কেউ তাঁদের স্রেফ ‘মুখ দেখে’ আসন পেতে দেয়নি। আর তাঁদের দেখে ‘ভারতীয়দের পোয়াবারো’ বলে চালানো হলেও তাঁরা তো আসলে মার্কিন নাগরিক। তাঁদের বড়জোর ‘ভারতীয় বংশোদ্ভূত’ বলা যায়। কাজেই এ সব আসলে তথাকথিত ‘লবিবাজি’!
আমেরিকার অভিবাসীরা, তা তাঁরা ভারতীয় বা কৃষ্ণাঙ্গ যাই-ই হোন না কেন, তাঁরা তো আর বিডেন-কমলার সঙ্গে ঘর করতে যাচ্ছে না! তাঁদের থাকতে হবে সেই ‘সাদা’ আমআমেরিকানদের সঙ্গেই। তাঁরা আসলে কেমন? তাঁরা রাজনৈতিক কারণে বিশ্বাস করেন না যে, করোনা নামে একটা বস্তু আছে! তাঁরা দৈহিক দূরত্বায়নের বিজ্ঞানসম্মত বিধিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বারে বা বিচে গিয়ে পার্টি করেন। দেশের প্রায় অর্ধেক আমেরিকান গর্বের সঙ্গে ট্রাম্পকে ভোট দেন! বহু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান এখনও বিশ্বাস করেন যে, বিডেন জিতেছেন ছাপ্পা ভোটের জোরে। আর ট্রাম্প ‘নির্বাচনী ফল’ বাতিল করতে আদালতে ছুটে যান। ওই ‘সাধারণ’ আমেরিকানরাই দেশের রাজধানীতে গিয়ে হোয়াইট হাউস আক্রমণ করে স্লোগান দেন, ‘উই ওয়ান্ট ট্রাম্প ব্যাক’! হোয়াইট হাউসের চাবি হাতে থাকলেও ‘এই আমেরিকান’-দের নিয়ে কি ‘নবযুগ’ আনতে পারবেন বিডেন বা কমলা? খুব কঠিন কাজ! চাবি দিয়ে একটা ঘরের বন্ধ তালা খুলে দেওয়া যায়। কিন্তু ঘরবন্দি মানুষকে বাইরে আনা যায় না। স্বেচ্ছাবন্দি আমেরিকানদের বাইরে আনতে গিয়ে কমলা নিজেই না ঘরের ভিতরে ঢুকে যান! শুধু একটা নিরেট চাবি হাতে নিয়ে কমলা তখন কাদের বলবেন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে’!