শরীর থেকে একে একে বসন ভূষণ খসে পড়ছে। বেরিয়ে আসছে ভিতরের কদর্য চেহারা। ভোটে হারার মাত্র ছ’মাসের মধ্যে বিজেপির হালহকিকত তাই। অনায়াসেই বলা যায় রাজা তোর কাপড় কোথায়? খবরে প্রকাশ, বর্ধমান জেলার কাটোয়ার দাঁইহাটে গেরুয়া শিবিরের কর্মীরা নিজেদের মধ্যে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লেন। চলল যথেচ্ছ ভাঙচুর, গালিগালাজ। দলের সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষকে হেনস্তা করা হল দলের রাজ্য সভাপতির সামনেই! ক্ষুব্ধ দিলীপবাবু নাকি নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে লাঠিচার্জ করার হুমকি দিয়েছেন। বাংলায় সর্বভারতীয় এই দলটির হাল দেখে মনে হতেই পারে বিজেপিতে এখানে মুষল পর্ব শুরু হয়েছে। বর্ধমান অবশ্য আগেও শিরোনামে উঠে এসেছে। গত বিধানসভা ভোটের আগে প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পরেই সেখানে বিজেপি’র দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, মারামারির ঘটনা ঘটে। তখন দলের কয়েকজন কর্মীকে সাসপেন্ডও করা হয়। তারপরও এমন ঘটনা ঘটায় বোঝাই যাচ্ছে বিজেপি’র রাজ্য নেতৃত্ব ক্রমশই দলীয় কর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। বিজেপি সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিশালী একটি দল হিসেবেই পরিচিত। বাংলায় গোহারা হওয়ার পর তাদের সেই শক্তি ক্রমশই যে তলানিতে এসে ঠেকছে তাও স্পষ্ট। সোনার বাংলা গঠনের স্বপ্ন দেখিয়ে যে দলটি বাংলা দখলের পরিকল্পনা করেছিল, ভোটে হারার পর তারাই এখন গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জেরবার। বাংলায় মানুষ এখন বুঝতে পারছেন, এদের ক্ষমতায় না এনে তাঁরা কোনও ভুল করেননি। যদিও বিজেপিতে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নতুন নয়। সেসব ধামাচাপা দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে হটিয়ে রাজ্যে ক্ষমতা দখলের হুংকার ছেড়ে তারা দামামা বাজানো শুরু করেছিল গত বছর থেকে। নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ থেকে দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসুরা একসুরে ক্ষমতা দখলের প্রচার চালিয়ে গেছেন উচ্চগ্রামে। আর তাতেই নতুন ক্ষমতার গন্ধ পেয়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের একাংশ বেসুরো হয়ে বিজেপি শিবিরে নাম লেখায়। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় আদি আর নব্য’র গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ভোটে পরাজয়ের পর যা এখন বিস্ফোরণের রূপ নিয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিজেপি’র কেন্দ্রীয় পদাধিকারীদের তালিকা প্রকাশের পরই প্রকাশ্যে চলে আসে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। সেদিনও আদিরা কোণঠাসা বলে অভিযোগ তোলে। বিভিন্ন জেলার দলীয় কার্যালয়ে দেদার মারামারিও হয়। আসলে তৃণমূলকে কোণঠাসা করতে দল ভাঙানোর খেলায় মেতে উঠে ‘ফ্লাড গেট’ যেভাবে বিজেপি খুলে দিয়েছিল তার ফল ভুগতে হচ্ছে এখন। বাড়ছে দলের মধ্যে অন্তর্কলহ। বিজেপি একটি শৃঙ্খলাপরায়ণ আদর্শবাদী দল বলে পরিচিত হলেও পার্টির রাজ্য ও জেলাস্তরের একাধিক নেতা তাঁদের অনুগামীদের নিয়ে গোষ্ঠী তৈরি করে নিজেদের মতো চলছেন। তাই ঘুচে যাচ্ছে শৃঙ্খলাপরায়ণ দলের তকমাটিও। সবই যেন বেআব্রু হয়ে পড়ছে। না হলে যাঁর আদর্শকে সামনে রেখে এই দলটি পরিচালিত হয় সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ছবি পর্যন্ত ছুড়ে ফেলার সাহস দেখাতে পারে কিছু দলীয় কর্মী! অবাক করা কাণ্ড।
আসলে ভোটে হারার পর রাজ্য বিজেপি’র কোমর ভেঙে নুইয়ে পড়েছে। ভোটের আগে যেমন স্রোতের মতো নেতা-কর্মী তাদের শিবিরে নাম লিখিয়েছিল, হারের পর তৃণমূলে চলে যাওয়ার স্রোত যেন একই গতিতে অব্যাহত। তাই এই ক’মাসে বিধায়ক সংখ্যাও ৭৭ থেকে নেমে হয়েছে ৭১। এখনও দল ছাড়ার জন্য অনেকেই পা বাড়িয়ে আছেন। ভোটে লজ্জাজনক পরাজয়ে দিশেহারা বিজেপিতে কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে, আর সেসব সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে তৃণমূলের দিকে দায় ঠেলে দেওয়ার চেষ্টাও করছেন নেতারা। প্রায় রোজই প্রকাশ্যে কোনও না কোনও নেতা-নেত্রী একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছেন। কেউবা ভোটে হারের জন্য তৃণমূল ভাঙিয়ে দলে দলে যোগদান করানো নীতির সমালোচনা করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে কার্যত কাঠগড়ায় তুলছেন। এ সবই হচ্ছে প্রকাশ্যে। বোঝাই যাচ্ছে, নেতৃত্বের রাশ আলগা হয়ে গেছে। সাংগঠনিক শক্তির বিচারে এই রাজ্যে বিজেপি ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে।
ভোটের পর সব হারানো বামেদের সঙ্গে তাদের বিশেষ ফারাক দেখা যাচ্ছে না। কতিপয় নেতার অবস্থা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। পরিস্থিতি এতই খারাপ যে অকথা-কুকথায় যিনি দৃষ্টান্তস্বরূপ হয়ে উঠেছেন সেই দিলীপ ঘোষকেও শুনতে হচ্ছে অশ্লীল গালিগালাজ, গো ব্যাক স্লোগান, এমনকী তুই-তুকারি পর্যন্ত। আগামী ডিসেম্বরে রাজ্যের শতাধিক পুরসভার নির্বাচন হতে পারে। নিজেদের ওজন বুঝে বামেরা সব পুরসভার সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পারবে না বলে নাকি ইতিমধ্যে ঘনিষ্ঠমহলে জানিয়ে দিয়েছে। বিজেপি এমন কোনও কথা বলেনি ঠিকই, কিন্তু তাদেরও পরিস্থিতি যা তাতে সব ওয়ার্ডে প্রার্থী দেওয়ার মতো শক্তি থাকবে কি না সন্দেহ। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জীর্ণ রাজ্যের গেরুয়া শিবির কি প্রতিটি পুরসভার প্রত্যেক ওয়ার্ডে প্রার্থী দেওয়ার উপযুক্ত লোক খুঁজে পাবে? তা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। কারণ দিন যত গড়াচ্ছে দলীয় অন্তর্কলহ ক্রমশই উচ্ছৃঙ্খলার রূপ নিচ্ছে। যেন মুষল পর্ব শুরু হয়ে গেছে রাজ্য বিজেপি’র অভ্যন্তরে।