মেয়াদি সঞ্চয় বা পৈতৃক সম্পত্তি সূত্রে ধনাগম যোগ দেখা যায়। কাজকর্মের ক্ষেত্রে ও আর্থিক দিক ... বিশদ
উত্তর আছে—রাজনীতি। কিন্তু এই উত্তর মুখে আনা যাবে না, শোনা যাবে না, পরীক্ষায় লিখলে নম্বরও মিলবে না। বলা হবে, ধর্মের উপর খবরদারি শুরু হয়েছে। সত্যিই কি তাই? এইচ এইচ উইলসনও সেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে লিখে গিয়েছেন, ‘ভারতীয় সংস্কৃতির প্রথম পর্বেই গোরু এবং ঘোড়াকে শুভ কাজে উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। একে বলা হতো গোমেধ এবং অশ্বমেধ।’ অর্থাৎ চল ছিলই। শুধুই মুসলিম শাসকরা পরে এদেশে রাজত্ব করতে এসে গোহত্যা শুরু করেছে, তেমনটা নয়। এই সবই ইতিহাস বলছে। তাহলে পরিস্থিতি বদলাল কীভাবে? এক্ষেত্রে সবথেকে বেশি চর্চিত থিওরিটা হল, মুসলমান শাসকদের জমানায় হিন্দুরা যাতে এককাট্টা হয়ে প্রতিরোধ করতে পারে, সে জন্য একটি ‘কারণ’ বা ‘বিষয়বস্তু’ সামনে রাখার প্রয়োজন ছিল। সেই কাজটা করেছিল ‘গোমাতা’। সস্তায় পুষ্টিকর বলে গরিব মুসলিম পরিবারের অনেকেই গোমাংস খেতেন। হিন্দুরা তার বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন—গোহত্যা বন্ধ করতে হবে। সেটাই হিন্দুদের জোটবদ্ধ হতে সাহায্য করেছিল। আর এই সমীকরণে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ছত্রপতি শিবাজী। ১৮৭০ সালে পাঞ্জাবে প্রথমবার আন্দোলনের ঢঙে পথে নামল শিখ কুকা সম্প্রদায়। আর ১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতীর নেতৃত্বে গড়ে উঠল প্রথম গোরক্ষিণী সভা। সেইসঙ্গে রাজনীতির অলিন্দে পাকাপাকিভাবে ঢুকে পড়লেন গোমাতা। ১৮৮০ থেকে ’৯০—এই দশ বছরে ভারতের কোণায় কোণায় এই ইস্যুতে একের পর এক দাঙ্গা হল। সাম্প্রদায়িক রঙের গুঁড়ো ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম বিরোধিতার ভিত আরও শক্ত করল গেরুয়া কট্টরপন্থীরা। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত মানবিকতার থেকে বড় হয়ে উঠল উত্তরাধিকার বা কনভারশন সূত্রে পাওয়া ধর্ম। ১৮৯৩ সালে আজমগড় থেকে সূত্রপাত হওয়া এমনই এক সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে দেশজুড়ে প্রাণ গিয়েছিল শতাধিক মানুষের। ১৯১২ সালে অযোধ্যা, ১৯১৭ সালে শাহাবাদ... অন্তবিহীন সেই হিংসা। স্বাধীনতার পর সংবিধানে এই প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হল ঠিকই, কিন্তু খাদ্যাভ্যাস তো একান্তই ব্যক্তিগত। মৌলিক অধিকারও বটে। সেখানে সরকার রুল জারি করবে কীভাবে। তারপরও চাপ বাড়াতে ১৯৬৬ সালে প্রায় সব গেরুয়াপন্থী দল ও সংগঠন একজোট হল। সংসদের সামনেই চলল সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। মৃত্যু হল আটজনের। জখম বহু। গোমাতা নিজেও জানতে পারলেন না, কখন তিনি রাজনীতির এলিট ক্লাসের ঘুঁটি হয়ে গিয়েছেন। জনসঙ্ঘ থেকে বিজেপির ‘নবজন্মে’র পর এই রাজনীতির ষোলো কলা পূর্ণ হল। আর স্বঘোষিত গোরক্ষকরা ডাবল ইঞ্জিন রাজ্যে ডানা মেলতে শুরু করল মোদি জমানায়। সঙ্গে লাভ জিহাদ, হিন্দুরাষ্ট্রের হুঙ্কার, উস্কানিমূলক সিএএ। লক্ষ করার মতো বিষয় হল, ভোট দুয়ারে কড়া নাড়তে শুরু করলেই এই গোক্ষক বা লাভ জিহাদের বিরুদ্ধপন্থীরা ঠিকানা বদলে দরজায় খিল দিয়ে বসে যায়। ভোট মিটতে আবার শুরু হয় তাদের তাণ্ডব। ইঙ্গিতটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। আর এটাই রাজনীতি। ক্ষমতার অলিন্দে অবাধ বিচরণের লক্ষ্যে সামান্য ঘুঁটি চালাচালি। আজও সেটাই হচ্ছে। নবান্নের ১৪ তলার ঘরটাতে অ্যাকোয়ারিয়মের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে মাছগুলোকে দেখতে থাকা সাবির মল্লিকের একরত্তি মেয়েটা বুঝতেও পারছে না, তার বাবার সঙ্গে কী রাজনীতি হয়েছে। সে শুধু জানে, বাবা ফেরেনি। কিন্তু সে কি জানে, তার বাবা আর ফিরবে না? সে কি জানে, কেন তার বাবা ফিরবে না?
এই ধরনের ঘটনা নিরন্তর একটা সাম্প্রদায়িক আগুনের জন্ম দিয়ে চলে। প্রতিনিয়ত। আগ্নেয়গিরির লাভার মতো ফুটতে থাকা সে বুকের অন্দরে। কোনও একটা সময় বিস্ফোরণ হয়। আর তাতে ধ্বংস হয়ে যায় মানবিকতা। সমাজ যদি এখনও এই খুনে রাজনীতির বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ায়, বড্ড দেরি হয়ে যাবে। সময় কি এখনও আসেনি? প্রকাশ্যে একজনকে পিটিয়ে এবং কুপিয়ে মারা হচ্ছে। আর বাকিরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে। শ্যুটিং চলছে নাকি? কেন তাদের মনে হচ্ছে না এই নারকীয়তার শেষ হওয়া উচিত? কেন সমাজ এগিয়ে আসছে না? কেন সাবির, আরিয়ান বা মালদহের শ্রমিক মোতি আলির জন্য পথে নামছে না সমাজ? আর জি কর কাণ্ডের বিচার চেয়ে ঠিক যেভাবে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও প্রতিবাদের আগুন জ্বলেছে, তার আঁচ কেন স্বঘোষিত গোরক্ষকদের পুড়িয়ে মারবে না? আসলে সমস্যাটা ব্যক্তির নয়, সিস্টেমের। বছরের পর বছর নিখুঁত প্র্যাকটিসে দুর্নীতি এবং অপরাধ ঢুকে পড়েছে মজ্জায়। শাসক বদলালেও সিস্টেমের ভূতের থেকে নিস্তার নেই। গোটা দেশেই। কারণ, রাজ্যের নাম যাই হোক না কেন, দুর্নীতি, অপরাধ এবং ক্ষমতায়নের সিস্টেমের ভাষা এক। আন্দোলনে যদি নামতেই হয়, তাহলে কয়েকজন ব্যক্তি নয়, লক্ষ্য নিতে হবে সিস্টেমকে আমূল বদলে দেওয়ার। যাতে জাতীয় সড়ক তৈরির সময় ঠিকাদারের থেকে কাটমানি নিতে গেলে বুকটা কেঁপে ওঠে। মনে হয়, সাধারণ মানুষ জানতে পারলে চামড়া গুটিয়ে নেবে। ধর্ষণ করার কথা ভাবলেও প্রবৃত্তি ছাপিয়ে শিরদাঁড়ায় ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বেয়ে যাবে... ভয়াবহ পরিণতি ভেবে। মুসলিম নাম শুনলেই গোরক্ষার নামে খুনের ছাড়পত্র ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ছড়িয়ে দেওয়া হবে সচেতন সমাজের আকাশে।
প্রতিদিন শত শত অপরাধ ঘটে চলে ১৪০ কোটি জনতার দেশে। প্রত্যেক ঘটনা মানব মননকে নাড়া দেয় না। ধাক্কা দেয় না। আর জি করের মতো কিছু ঘটনা ট্রিগারের কাজ করে। বহুদিন ধরে জমে থাকা বারুদে বিস্ফোরণ ঘটায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কাশ্মীর হোক বা মণিপুর, কলকাতা বা নাসিক... পরিচয় তার একটাই—অপরাধী। তার কোনও ধর্ম নেই, ভাষা নেই, স্টেটাস নেই, রাজনীতির রংও নেই। সাবির আলি বা আরিয়ান মিশ্রর নৃশংস মৃত্যু, কিংবা উজ্জ্বয়িনীর রাস্তায় দিনেদুপুরে যুবতীকে ধর্ষণের ঘটনাও সমাজের মনে জমে থাকা বারুদে বিস্ফোরণ ঘটাবে না? ট্রিগার করবে না? বিচারের আশায় বসে আছেন উমাদেবী। সিবিআই তদন্ত হয়নি তাঁর ছেলের মৃত্যুতে। সাবির মল্লিকের খুনও এজেন্সির রেডারে ধরা পড়েনি। স্থানীয় পুলিস লঘু ধারায় মামলা করবে, জনরোষ দেখানো হবে, আর তারপর কয়েক বছরের জেল-জরিমানা। কেস খতম। রাজনৈতিক এবং স্পর্শকাতর হওয়া সত্ত্বেও কেউ অতটা গা ঘামাবে না। উমাদেবী কি আশা করতে পারেন না... অভয়ার মতো আরিয়ানের হয়েও পথে নামুক সমাজ? গণতন্ত্রের দায়রার মধ্যে থেকেই শিক্ষা দিক শাসককে। যারা পথেঘাটে হত্যাকেও নিঃশব্দে ধোঁয়া দিয়ে চলেছে। সেই প্রতিবাদেই সমাজের এবং মানবিকতার সার্থকতা। না হলে? ওটাও রাজনীতি।