প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
মুনমুন বেড়াতে ভালোবাসে বরাবর। বিয়ের আগে মা-বাবার সঙ্গে দেশের বহু রাজ্যে বেড়িয়েছে সে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে আর সেই অর্থে বেড়ানো হয়ে ওঠে না। না, পারিবারিক কোনও বাধা নেই। আসলে স্বামীটি তার বড্ড ঘরকুনো। কোনওমতে চাকরিটা সেরেই বাড়ির চার দেওয়ালের ভিতর বন্দি। একা একা কি আর বেড়ানো যায়? অতএব বেড়ানোর নেশায় জল ঢেলে দিতে একরকম বাধ্যই হয়েছে মুনমুন।
মুনমুনের মতো এমন কত মহিলাই আছেন, যাঁরা সঠিক সঙ্গীর অভাবে বেড়াতে যাওয়ার নেশাই ছাড়তে বসেছেন। সামাজিক পরিস্থিতিও যে এর জন্য খানিকটা দায়ী, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। যেখানে দেশের বেশ কয়েকটি শহরে সন্ধের পর মেয়েদের একা বাড়ির বাইরে বেরনো খুব একটা নিরাপদ নয়, সেখানে একা বিদেশ-বিভুঁইয়ে ভ্রমণ তো কল্পনাতীত! কিন্তু এভাবে আর ক’দিন! তাই মেয়েরাই একে অপরের পাশে দাঁড়ালেন। সংঘবদ্ধ হল তাঁদের আশা। গড়ে উঠল কিছু ভ্রমণ সংস্থা, যা মহিলাদের দ্বারাই পরিচালিত। কাজ, একাকী মহিলাদের ভ্রমণে সাহায্য করা।
স্বাতীর সঙ্গে ছুটির খোঁজ
শুরুটা হয়েছিল ২০১৪ সালে। মেয়েদের বেড়ানোর ভরসা হয়ে উঠতে চেয়েছিলেন স্বাতী কাপুর সারাওগি। স্বাতীর মতে, ‘নারীর ওপর সমাজের নানা বাধা। অনেক সময় মেয়েরা সেই বেড়াগুলো ডিঙিয়ে নিজেদের স্বপ্নের সন্ধানই পান না। আমার সংস্থা ‘হলিডে ট্রিপস্টার’ সেসব মহিলার জন্য, যাঁরা নিজেদের বেড়ানোর স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিতে চান। অথচ সামান্য সুযোগের অভাবে পেরে ওঠেন না।’
কলকাতার এই ভ্রমণ সংস্থাটির অফিস নাগেরবাজার অঞ্চলে। হঠাৎ মহিলাদের জন্য ভ্রমণ সংস্থা খোলার ইচ্ছে হল কেন? স্বাতী জানালেন, সমাজে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে আজও প্রশ্ন ওঠে। মেয়েরা তাই স্বনির্ভর হতে গিয়েও সামান্য নিরাপত্তার অভাবে পিছিয়ে যান। মেয়েদের সেই নিরাপত্তার জায়গা সুদৃঢ় করার জন্য এই ভ্রমণ সংস্থাটির কথা প্রথম ভেবেছিলেন তিনি। এমন একটা ভ্রমণ সংস্থা যার মারফত মেয়েরা নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে দেশে-বিদেশে বেড়াতে পারবেন। তাছাড়া তিনি আরও জানান, মেয়েরাই পারেন মেয়েদের বন্ধু হয়ে উঠতে। মেয়েরাই পারেন একে অপরের সহায় হতে। এই ভাবনাগুলো থেকেও হলিডে ট্রিপস্টার গড়ে তোলার কথা ভাবা হয়। বেশ কিছু সমমনোভাবাপন্ন মহিলাকে একটা ছাতার তলায় নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিলেন স্বাতী। এই সংস্থার নানা রকম ট্যুর রয়েছে। একক মহিলাদের জন্য যেমন ভ্রমণের নানা রকম প্যাকেজ রয়েছে, তেমনই পাঁচ-ছ’জন মহিলার একটি দলের জন্যও কাস্টমাইজড ট্যুরের ব্যবস্থা রয়েছে। অতএব আপনি যদি জায়গা এবং দল তৈরি করে স্বাতীকে জানান, তাহলে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং, বেড়ানোর বন্দোবস্ত, গাড়ি ভাড়া, খাওয়াদাওয়া-সহ সম্পূর্ণ ট্যুর আপনাকে তৈরি করে দেবে তাঁর সংস্থা। আর সেটাই হবে আপনার ‘কাস্টমাইজড’ ট্যুর। আবার আপনি যদি একা হন, সঙ্গীর অভাবে বেড়াতে যেতে না পারেন, তাহলেও নিশ্চিন্তে হলিডে ট্রিপস্টারের বিভিন্ন প্যাকেজের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে নিতে পারেন।
কথায় কথায় স্বাতী বললেন, মহিলাদের নিয়ে বিভিন্ন প্যাকেজ ট্যুরে গিয়ে তিনি দেখেছেন, মেয়েরা কেমনভাবে একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠেন। কেউ হয়তো উচ্চতায় ভয় পান, কারও বা ভয় বন্ধ ঘরে— মহিলারা নিজেই একে অপরকে সাহস দিয়ে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে এই ধরনের প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করেন। সম্পূর্ণ অচেনা একাধিক মহিলা একে অপরের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তারপর হয়তো নিজেরাই দল গড়ে স্বাতীর কাছে আসেন কাস্টমাইজড ট্যুরের আবেদন নিয়ে।
হলিডে ট্রিপস্টারে সাধারণ থেকে লাক্সারি— সব ধরনের ভ্রমণের প্যাকেজই রয়েছে। নতুন বছরে ৮-১২ জানুয়ারি তাঁদের কাশ্মীর ভ্রমণের পরিকল্পনা রয়েছে। আপাতত বুকিং চলছে। পাঁচ দিনের এই ট্যুরে পাবেন ২৪ ঘণ্টার গাইড। শ্রীনগর, পহেলগাঁও, গুলমার্গে থাকার ব্যবস্থা থাকবে। আর সোনমার্গে ডে ট্রিপ। যাতায়াত ছাড়া এই ভ্রমণের খরচ ১৪,৯৯০ টাকা। এই সংস্থার দেশি এবং বিদেশি বিভিন্ন প্যাকেজ ট্যুর রয়েছে। দেশি প্যাকেজের মধ্যে রয়েছে আউলি, মহাবালেশ্বর, গোয়া, দার্জিলিং, গ্যাংটক-সহ বিভিন্ন চেনা-অচেনা জায়গা। যাতায়াত বাদে খরচ মোটামুটি ৮-১০ হাজার টাকা থেকে শুরু।
যোগাযোগ: HolidayTripster –এর ফেসবুক পেজে গেলে সরাসরি যোগাযোগ ও বুকিং করতে পারবেন। ঠিকানা: ১ কে বি সরণী (মল রোড), নাগেরবাজার আইএলএস হাসপাতালের কাছে।
সুমিত্রা সেনাপতির ওয়াও ক্লাব
‘ওমেন অন ওয়ান্ডারলাস্ট’ অথবা শুধুই ‘ওয়াও’। ২০০৫ সাল থেকেই মেয়েদের বেড়ানোর ঠিকানা হয়ে উঠেছে এই সংস্থা। কর্ণধার সুমিত্রা সেনাপতির নিজের ছিল বেড়ানোর নেশা। তবে নিছক ভ্রমণের জন্য ভ্রমণ নয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া, অজানাকে জানার আনন্দও তাড়া করে বেড়াত সুমিত্রাকে। একা একা দেশ-বিদেশে বেড়াতে গিয়ে একসময় তাঁর মনে হল মহিলাদের জন্য ভ্রমণ সংস্থা চালু করলে কেমন হয়! যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। ২০০৫ সালে মহিলাদের বেড়ানোর জন্য ওমেন অন ওয়ান্ডারলাস্ট বা ওয়াও ক্লাবটি শুরু করেন তিনি। তবে সুমিত্রার এই সংস্থা সাধারণ ভ্রমণের পাশাপাশি কিছু অসাধারণ অভিজ্ঞতাও উপহার দেন। তাই এই সংস্থার সঙ্গে উপভোগ করতে পারেন মালদ্বীপে স্নরকেলিংয়ের আনন্দ। যোধপুরের সুফি কমিউনিটি উৎসবের স্বাদও পেতে পারেন। মিলতে পারে ভিয়েতনামের গ্রাম্য পরিবারের সঙ্গে খাওয়াদাওয়ার সুযোগ। পাশাপাশি ফ্রান্সের বোরদোঁতে গিয়ে ওয়াইন টেস্টিং, লাদাখে চাঁদনি রাতে খোলা আকাশের নীচে তারার আলোয় ক্যাম্পিং, ভুটানে গিয়ে টাইগার নেস্ট দেখার জন্য রক ক্লাইম্বিং ও আর্জেন্টিনায় ট্যাংগো ডান্সিংয়ের সুযোগও করে দেবে ওয়াও ক্লাব।
সুমিত্রা তাঁর ভ্রমণ সংস্থা নিয়ে খুবই আশাবাদী। জানালেন, ‘ওয়াও আসলে কোনও সংস্থা নয়, বরং এটিকে আমি ‘ট্র্যাভেল ক্লাব’ বলতেই বেশি পছন্দ করি। গতানুগতিক ভ্রমণের সুযোগ এখানে কম। পরিচিতের মাঝেও অপিরিচিতের সন্ধান করা আমার ট্র্যাভেল ক্লাবের উদ্দেশ্য। তাই ওয়াও ক্লাবে এমন ধরনের ভ্রমণের আয়োজন করা হয়, যা মনে রাখার মতো। ভ্রমণের ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স দিতে চাই আমি। আমার ভ্রমণগুলো তাই শুধু অপরিচিতই নয় একই সঙ্গে অপ্রচলিতও বটে। বাড়ির পুরুষ সদস্যটিকে ছাড়া মেয়েরাও যে অপ্রচলিত পথে হাঁটতে সক্ষম তারই বিশ্বাস জোগায় ওয়াও ক্লাব।’ পৃথিবীতে মোটামুটি ভিন্ন স্বাদের ৫০টি ডেস্টিনেশন ট্র্যাভেলের সুযোগ দেন সুমিত্রা। তাঁর মতে, সংসার, চাকরি আর সন্তানের জাঁতাকলের মধ্যে পড়ে অধিকাংশ মহিলাই নিজেদের সময় দিতে ভুলে যান। আর সেই কারণেই মধ্যবয়সে মহিলাদের মধ্যে একটা অবসাদের প্রবণতা দেখা দেয়। ওয়াও ক্লাবের বিভিন্ন ভ্রমণের মাধ্যমে নিজেদের জন্য সময় খুঁজে বার করতে শেখানো হয়। ফলে এই ভ্রমণের মাধ্যমে মেয়েরা নিজেদের বিভিন্ন দিক খুঁজে পান, আরও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেন। দেশের মধ্যে আন্দামান, গুজরাত, মধ্যপ্রদেশ, সিকিম-সহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের আয়োজন করে ওয়াও ক্লাব। বিদেশ বিভাগে আন্টার্কটিকায় পেংগুইন দেখার বা ট্রান্স সাইবেরিয়ান রেল রুটে ভ্রমণের মতো অপ্রচলিত ভ্রমণের সুযোগও পাবেন। এয়ার ফেয়ার-সহ সাত রাত আট-দিনের ট্যুরের খরচ মোটামুটি ৫০,০০০ টাকার কাছাকাছি। ট্যুরের সময়সীমা, জায়গা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে খরচ। তবে সুমিত্রা জানালেন, নামমাত্র খরচে ভ্রমণের আয়োজন তিনি খুব একটা করেন না। আসলে চেনা পথে অচেনা ভ্রমণের জন্য খরচ তো একটু বেশিই পড়বে! দিল্লি এবং বেঙ্গালুরুতে এই ক্লাবের অফিস রয়েছে।
যোগাযোগ : ৯৮৭১৯২১৬৩৩
বেড়ানোর আনন্দে মালিনীর সঙ্গে
বেঙ্গালুরুর মেয়ে মালিনী গৌরীশঙ্কর। শুধুমাত্র মহিলাদের নিয়ে তাঁর ভ্রমণ সংস্থা ‘এফ৫ এসকেপস’। মেয়েদের জন্য ভ্রমণ সংস্থা চালু করার কথা হঠাৎ ভাবলেন কেন তিনি? বললেন, ‘আমি বেড়াতে যেতে ভালোবাসতাম। কিন্তু একা বেড়ানোর সুযোগ কখনও পাইনি।’ খানিকটা সাহসের অভাব আর কিছুটা সুযোগের অভাবেই কখনও নিজের পছন্দসই জায়গায় বেড়াতে যেতে পারেননি মালিনী। সবসময়ই হয় বাবা নয়তো স্বামীর পছন্দে বেড়াতে হয়েছে। তাই ভাবলেন নিজে যা পারেননি, অন্য মহিলাদের সেই সুযোগই করে দেবেন। সেই ভাবনা অনুযায়ী শুরু করলেন এফ৫ এসকেপস ট্যুরস অ্যান্ড ট্র্যাভেলস। মালিনীর কথায়, ‘গোটা পৃথিবীই চষে বেড়াতে পারেন মেয়েরা। শুধু একটু সুযোগের অপেক্ষা। একা যে পথ দুর্গম মনে হয়, অনেকের সঙ্গে তা-ই হয়ে ওঠে সুগম। তাই মহিলাদের পছন্দসই ভ্রমণের সুযোগ করে দিতে আমার সংস্থা সদা প্রস্তুত।’ তবে শুধু বিভিন্ন প্যাকেজ ট্যুরই নয়, তার আগে মেয়েদের নিরাপত্তার কঠোর ট্রেনিংয়েরও ব্যবস্থা করেন মালিনী। ভ্রমণ বিষয়ক বিভিন্ন সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে নানা কর্মশালারও আয়োজন করেন। তাতে বাইকিং, হাইকিং, রোপ ওয়াকিং, রক ক্লাইম্বিং ইত্যাদি নানা ধরনের স্কিল ট্রেনিংয়ের মতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় মহিলাদের। লক্ষ্য রাখা হয় যাতে বেড়াতে গিয়ে যে কোনও অবস্থার মোকাবিলা তাঁরা করতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, নিজের এই ভ্রমণ সংস্থা চালু করার পিছনে আরও এক স্বপ্ন রয়েছে মালিনী গৌরীশঙ্করের। তিনি চান বিশ্বের মানচিত্রে ভারতের নাম ‘উইমেন’স সেফ ট্র্যাভেলিং প্লেস’ হিসাবে তুলে ধরতে। তাই শুধুমাত্র মহিলাদের নিয়ে এই সংস্থাটি শুরু করেন। লক্ষ্য, বিশ্বের কাছে ভারতকে নিরাপদ ভ্রমণের ঠিকানা হিসাবে তুলে ধরার আনন্দ।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মহিলাদের জন্য বাইকিং ট্যুরেরও বন্দোবস্ত করে এফ৫ এসকেপস। যোগ ফলস, কাশ্মীর, স্পিতি, মেঘালয়-সহ বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণের ব্যবস্থা করে এই সংস্থা। খরচ মোটামুটি ৮ হাজার টাকা থেকে শুরু। ভ্রমণের সময়সীমা ও জায়গার ওপর খরচ নির্ভরশীল।
যোগাযোগ: ৮০৪৭০৯১৭৫৯