প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
শীতের অলস দুপুরে মিঠে রোদ গায়ে মেখে একসময় মহিলারা উল আর কাঁটা হাতে শিল্প সৃষ্টি করতেন। রমণীয় হাতের জাদুস্পর্শে অনবদ্য শিল্পের রূপ পেত উলের সোয়েটার, কার্ডিগান, ফ্রক, মোজা বা টুপি। তাই বলে উল বোনা যে খুব সহজ, তা কিন্তু ভাববেন না। বাড়ি তৈরির মতোই এই শিল্পে ধাপে ধাপে এগতে হতো খুব যত্নসহকারে। তারপর সেলাই পর্ব। তার জন্য আবার আলাদা সূচ। এরপর প্রিয়জন সেই নকশাদার উলের পোশাক পরলে মনে এক অনাবিল আনন্দের স্বাদ পেতেন মহিলারা। এই ঘরোয়া সৃজনশিল্পের জন্য মহিলারা সানন্দে পরিশ্রম করতেও রাজি থাকতেন। দুপুরের পর দুপুর নিরলসভাবে তাঁদের হাত চলত উল আর কাঁটার সঙ্গে। ক্লান্ত লাগত না একটুও। শীত রোদে গা এলিয়ে বসে কাঁথা তৈরির মতোই উলবোনা শিল্পও একসময় তাই অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে
এ প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘ললিতা একটা চৌকিতে বসিয়া ঘাড় হেঁট করিয়া দুই লোহার কাঠি লইয়া বুনানির কার্যে লাগিল।’
রবীন্দ্রনাথের বর্ণনার সেই লোহার কাঠি ছাড়াও এককালে আরও নানারকম কাঁটা উল বোনার কাজে ব্যবহার করা হতো। একটু ধনী পরিবারে যেমন বহুমূল্য হাতির দাঁতের কাঁটা দিয়ে উল বোনার চল ছিল। আবার একেবারে গরিব ঘরে সস্তার পলিথিনের কাঁটা দিয়ে উল বোনার কাজ চলত। এছাড়াও কারুকাজ করা রুপোলি রঙের কাঁটা, সরু কাঠের কাঁটা-সহ আরও নানারকম কাঁটা দিয়ে মেয়েরা উল বুনতেন। এইসব কাঁটার আবার মাপ বিভিন্ন। উলের রকমফেরে মাপের হেরফের হতো। সরু উলের জন্য সরু কাঁটা, মোটা উলের জন্য মোটা কাঁটা দিয়ে বোনার কাজ করতেন সেকালের মহিলারা। উলেরও ধরনও ছিল ভিন্ন। কোর প্লাই থেকে ফ্রি প্লাই, সিঙ্গল নিটিং থেকে ডাবল নিটিং— ধরনের নানারকম। আবার উলের চরিত্রও একে অপরের চেয়ে আলাদা। পিওর উল, ক্যাসমিয়ার, মেরিনো ধারিওয়াল, লাল ইমলি— তালিকা যেন শেষই হতে চায় না। এছাড়া চেরা উল, লাছি উল ইত্যদি তো ছিলই। আর ছিল উলের নকশা বা প্যাটার্নের কথা লেখা সাদা কালোয় ছাপা সহজ বাংলায় বিভিন্ন বই। এই ধরনের বই একসময় মহিলাদের হাতে হাতে ফিরত। কোন বইতে নকশার ভ্যারাইটি কত বেশি, বা কোথায় সহজ ভাষায় প্যাটার্নের ধরন বোঝানো হয়েছে, এই নিয়ে মেয়েদের মধ্যে রীতিমতো তর্ক বিতর্ক হতো।
উলের নকশার ধরনও ছিল বিচিত্র— কপি পাতা, সাবু দানা, গোলাপ ফুল, বকুল ফুল, হানিকম্ব, সিঁড়ি ভাঙা আরও যে কত নাম! সেকালের গৃহিণীরা এভাবেই শীতকালে সময় কাটাতেন, পুজোর পর থেকেই উল কাঁটা নিয়ে শুরু হতো বোনার পালা। শীতের শুরুতেই যাতে হাতে বোনার পশমের উষ্ণ ছোঁয়া গায়ে ওঠে প্রিয় মানুষটির। তখনকার সময়টাই আসলে অন্য ছিল। এখনকার মতো মেয়েদের জীবন ঘড়ির কাঁটা ধরে চলত না। বিনোদনের ধারাও ছিল ভিন্ন। তাই অবসরযাপনের জন্য মোবাইল ফোনের বোতামের বদলে উল কাঁটার টানাপোড়েনেই ব্যস্ত থাকত মেয়েদের করযুগল। আর এভাবেই অগণিত বিনুমাসি, নীলিমাদি, ঝর্নাবৌদিরা শীতের মজা লুটতেন কমলালেবু, নলেন গুড়, পিঠেপুলির মরশুমি স্বাদের সঙ্গে।
যুগ বদলেছে। অবসরও ফুরিয়েছে। হাতে-বোনা উল কাঁটার জায়গা নিয়েছে নিটিং মেশিন। কটসউলের জমানায় এখন সবই যান্ত্রিক ও রেডিমেড। একসময় ইংরেজ শাসকের সংস্কৃতির শরিক হতে গিয়ে বঙ্গললনা বিশেষত স্বদেশের আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্ম পরিবারের মেয়েদের হাতে উঠেছিল উল কাঁটা। নারী আর উল কাঁটায় এমন সখ্য গড়ে উঠেছিল যে ইংরেজ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্সও মেয়েদের এই বুননশিল্পের কথা লিখেছিলেন তাঁর নানা বইয়ে। এই সখ্য আর বুনট আজ ক্ষয়প্রাপ্ত, নিশ্চিহ্নপ্রায়। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীকে কাদম্বরী দেবীর দেওয়া ‘সাধের আসন’ তাই আজ বিস্মৃত। এখন নাতনির তৈরি কমফর্টার জড়িয়ে ঠাকুরদা যান না মর্নিংওয়াকে। তরুণী গৃহবধূর হাতে তৈরি সামান্য আঁটসাঁট সোয়েটার পরে অফিসে যান না তার তরুণ স্বামীটি। দিনবদলের সঙ্গেই সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ ছায়াছবির আরতিরা ছড়িয়ে পড়েন পাড়ায় পাড়ায় সোয়েটার বোনার মেশিন বিক্রি করতে। মেশিনে বোনা হাল ফ্যাশনের কাছে হার মানে হাতে-বোনা ঐতিহ্যশালী উল কাঁটার শিল্প।