পারিবারিক ক্ষেত্রে বহু প্রচেষ্টার পর শান্তি প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। সন্তানের কর্ম উন্নতিতে আনন্দ লাভ। অর্থকর্মে শুভ। ... বিশদ
বেলা গড়িয়ে দুপুর হলেও রোদের তেমন তেজ নেই। জোলো হাওয়ায় শিরশিরানি ভাব আছে বেশ। রংচটা লাল গামছা দিয়ে গা মুছে প্রথমে সূর্যদেব ও তারপর মা গঙ্গাকে প্রণাম করলেন। প্রণাম-প্রার্থনা শেষ করে ঘুরতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘পুণ্য পূর্ণ হল?’ জবাবে একগাল হাসলেন দেবেন্দ্র। নীচের পাটির দুটো দাঁত নেই। হাসলে জিভ একটু বেরিয়ে আসে। বললেন, ‘গত বছর গঙ্গাসাগরে গিয়েছিলাম। আর এবার এখানে আসার আগে বেনারস। সেখানে দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান করেছি। গতকাল আর আজ এখানে। শরীরের যা অবস্থা, আর হয়তো আসা হবে না। তবে এবার মরলেও শান্তি।’ অনেকেই বিশ্বাস করেন, কুম্ভের এই পুণ্যলগ্নে ইহধাম ত্যাগ করলে নাকি সাক্ষাৎ স্বর্গবাস। বয়স-অসুস্থতা ভুলে সেই বিশ্বাসের টানেই ছুটে আসে মানুষ। পুণ্যতীর্থ প্রয়াগে। সেখানে মুছে যায় মানুষে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক পার্থক্য। ধনী-দরিদ্র, সংসারী-সন্ন্যাসীর পার্থক্য ঘুচিয়ে সকলকে মিলিয়ে দেয় গঙ্গা। পুণ্যসলিলা সেই নদীতে বারণ সত্ত্বেও প্রদীপ, ফুল ভাসালেন? ‘ওঁরা তো মানা করবেই। কিন্তু এটাই তো পদ্ধতি। সবাই করে। না হলে পুণ্য হতো নাকি!’ নির্বিকার দেবেন্দ্র। পুণ্য অর্জনের বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস কোনও বিধিনিষেধের তোয়াক্কা করে না। তবে এই দোষে দেবেন্দ্র একা নন দুষ্ট নন। সরকারি নিষেধ থাকার পরেও বহু মানুষের ‘সৌজন্যে’ দূষিত হচ্ছে গঙ্গা। সঙ্গমে নজরদারি একটু কড়া। তাই ১০ থেকে ১৬ নম্বর পন্টুন ব্রিজ পর্যন্ত যেখানে সুযোগ পাচ্ছেন, সেখানেই গঙ্গায় ফুল-প্রদীপ ভাসাচ্ছেন তাঁরা।
যাদব পরিবারের সঙ্গে আলাপচারিতার সেরে ফেরার সময়েই চোখ আটকে গেল জটাধারী সাধু মহারাজে। মগ্ন হয়ে মাটির শিবলিঙ্গ তৈরিতে ব্যস্ত। পাশে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাটির প্রলেপ আঙুলের ছোঁয়ায় অভিষ্ট রূপ পেল। সেদিকে চোখ রেখেই বললাম, ‘গঙ্গা তো বহু জায়গাতেই আছে। সর্বত্রই তার অপার মহিমা। তবুও পুণ্যের লোভে মানুষ তীর্থস্নানে ছুটে আসেন কেন?’ আঙুলগুলি থামল মুহূর্তে। কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মোহন্ত শিবানন্দ গিরি মহারাজ। তারপর মাটিতে হাত মুছতে মুছতে বললেন, ‘কুম্ভস্নানে পুণ্যলাভ হয়। তাই সারা পৃথিবী এখানে ছুটে আসে। মা গঙ্গার আশীর্বাদ বুকে নিয়ে ফিরে যায় সংসারে। পাপ ধুয়ে এই পুণ্যটুকুই তাদের আসল সঞ্চয়। আবার কেউ কেউ গঙ্গার কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণ করে সর্বশক্তিমানের কাছে। তারা আর সংসারে ফেরে না।’
একটু থেমে বললেন, ‘জগত জানায়ো জিহি সাকাল সো জাগ জানিয়ো নাহি/ জিয়ো আঁখি সব দেখিয়ে আঁখি না দেখি জাহি।’ সন্ত কবীরের কথা। কিন্তু এখন, এখানে, হঠাৎ! বুঝতে পারিনি বুঝে বললেন, ‘মা গঙ্গা সকলের পাপ ধুয়ে দেন। কিন্তু আমরা সবাই মিলে যে প্রতিনিয়ত গঙ্গাকে দূষিত করে চলেছি, সেই পাপ ধোয়া হবে কীভাবে?’ উত্তরে সরকারি উদ্যোগ, ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনালের নির্দেশের মতো অনেক ভারী ভারী কথা বলা যেত। কিন্তু একটু আগেই বারণ উড়িয়ে দূষণের যে চিত্র চোখে পড়েছিল, সেকথা ভেবে আর কিছুই বললাম না। তাকিয়ে থাকলাম ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে’র দিকে।
সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই।