ওজন ১৪০০ কেজি। হেমন্তের হিমেল হাওয়ায় এমন বিশালাকার ত্রিবর্ণ পতাকা লালকেল্লার প্রাচীর ঘিরে যেন ডানা মেলেছে। দিল্লির লালকেল্লা, কুতবমিনার থেকে বাংলার হাওড়া ব্রিজ, মেটকাফ হল, কারেন্সি বিল্ডিংয়ের মতো দেশের একশো সৌধ সেজে উঠেছে বাহারি আলোয়। রেল স্টেশনের মাইকে গর্বের প্রচার চলছে, বিমানের গায়েও সেঁটে দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ছবি। দেশের কোনায় কোনায় এই দৃশ্য কোনও বিশ্বকাপ জয়ের উদযাপন উপলক্ষে নয়। করোনা টিকার ১০০ ডোজ পার করেছে আমাদের দেশ। অতএব এই ‘সাফল্যের’ দাবি জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপির তরফে শুরু হয়েছে উদযাপন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠক থেকে গ্রাম-শহরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মোদি বন্দনা। তাঁর ‘দূরদর্শী’ পদক্ষেপের জন্যই এই সাফল্য, বলছে পারিষদ বর্গ। নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে বারবার এমন সর্বগ্রাসী প্রচার দেখেছে ভারতবাসী। সন্দেহ নেই, প্রকৃত সত্যকে আড়ালে রেখে এমন চমকপ্রদ প্রচারে অন্তত ভোটের রাজ্যে কিছুটা হলেও ফায়দা ওঠে। ১০০ কোটি টিকার ডোজ সম্পন্ন হওয়া নিঃসন্দেহে একটি নজির। যদি এটাকে ‘সাফল্য’ ধরতে হয় তাহলে তার ভাগীদার একা মোদি নন। দেশের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের প্রশাসক, লক্ষ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী এই নজির সৃষ্টির মূল কারিগর। অথচ সাফল্যের প্রচারে আলো ফেলা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর মুখে। গেরুয়া বাহিনীর চমকপ্রদ ‘সাফল্য’ উদযাপন দেখে বোঝার উপায় নেই বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের এর পিছনে অবদান কতখানি। ভারতে করোনা টিকাকরণের ইতিহাস যা তাতে ১০০ কোটি টিকাকরণ নজির সৃষ্টি করলেও কখনওই তা নিয়ে মাতামাতি করার মতো পরিস্থিতি বোধহয় আসেনি। কারণ এ পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন মাত্র সিকিভাগ মানুষ। সর্বোপরি ঢাকঢোল পেটালেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় মোদি সরকার বারবার যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভ্যাকসিনের অনুমোদন, টিকার সরবরাহ নিয়ে রাজ্যগুলির সঙ্গে বিরোধ, টিকার অভাব ঢাকতে দুটি ডোজের মধ্যের সময়কাল বাড়িয়ে দেওয়া, এই ভ্যাকসিনকে আংশিকভাবে বাজারে পণ্য করে তোলার দায় এড়াতে পারে না মোদি সরকার। বস্তুত করোনার টিকাদান নিয়ে চূড়ান্ত অব্যবস্থার শিকার হয়েছে দেশবাসী। কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের পরিকাঠামোর অভাব, অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু, দাহ সম্পন্ন করার পরিকাঠামো না থাকায় গঙ্গায় ‘লাশ’ ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা এই সেদিনকার একদিন-প্রতিদিনের ছবি। ব্যর্থতা নিয়ে গোটা দেশে যে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল তা সামাল দিতে শেষপর্যন্ত তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধনকে সরে যেতে হয়।
মোদি সরকার টিকার ১০০ কোটি ডোজ সম্পন্ন করেছে বলে যে হল্লা জুড়েছে সেই সত্যে জলের ভাগই বেশি। বলা ভালো, যে দাবিতে গেরুয়া বাহিনী উদ্বাহু হয়ে প্রচারের ঢক্কানিনাদ বাজাচ্ছে তাতে অনেকাংশেই সত্যের অপলাপ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, টিকাকরণে সাফল্য মানে প্রতিষেধকের দুটি ডোজ সম্পন্ন হওয়া। দেহে ভাইরাস প্রতিরোধক ইমিউনিটি গড়ে উঠবে দুটি ডোজ টিকা নেওয়ার পরেই। অথচ কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী দেশে মাত্র ২১ শতাংশ (৩০ কোটি) মানুষ ভ্যাকসিনের দুটি ডোজ পেয়েছেন। এটা আদৌ সন্তোষজনক নয়। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন ওঠে, কীসের সাফল্যের ঢাক পেটাচ্ছে মোদি বাহিনী? সরকারি হিসাবেই দেশের ৭১ কোটি মানুষ পেয়েছেন একটি ডোজ। চোখে ধুলো দিতে প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ সম্পূর্ণ করার হিসাবকে যোগ করে ১০০ কোটি টিকাকরণের সাফল্যের সাতকাহনে মেতেছেন দিল্লীশ্বরেরা। সাফল্য হিসাবে প্রচার করা হচ্ছে, চীনের পর দ্বিতীয় দেশ ভারত, যারা সবচেয়ে বেশি টিকা দিল। অথচ প্রায় ১৪০ কোটির বিপুল জনসংখ্যার কারণেই যে এই নজির তৈরি হল তা বেমালুম চেপে যাওয়া হচ্ছে। চেপে যাওয়া হচ্ছে দুটি ডোজের সম্পূর্ণ ভ্যাকসিন দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের স্থান ১৯ নম্বরে। ঘটনা হল, দেশের ৩২ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এখনও পর্যন্ত একটি ডোজও পাননি। সব মিলিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক সব নাগরিককে দুটি ডোজ টিকা দিতে এখনও ১০৬ কোটি টিকা বাকি, যা কেন্দ্রের ঘোষণা অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা। কিন্তু তা আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে অবশ্য কোনও উচ্চবাচ্য নেই! এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ১৮ বছরের নীচের অপ্রাপ্তবয়স্কদের টিকাকরণ এখনও শুরুই করতে পারেনি মোদি সরকার। এসব উহ্য রেখেই মোদি বাহিনী নেমেছে ১০০ কোটি ডোজ সম্পন্ন হওয়ার উদযাপনে। কারণ উত্তরপ্রদেশ-সহ পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন যে সামনেই। তাই সরকারের ভাবমূর্তি ফেরানোর ঢালাও আয়োজন!
এর জন্য আনন্দে আটখানা উৎসবে মাতলে ক্ষতি নেই, কিন্তু আত্মতুষ্টি এলেই বিপদ। সরকারের ভাবা উচিত, করোনার ছোবলে দেশের প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মৃত মানুষের পরিবারগুলির কথা। তাঁদের জন্য সরকার কী করবে? চাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। সরকার সদয় ও মানবিক না-হলে, পরিবারগুলিতে নেমে আসা আঁধার এই আলোর রোশনাইও কাটাতে পারবে না। উজ্জ্বল হবে না সরকারের ভাবমূর্তি।