মেয়াদি সঞ্চয় বা পৈতৃক সম্পত্তি সূত্রে ধনাগম যোগ দেখা যায়। কাজকর্মের ক্ষেত্রে ও আর্থিক দিক ... বিশদ
অর্থনীতি, শুধুমাত্র পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতেই বেহাল নয়। ছবিটা সারা ভারতে উনিশ-বিশ। মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটককে দেশের সবচেয়ে ‘উজ্জ্বল’ দুটি রাজ্য বলে ভাবা হয়। গতবছর কৃষক বিদ্রোহে মলম লাগাতে গিয়ে মোদি সরকার কৃষকদের ‘অন্নদাতা’ সম্বোধনে সম্মানিত করেছে। অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণা সংস্থা ‘স্ট্যাটিসটা’ জানাচ্ছে ২০২৩ সালে দেশে সর্বাধিক সংখ্যক (২,৭০৮) কৃষক আত্মঘাতী হয়েছেন মহারাষ্ট্রে! এই মর্মান্তিক ছবিতে তারপরেই জায়গা করে নিয়েছে কর্ণাটক—গতবছর দক্ষিণের ওই রাজ্যে আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা ছিল ১,৩২৩। দেশের বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশের একটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক খবর প্রকাশিত হয়েছে সোমবারের কাগজে: দুই কন্যাসন্তানকে হত্যা করে আত্মঘাতী হয়েছেন বাবা। ঘটনাটি প্রয়াগরাজের। এক পরিবারের তিন তিনটি তাজা প্রাণ একসঙ্গেই ঝরে যাওয়ার কারণ এই লেখা পর্যন্ত জানা যায়নি, তাই সেই ব্যাপারে কোনও মন্তব্য নয়। তবে, পরিবারটি কোনওভাবেই যে সুখী ছিল না, তা হলফ করেই বলা যায়।
ভালো থাকার জন্য পরিবার পিছু অন্তত একজন রোজগেরে মানুষ চাই। কিন্তু দেশে কাজের পরিবেশ কেমন? বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিএমআইই’র তথ্য বলছে: দেশে বেকারত্বের হার গত মে মাসের ৭ শতাংশ বেড়ে জুনে হয়েছে ৯.২ শতাংশ। কনজিউমার পিরামিডস হাউসহোল্ড সার্ভে অনুসারে, বেকারত্বের হার মেয়েদের মধ্যে ১৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ মহিলা বেকার বাহিনীর আকার পুরুষের অন্তত দ্বিগুণ! সাম্প্রতিক অতীতের পরিসংখ্যান পাশে রাখলে বেকারত্বের বর্তমান হার আরও অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়। ফোর্বস ইন্ডিয়া জানাচ্ছে, বেকারত্বের হার ২০২৩-এ ছিল ৮.০০৩ শতাংশ। সংখ্যাটি ২০২২ ও ২০২১-এ ছিল যথাক্রমে ৭.৩৩ ও ৫.৯৮। ইনস্টিটিউট অফ হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি) এবং ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) যৌথভাবে তৈরি করেছে ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪। তাতে দেখা যাচ্ছে, দেশে কর্মক্ষম যুব বাহিনী ২০১১ সালের চেয়ে অনেকখানি বেড়েছে ২০২১-এ। ওয়ার্কিং পপুলেশন ৬১ থেকে বেড়ে ৬৪ শতাংশ হয়েছে, এবং ২০৩৬ সালের মধ্যে তা ৬৫ শতাংশ হতে যাচ্ছে! অতএব, দেশে পর্যাপ্ত নতুন কাজের সুযোগ বৃদ্ধিই কাম্য। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টো—২০২২ সালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুবদের অংশগ্রহণের সুযোগ কমে হয়ে গিয়েছে মাত্র ৩৭ শতাংশ! মোদিযুগে দেশজুড়ে যুবদের মধ্যে বেকারত্বের বহরটা এর থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
সরকারি চাকরি কার্যত ডুমুরের ফুল! বেসরকারি ক্ষেত্রেও স্থায়ী বা রেগুলার চাকরির জোগান নগণ্য। অতএব, ভরসা অসংগঠিত কর্মক্ষেত্র। স্ট্যাটিসটা’র মতে, ভারতে ৯০ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। জিডিপির ২৭ ভাগ আসে যে এমএসএমই সেক্টর থেকে সেখানকার লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীও অসংগঠিত ক্ষেত্রের লোক বলে গণ্য হন। তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার কোনও বালাই নেই। চলতি অর্থবর্ষ শেষে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭.২ শতাংশ হবে বলে আশার কথা শুনিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু জিডিপি বৃদ্ধির সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি দেখে প্রমাদ গুনছে স্টেট ব্যাঙ্ক, তারা মনে করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের অনুমান মিলবে না, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষ শেষে বৃদ্ধির হার বড় জোর ৭ শতাংশ দাঁড়াবে।
পরিষ্কার যে, জিডিপির স্বাস্থ্যকর বৃদ্ধি কোনও সংগঠিত ক্ষেত্র এনে দিতে পারবে না। তারা আপাতত চূড়ান্ত স্তরেই অবস্থান করছে। তাই অসংগঠিত ক্ষেত্রই অগতির গতি। স্বাধীনতার গোড়ার দিকে, জিডিপিতে কৃষিক্ষেত্রের অবদান থাকত ৫০-৬০ শতাংশ। সেটা কমতে কমতে ২০২২-২৩ সালে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্রের বৃদ্ধির জন্যই এটা হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু অবশিষ্ট কৃষিক্ষেত্র কেমন আছে? পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ নানা জায়গার কৃষকদের নাছোড় আন্দোলনেই রয়েছে এর উত্তর। তাই অর্থনীতির সর্বনাশ রুখতে হলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের বাকি দিকগুলিকে বাঁচিয়ে রাখা ছাড়া উপায় কী? তার মধ্যে পড়ে রাস্তার ধারে খাবার, জামাকাপড়, প্রসাধন ও হস্তশিল্প সামগ্রী বিক্রি। ওইসঙ্গে আছে প্যান্ডেল সজ্জা, পরিবহণ, অতিথি সেবা, নানা ধরনের বিনোদন, পর্যটন প্রভৃতি। এগুলির বেশিরভাগই মরশুমি এবং আঞ্চলিক উৎসব নির্ভর। আমাদের বাংলায় যেমন দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে মাসাধিক কালের শারদোৎসব, তেমনি মহারাষ্ট্রে গণেশ চতুর্থী, উত্তর ভারত জুড়ে দশেরা, দক্ষিণ ভারতে পোঙ্গল কিংবা অসমসহ উত্তর-পূর্ব ভারতে বিহু। এটি বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রেও সত্য। যেমন রিও কার্নিভ্যাল (ব্রাজিল), চেরি ব্লোসম ফেস্টিভ্যাল (জাপান), এডিনবার্গ ফেস্টিভ্যাল (স্কটল্যান্ড), গ্লাস্টনবারি ফেস্টিভ্যাল (ইংল্যান্ড) প্রভৃতি উৎসব দ্বারা সংশ্লিষ্ট অঞ্চল ও দেশের অর্থনীতি বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়।
দুর্গাপুজো তো আর কলকাতাসহ বঙ্গদেশের একার গৌরবের বিষয় নয়, বিশ্ব-ঐতিহ্যের মুকুট এখন তার মাথায়। ইউনেস্কোর ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ শিরোপা লাভের পর থেকে এনিয়ে ভিন রাজ্যের পর্যটকদের পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলিরও আগ্রহ বেড়েছে। গতবছরও কলকাতার পুজোয় অন্যান্য রাজ্যের মানুষের সঙ্গে বহু বিদেশি অতিথির সমাগম লক্ষ করা গিয়েছিল। প্রাচীন বনেদি বাড়িগুলির পুজোর অন্যরকম আকর্ষণ সবসময়ই থাকে। বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজো আয়োজনের বাড়তি আকর্ষণ বাড়ছে তারই পাশে পাল্লা দিয়ে। সেখানে নিত্যনতুন থিমের ছড়াছড়ি। একদিকে বিচিত্র সব প্রতিমা ও মণ্ডপসজ্জা, সঙ্গে থাকে অভিনব আলোর জাদুবাস্তবতা। অভাবনীয় শিল্প নির্মাণ এবং প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে সেসব দর্শনের আশ্চর্য আগ্রহ বাংলাকে এক অনবদ্য অর্থনীতিও উপহার দিয়ে চলেছে।
কলকাতাসহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজোর অর্থনীতি একদশক যাবৎ পণ্ডিত মহলের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। দেশি-বিদেশি একাধিক সংস্থা এর উপর তাদের যেসব রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, সেগুলি আমাদের পক্ষে বিশেষ আশার সঞ্চার করে। রাজ্য পর্যটন দপ্তরের আহ্বানে ২০১৯ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল এক গবেষণা করে। রাজ্যের অর্থনীতির উপর ‘ওয়ার্ল্ডস লার্জেস্ট পাবলিক আর্ট ফেস্টিভ্যাল’-এর প্রভাব কী? এই ছিল তাদের অনুসন্ধানের বিষয়। মূলত যে-দশটি ‘ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি’ এই উৎসবকে সম্ভব করে তোলে, বিদেশি সংস্থাটি তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলির উপরেই গুরুত্ব দিয়ে। তাদের রিপোর্টে দাবি করা হয় যে, শুধুমাত্র ওই দশটি শিল্পক্ষেত্রেই সে-বছর ব্যবসার মোট পরিমাণ ছিল ৩২,৩৭৭ কোটি টাকা (৩.২৯ বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ড বা ৪.৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান)! অঙ্কটি বহু ছোট দেশের সমগ্র অর্থনীতির আকারের সঙ্গেই তুলনীয়। রাজ্যের জিডিপির ২.৫৮ শতাংশ আসে উৎসবের মাত্র একসপ্তাহের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে। রাজ্যে ৩ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছিল সেবারের পুজোয়। অন্য এক সমীক্ষার দাবি, ২০২২ সালের পুজোর অর্থনীতির মোট পরিমাণ ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। অঙ্কটা ৫০ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছিল গতবছর। এবার প্রত্যাশিত ছিল ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানো। ই-কমার্সেও বিশেষ গতিসঞ্চারের আশায় আছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলি।
পুজোর বাকি আর মাত্র তিনসপ্তাহ। কিন্তু অন্যবারের চঞ্চলতা এখনও অধরা। কোনও সন্দেহ নেই, আর জি কর কাণ্ডে বহু মানুষের মন ভালো নেই, বিচারের সংগত দাবি নিয়েই নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু আমাদের এই বাৎসরিক উৎসব নিছক কোনও আনন্দ বা বিনোদনের প্রহর নয়, রাজ্যের অসংখ্য মানুষকে আর্থিকভাবে বাঁচাবারও একটি বড় উপায়। খালি পেটে ধর্মকথা যেমন অমৃতের স্বাদ এনে দেয় না, তেমনি দুর্বল আর্থিক সামর্থ্যও যুদ্ধজয়ের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমরা সবাই কিন্তু জীবনেরও যুদ্ধে লিপ্ত সবসময়। তাই রুটিরুজিকে অবহেলা করার অবকাশ কোথায়? সাম্প্রতিক সমস্যার প্রেক্ষিতে বাংলাসহ দেশের রুগ্ন অর্থনীতি আরও ধসে পড়লে তার শীঘ্র মেরামত সম্ভব হবে কি? তাই আসুন, বিচারের দাবিতে অনড় থেকেই অর্থনীতির চাকাকেও সচল রাখি আমরা।