বিতর্ক শুরু হয়েছিল গোড়া থেকেই। এবার যুক্ত হল স্বচ্ছতার প্রশ্ন। মোদি জমানার দশ বছরে বোধহয় সরকারের সেরা ‘কীর্তি’ সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত। লুটিয়েন্স দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে ইন্দিরা গেট পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই প্রকল্প নিয়ে প্রথম থেকেই প্রশ্ন তুলেছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং পরিবেশবিদরা। এই প্রকল্পের ফলে দিল্লির ৮৬ একর এলাকার সবুজ ধ্বংসের অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন উঠেছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে সংসদ ভবন সহ বিভিন্ন সরকারি অফিস বিল্ডিং কার্যত নতুন করে তৈরির প্রয়োজন কী? তবু প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্বপ্নের এই প্রকল্প দ্রুত ডানা মেলেছে। এই প্রকল্পের অন্তর্গত নয়া সংসদ ভবনের উদ্বোধন হয়েছে গত ২৮ মে। সবুজ ধ্বংস করে সেন্ট্রাল ভিস্তা নির্মাণের প্রয়োজন নিয়ে প্রশ্নের মধ্যে এবার এই প্রকল্পের খরচের স্বচ্ছতা নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। আইন বলছে, সরকারি সম্পত্তি নির্মাণের খরচ জানাতে বাধ্য কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার। কোনও সরকারি প্রকল্পে কত খরচ হল, সংসদে বা বিধানসভায় তার বিস্তারিত তথ্য জানতে চাইতে পারেন একজন সাংসদ বা বিধায়ক। এই একই প্রশ্ন তথ্য জানার অধিকার আইনে সরকারের কাছে জানতে চাইতে পারেন দেশের যে কোনও নাগরিক। বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া সরকার তা জানাতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু মানুষের করের টাকায় গড়ে তোলা সম্পত্তির খরচ জানাতে কোনও সরকার অস্বীকার করলে বুঝতে হবে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চোখধাঁধানো নতুন সংসদ ভবন তৈরি করতেই এক হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে। জনগণের করের টাকার এই মাত্রাতিরিক্ত ‘অপব্যবহার’ নিয়ে ক্ষোভ ছিল প্রায় সর্বত্র। এরই মধ্যে মুম্বইয়ে বসবাসকারী এক প্রবাসী বাঙালি আরটিআই করে নয়া সংসদ ভবনের প্রতিটি খরচের হিসাব জানতে চান। ভিস্তা প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতির নতুন বাংলো তৈরির খরচও জানতে চাওয়া হয়েছিল। এরপরই শুরু হয় বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে ঠেলাঠেলি। গত একমাস ধরে প্রবাসী বাঙালির চিঠি লোকসভার সচিবালয়, সিপিডব্লুডি, নগরোন্নয়ন মন্ত্রক, সংসদের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের কর্তাদের এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ঘোরাফেরা করলেও উত্তর অধরাই থেকে গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে, সোমবার শুরু হতে চলা সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের প্রথম পাঁচ দিনেও এই সংক্রান্ত কোনও প্রশ্নই জমা নেওয়া হয়নি। সেন্ট্রাল ভিস্তা তথা নতুন সংসদ ভবনের খরচ নিয়ে তবে কি কোনও তথ্য আড়াল করতে চাইছে মোদি সরকার? সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরুর মুখে এই প্রশ্নই ঘোরাফেরা করতে শুরু করেছে নতুন ভবনের অলিন্দে।
দেশজুড়ে স্বচ্ছতা অভিযান নিয়ে যিনি সবচেয়ে বেশি সরব সেই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘অস্বচ্ছতার’ অভিযোগ অবশ্য এই নতুন নয়। ভিস্তা প্রকল্পের খরচের মতোই পিএম কেয়ার্স ফান্ড নিয়েও মোদি সরকারের রহস্যজনক আচরণ কারও নজর এড়ায়নি। করোনা মহামারীকালে প্রধানমন্ত্রী একাই পরিত্রাতা— এটা বোঝাতে পিএম কেয়ার্সের জন্ম। দেশ বিদেশের ব্যক্তি, সংগঠন তো বটেই, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের টাকাও এই তহবিলে ঢুকেছে। সরকারি প্রকল্প না হয়েও এই তহবিলে টাকা রেখে একশো শতাংশ কর ছাড়ের সুবিধা মিলেছে। সরকারের তরফেই জানানো হয়েছিল, এই তহবিলের হিসাব পরীক্ষা করতে পারবে না সিএজি বা ক্যাগ। ফলে প্রথম থেকেই অস্বচ্ছতার অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে এই তহবিল। নির্বাচনী বন্ড নিয়েও এমনই অস্বচ্ছতার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরুদ্ধে। আদালত অবশ্য নির্বাচনী বন্ডে জমার হিসাব নির্বাচন কমিশনকে জানানোর নির্দেশ দিয়েছে। এটা ঘটনা যে, বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির জোরালো অভিযোগ রয়েছে। মূলত এই অভিযোগে কর্ণাটক হাতছাড়া হয়েছে গেরুয়া শিবিরের। সেন্ট্রাল ভিস্তা, পিএম কেয়ার্স কিংবা নির্বাচনী বন্ডের মতো তহবিলে হাজার হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। অথচ তার তথ্য প্রকাশ্যে আনতে প্রবল অনীহা নরেন্দ্র মোদিদের। ফলে এই প্রকল্পগুলি নিয়ে যে অস্বচ্ছতার ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে সরকারের মাথা হিসেবে এর দায় এড়াতে পারেন কি প্রধানমন্ত্রী?