বিদ্যা শিক্ষা ও কাজকর্মে দিনটি শুভ। বন্ধুসঙ্গে বিপদ হতে পারে। অধ্যাপনায় অগ্রগতি। ... বিশদ
৮ আগস্ট রাতে আর জি করে ঘটা নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের বিচার চায় বাংলা। বাংলার চিকিৎসক কন্যার ধর্ষক, খুনি ও ষড়যন্ত্রকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেখতে অভয়ার বাবা, মায়ের সঙ্গে মুখিয়ে রয়েছে গোটা দেশ। তাই জুনিয়র ডাক্তাররা অভয়ার বিচারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করতেই সঙ্গ দিয়েছে আবেগতাড়িত বাংলা। দলমত নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে। চিকিৎসকদের কর্মবিরতির জেরে বহু মানুষের চরম ভোগান্তি সত্ত্বেও প্রতিবাদ হয়নি। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট ও রাজ্য সরকার বারবার তাঁদের কাজে যোগ দেওয়ার আবেদন জানানোর পরেও কর্মবিরতিতে তাঁরা অনড়। তাতে অনেকেরই মনে হচ্ছে, সমাধান নয়, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়াটাই লক্ষ্য। তাই চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সামনে রেখে রাজনীতি করার যে অভিযোগ এতদিন উঠছিল চুপিসারে, এখন সেটাই এসেছে প্রকাশ্যে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়েও বিজেপি কেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের ‘নৈতিক সমর্থন’ জুগিয়ে যাচ্ছে? এর পিছনে রয়েছে ভোটের অঙ্ক। ২০১৮ সাল থেকে সিপিএম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যত আন্দোলন করেছে তার সব সুফল পেয়েছে গেরুয়া শিবির। চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনেও তার প্রতিফলন সুস্পষ্ট। এবারের এই আন্দোলনও মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে। তাতে বিজেপির আহ্লাদিত হওয়ার কথা। তার বদলে হচ্ছে শঙ্কিত। কিন্তু কেন?
চিকিৎসকদের এই আন্দোলনে শহুরে মধ্যবিত্ত ও বড় লোকদের একটা বড় অংশ সিপিএমের পতাকার নীচে এসে দাঁড়িয়েছে। আর জি কর নিয়ে প্রথম থেকেই মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়রা লড়াইয়ের সামনের সারিতে রয়েছেন। অভয়ার এক আত্মীয়ার মুখে মীনাক্ষীর প্রশংসা রীতিমতো ভাইরাল। তাতে তৃণমূল বিরোধী শহুরে ভোটের একটা অংশ ফের বামে ফিরবে, এই ভয় পাচ্ছে গেরুয়া শিবির। সেই আশঙ্কা থেকেই ‘ছাত্রসমাজ’কে ময়দানে নামানো হয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। উল্টে বিশৃঙ্খলা পাকিয়ে শান্তিপূর্ণ গণআন্দোলন থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে তারা। তাই জুনিয়র ডাক্তাররা বিজেপির সামনে বারবার ‘নো এন্ট্রি’ বোর্ড ঝুলিয়ে দিলেও গেরুয়া শিবির গায়ে মাখছে না। বিজেপি নেতৃত্ব জানে, বাম ভোটের ‘ঘরওয়াপসি’ ঘটলেই তাদের অবস্থা হবে ভাঁড়ে মা ভবানী।
তারপরেও জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন ঘিরে কেন উঠছে রাজনীতির অভিযোগ? অনেকে বলছেন, প্রথম থেকেই এই আন্দোলনের পিছনে ছিল বামেদের মদত। এখন তারসঙ্গে জুড়ে গিয়েছে অতি বামেদের যুক্ত থাকার অভিযোগ। কারণ প্রথমদিকে অভয়া খুনের জাস্টিসই ছিল চিকিৎসকদের দাবি। কিন্তু এখন? সরকারি আমলা সহ স্বাস্থ্যকর্তাদের পদত্যাগ। লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য বড় হয়ে গিয়েছে। এমনটাই নাকি হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
২০১৪ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছিল। বিচারের দাবিতে উত্তাল হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পরে তা আছড়ে পড়েছিল কলকাতার রাজপথে। শুরু হয়েছিল ‘হোক কলরব’। দাবি উঠেছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর পদত্যাগ। আন্দোলনের চাপে অভিজিৎবাবুকে উপাচার্যের পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল। আর তারপরেই থেমে গিয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন। কিন্তু ওই ছাত্রী ‘জাস্টিস’ পেয়েছিলেন কি না, তার খবর কেউই রাখেননি। না আন্দোলনকারীরা, না তাঁদের মদতদাতারা।
জুনিয়র ডাক্তাররাও দিনদিন যাদবপুরের স্টাইলে সরকারি আমলাদের পদত্যাগের তালিকা লম্বা করে চলেছেন। শুরু হয়েছিল কলকাতা পুলিস কমিশনারকে দিয়ে। ইতিমধ্যেই তা পৌঁছেছে স্বাস্থ্যসচিব পর্যন্ত। তাঁরা জানিয়েছেন, পদত্যাগের দাবি সরকার মানলে তবেই তাঁরা কাজে ফিরবেন। আর তাতেই অনেকে আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের উপর যাদবপুরের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।
অভয়ার খুনের তদন্ত করছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সময় নেওয়ায় সিপিএম ‘সেটিং’ তত্ত্বে শান দিচ্ছে, কিন্তু সিজিও কমপ্লেক্সে যাচ্ছে না। তাদের আক্রমণের লক্ষ্য পুলিস ও রাজ্য সরকার। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের অভিমুখও সেই দিকেই। এই মুহূর্তে যারা অভয়া খুনের ঘটনায় জাস্টিস দিতে পারবে, সেখানে ডাক্তারবাবুরা চাপ দিচ্ছেন না। উল্টে তাঁদের দেওয়া শর্তে ফুটে উঠছে রাজ্য সরকারকে ‘ভিলেন’ বানানোর প্রয়াস। তাতেই সরকার ও রাজ্যের শাসকদল আন্দোলনের পিছনে রাজনৈতিক চক্রান্তের অভিযোগ তোলার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে পুজোয় ও উৎসবে ফেরার আবেদন জানিয়েছেন। তাতেই বাম এবং অতি বামেরা সোশ্যাল মিডিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর মুণ্ডপাত করছেন। অনেকে আবার লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চাইছেন। কিন্তু তাঁরা একবারও কি পুজোর সঙ্গে যুক্ত খেটেখাওয়া মানুষগুলোর কথা ভেবেছেন? পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর পুজোয় রাজ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। বেনিফিসিয়ারির মধ্যে যেমন চা, চপ, রোল, ঝালমুড়ি বিক্রেতা আছেন তেমনই আছেন ডেকরেটর কর্মী, মৃৎশিল্পী, আলোকশিল্পীরা।
বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকরা প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়াবেন, তাঁদের বক্তব্যের সমালোচনা করবেন, তাঁকে নিয়ে কার্টুন আঁকবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এটাই তো গণতন্ত্র। তবে,তাদের সমালোচনা মানুষ কতটা বিশ্বাস করবে, সেটা নির্ভর করে কে বা কারা বলছে তার উপর। যেমন গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমস্যা ধৈর্য সহকারে আলোচনার মাধ্যমে মেটানো উচিত, একথা সিপিএম বললে মানুষ কি গ্রহণ করবে? কেন এই সংশয়?
সালটা ছিল ১৯৮৩। বামফ্রন্ট সরকার সবে বিপুল শক্তি নিয়ে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় বসেছে। রাজ্যের ধর্মঘটী জুনিয়র চিকিৎসকরা মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে ২৪ ঘণ্টা ব্লাড ব্যাঙ্ক, ইসিজি প্রভৃতি চালু ও কিছু জরুরি ওষুধ রাখার দাবি জানালেন। জ্যোতিবাবু জুনিয়র চিকিৎসকদের বলেছিলেন, ‘এসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। ধর্মঘট তুলে নিন। আপনারা সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে খেলছেন।’
মুখ্যমন্ত্রী দাবি না মানায় জুনিয়র ডাক্তাররা ধর্মঘট চালিয়ে যেতে লাগলেন। কয়েকদিন পর জুনিয়র ডাক্তারদের সাত প্রতিনিধিকে রাইটার্সে ডেকে পাঠালেন। মিটিং শুরু হল। জ্যোতিবাবু বললেন, ‘আপনারা কী করবেন, সেটা আপনাদের ব্যাপার। আমরা চুপ করে বসে থাকব না।’ চিকিৎসকরা বলতে গেলেন, মানুষের স্বার্থেই তাঁদের এই ধর্মঘট। উত্তর এল, ‘মানুষের দাবি আপনাদের কাছ থেকে শিখব?’ জুনিয়র ডাক্তারা বোঝানোর চেষ্টা করলেন অসুস্থ মানুষের স্বার্থেই তাঁদের আন্দোলন। এবার উত্তরটা একটু কড়া, ‘আগে স্ট্রাইক তুলুন, পরে ভাবব। সীমা ছাড়াচ্ছেন। বিপদে পড়বেন। আমার কথা শেষ।’
জুনিয়র চিকিৎসকদের সেই ধর্মঘটের পরিণতি কী হয়েছিল? এক সন্ধ্যায় লালবাজার থেকে তিন ভ্যান পুলিস গেল ন্যাশানাল মেডিক্যালে। কোনও কথা না বলেই শুরু হল ধর্মঘটী জুনিয়র ডাক্তারদের উপর লাঠিচার্জ। রক্তাক্ত হলেন চিকিৎসকরা। পুলিসের মার থেকে বাঁচতে কেউ কেউ ভিড়ের মধ্যে গা ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কমরেডরা তাঁদের চিনিয়ে দিলেন। সেদিন ১৪জন জুনিয়র ডাক্তারকে পেটাতে পেটাতে লালবাজার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। চিকিৎসকরা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সেদিন ‘সাধারণ মানুষের স্বার্থের’ কথা বলেই জ্যোতি বসু জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন ভেঙেছিলেন। তিনি মনে করতেন, শ্রেণি সংগ্রামের কথা বলে রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছে বামফ্রন্ট। তাই চিকিৎসকদের ধর্মঘটের জন্য গরিব মানুষ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাবে না, সেটা মানতে পারেননি। বঙ্গ সিপিএম শূন্যে নেমে যাওয়ায় কি শ্রেণি সংগ্রামের কথাটাই ভুলে গেল? তা না হলে শহুরে মধ্যবিত্ত ভোটের পিছনে ছুটতে গিয়ে কি গরিব মানুষের দুর্ভোগকে উপেক্ষা করতে পারত?
জ্যোতি বসু সেদিন ‘অন্য মিটিং আছে’ বলে ধর্মঘটী চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনা ছেড়ে উঠে গিয়েছিলেন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় চিকিৎসকদের সঙ্গে আলোচনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করলেন। চিকিৎসকরা নবান্নে গেলেন, কিন্তু লাইভ স্ট্রিমিংয়ের দাবি পূরণ না হওয়ায় আলোচনায় বসলেন না। তাতে উঠছে প্রশ্ন, জুনিয়র চিকিৎসকরা কি রাজনীতির বোরে হয়ে গেলেন, নাকি কর্পোরেটের হাতের পুতুল! কর্মবিরতিতে সরকারি হাসপাতাল যত ফাঁকা হচ্ছে, ততই রোগীর ভিড় বাড়ছে বেসরকারি হাসপাতালে।