আগামী ২৪ ডিসেম্বর শীতের কলকাতায় এক অভিনব আসর বসছে। নিজেদের ‘অরাজনৈতিক’ বলে দাবি করা কয়েকটি সংগঠনের উদ্যোগে ব্রিগেড ময়দানের সেই আসরে লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠ হবে। এই মেগা ইভেন্টে প্রধান পুরোহিত হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। আপ্লুত প্রধানমন্ত্রী নাকি গলা মেলাবেন বলেও জানিয়েছেন। দেশের নানান জ্বলন্ত সমস্যার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কার্যত চোখ বন্ধ করে থাকলেও তিনি যে হিন্দুধর্মের প্রচার ও প্রসারে অতি মাত্রায় সক্রিয়, তার বহু নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে গত দশ বছরে। সুতরাং গীতা পাঠের আসরে প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকার যে আশ্বাস দিয়েছেন তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। একথা সকলেই বোঝে এই কর্মসূচি আসলে আরএসএস বিজেপির মস্তিষ্কপ্রসূত। প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে দিল্লিতে উদ্যোক্তাদের নিয়েও গিয়েছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার। এই প্রতিনিধি দলের মধ্যে ছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কেন্দ্রীয় মার্গ দর্শন মণ্ডলীর এক সদস্যও। তবুও এই ভাবের ঘরে চুরির চেষ্টা! এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদির গদি বাঁচাতে হিন্দুত্বই মূল অস্ত্র গেরুয়া শিবিরের। এবং এই কারণেই জানুয়ারির ২২ তারিখ খানিকটা তাড়াহুড়ো করে রাম মন্দিরের উদ্বোধন করা হচ্ছে। তার আগেই ব্রিগেডে গীতা পাঠের কর্মসূচি, যা আসলে হিন্দুত্ব প্রচারেরই অংশ বিশেষ। বিজেপির লক্ষ্যই হল ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার চরিত্র মুছে দিয়ে এদেশকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। তাই রোটি-কাপড়া-মকানের চেয়ে মন্দির রাজনীতির অনেক বেশি গুরুত্ব পদ্ম নেতাদের কাছে। হিন্দুধর্মের একমাত্র স্বঘোষিত অভিভাবক বলে দাবি করেন মোদি-শাহরা। তাই ভোট বৈতরণী পার হতে রাম নামেই আস্থা রাখছে কেন্দ্রের শাসক দল।
কিন্তু প্রশ্ন অন্য জায়গায়। যদি শুধু হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্বের প্রচারে ভরসা রেখে চোখ বন্ধ করে ভোটে জেতা যায় তাহলে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে এত প্রতিশ্রুতি দেওয়ার প্রয়োজন হল কেন? এমনিতে নরেন্দ্র মোদি ‘রেউডি রাজনীতির’র প্রবল বিরোধী বলে গলার শিরা ফোলান। অথচ ভোটমুখী মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের মতো হিন্দুপ্রধান রাজ্যেও বন্যার মতো প্রতিশ্রুতি বিলি করেছেন স্বয়ং মোদি! প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর তা রক্ষা করা ভিন্ন বিষয়। সন্দেহ নেই, অসত্য প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘ডক্টরেট’ করে ফেলেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৪-তে তাঁর বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি বা প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা আজও ভোলেননি দেশবাসী। আগের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের জন্য জনগণের কাছে কোনও জবাবদিহি ছাড়াই ফের সেই একই ভঙ্গিতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী! আসলে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব হিন্দুত্বের প্রচারে ভরসা রাখলেও জয়ের বিষয়ে তাঁরা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারছেন না। তাই কখনও নগদ বা ছাড়, ঘরবাড়ি, কাজের মতো দেদার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে।
প্রশ্ন আরও। ব্রিগেডে লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠের আসরের প্রেক্ষিতে বঙ্গ বিজেপির কি কোনও লাভ হবে? একথা ঠিক যে, গত লোকসভায় ১৮টি আসন পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল বিজেপি। তারপর থেকেই বামেদের হটিয়ে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে গেরুয়াবাহিনী। সন্দেহ নেই, মোদি জমানায় চড়া সুরে হিন্দুত্বের প্রচারে এ রাজ্যে কিছু ভোটব্যাঙ্ক তৈরি হয়েছে পদ্মশিবিরের। কিন্তু ঘটনা হল, বঙ্গ বিজেপির তিনজন নেতাই একসঙ্গে মিলেমিশে চলতে পারেন না। এখনও রাজ্যের বেশিরভাগ বুথে বিজেপির প্রায় কোনও সংগঠন গড়ে ওঠেনি। তবু রাজ্য থেকে গ্রামস্তর পর্যন্ত এই দলের মধ্যেকার বিরোধ, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, আকচা-আকচি (দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে অনেকসময় যা হয়) দেখলে ভ্রম হবে রাজ্য সরকারে বোধহয় বিজেপিই রয়েছে। মজার বিষয় হল, যে দিন গীতা পাঠের নিমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে মোদিকে, সেদিন দিল্লিতে বসে বিজেপির অন্যতম কেন্দ্রীয় সম্পাদক অনুপম হাজরা দলের রাজ্য নেতৃত্বকে তোপ দেগে বলেছেন, ‘বর্তমান নেতাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে গেলে ৩৫টি আসনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া সম্ভব নয়।’ তাঁর মুখে নেতাদের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও শোনা গিয়েছে। ফলে মন্দির উদ্বোধন, গীতা পাঠ বা এই ধরনের প্রচার মোদিকে ফের ক্ষমতায় বসাবে, বঙ্গ বিজেপিকে একসূত্রে বেঁধে দেবে— এমন ভাবাটা কষ্টকল্পিত। তাই মেরুকরণে মরিয়া পদ্মশিবির যতই হিন্দুত্বের হুঙ্কার ছেড়ে ২৪-এর ভোটের জন্য জমি তৈরির চেষ্টা করুক তাদের উদ্দেশ্যসিদ্ধি আদৌ হবে কি না তা লাখ টাকার প্রশ্ন হয়েই রয়ে গিয়েছে।