বিকিকিনি

পঞ্চচুল্লির পাদদেশে

মুন্সিয়ারি থেকে যেবার প্রথম পঞ্চচুল্লি পর্বত দর্শন করেছিলাম সেবার পাহাড়ের বিশালতার সামান্য আন্দাজ পেয়েই মন ব্যাকুল হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা ‘কপালকুণ্ডলা’-র নায়ক নবকুমারের মতো বলতে ইচ্ছে করেছিল, ‘আহা! কি দেখিলাম! জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না।’ এবার তাই ভ্রমণের শুরু থেকেই রোমাঞ্চ অনুভব করছি মনে মনে। যে পঞ্চচুল্লিকে দূর থেকে দেখেই মুগ্ধ হয়েছি, তাকেই এবার আরও কাছ থেকে দেখব। তার পাদদেশ পর্যন্ত যাব। পর্বতের বিশালতার সাক্ষী হব। 
তার গায়ের প্রতিটি পরত, পাথরের সবগুলো ভাঁজ ধরা পড়বে খালি চোখেই। ভেবেই এক অজানা উত্তেজনায় ভরে যাচ্ছে মন। 
এযাত্রা কলকাতা থেকে গাড়ি নিয়ে পাড়ি জমিয়েছি সুদূর উত্তরাখণ্ড। ভারত-তিব্বত সীমান্তে আদি কৈলাস ও ওম পর্বত দর্শন শেষে দর্মা গ্রাম থেকে পঞ্চচুল্লির পাদদেশ দর্শন, এমনই ইচ্ছা আমাদের মনে। ইতিমধ্যেই আদি কৈলাস ও ওম পর্বত দর্শন সারা হয়ে গিয়েছে। এবার যাত্রা পঞ্চচুল্লির উদ্দেশ্যে। ভীষণ খারাপ রাস্তায় নাচতে নাচতে চলেছে গাড়ি। আর গাড়ির ভিতর মুড়ির মতো ঝাঁকুনি খেতে খেতে চলেছি আমরা। পথ কোথাও ভাঙা, কোথাও বা মেরামতের কাজ চলছে আবার কোনও অংশ নতুন করে তৈরি করা হচ্ছে। পাহাড় ফাটিয়ে নতুন রাস্তা বানানোর কাজ চলছে বলে পাথরগুলো ছড়িয়ে রয়েছে এলোমেলো। কোথাও বা বিশাল বপু দিয়ে রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বুলডোজার। সেই ভাঙাচোরা পথের পাশ কাটিয়ে চলেছি আমরা। একপাশে পাহাড়ের রুক্ষতা অন্য পাশে নদীর তীব্র গর্জন। আমাদের সঙ্গে চলেছে ধলা গঙ্গা। নদীর জল শ্বেতশুভ্র। তার উচ্ছ্বল বয়ে চলার পথে নুড়ি পাথর থেকে বড় বোল্ডার সবই পড়ছে। তার উপর দিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে এগিয়ে চলেছে ধলা গঙ্গা। জলের প্রবল বেগের মুখে পাথর পড়লে ফেনার সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বা জলের তোড়ে পাথরগুলো ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। ছোট টুকরোগুলো জলের স্রোতের সঙ্গেই ভেসে যাচ্ছে খানিক দূর। তারপর হঠাৎই কোথাও পলিমাটির গায়ে আশ্রয় খুঁজে নদীর বুকেই বসত বানিয়ে নিচ্ছে। রুক্ষ পাহাড়ি ব্যাকড্রপে এই নদী যেন কনট্রাস্ট তৈরি করে এগিয়ে চলেছে আপন মনে। 
দিনের আলো সবেমাত্র পড়বে পড়বে করছে, এমন সময় আমরা পৌঁছলাম দর্মা গ্রাম। পঞ্চচুল্লির পাদদেশে ছোট্ট এই গ্রাম। আর সেই গ্রামের রক্ষক পঞ্চচুল্লি। পাহাড়ের সে কী অসম্ভব বিশালতা! সাদা বরফ ঝকঝক করছে পাহাড়ের গায়ে। মনে হচ্ছে যেন রুপোর পাত বসানো। হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে ফেলব বুঝি পাহাড়টাকে। এই পর্বতশৃঙ্গের একদিকে মুন্সিয়ারি অন্যদিকে দর্মা। মাঝখানে বিশাল দেহ নিয়ে মাথা উঁচু করে খাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে পঞ্চচুল্লির পাঁচটি শৃঙ্গ। পঞ্চচুল্লির গা ঘেঁষে মেঠো পথে গ্রাম দুটোর মধ্যে যাতায়াতের রাস্তা আছে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সেই পথে যেতে সময় লাগে মোটামুটি দিন দুয়েক। 
পর্বতশৃঙ্গের এমন নামকরণের পিছনে পৌরাণিক একটা গল্প জনপ্রিয়। পাহাড়ের পাঁচটি শৃঙ্গকে উনুনের হিসেবে কল্পনা করে বলা হয় দিনান্ত বেলায় দ্রৌপদী নাকি তাঁর পাঁচ স্বামীর জন্য উনুনে আঁচ দিয়ে রান্না চড়ান। আর তখনই পঞ্চচুল্লির পাঁচটি শিখরে আগুন জ্বলে ওঠে। সূর্যাস্তের শেষ লালিমায় সাদা বরফ রক্তিম হয়ে ওঠে। পঞ্চচুল্লিকে সাক্ষী রেখে অস্তাচলে ডুব দেন সূর্যদেব। সে এক অপূর্ব দৃশ্যই বটে। মুন্সিয়ারি থেকে দেখা যায় সেই দৃশ্য। পড়ন্ত বিকেলে শ্বেতশুভ্র পাহাড়ের ঝকঝকে বরফের গায়ে সূর্যাস্তের প্রথম রং যখন ধরে তখনও তার তেজ একটুও ফিকে হয় না। গাঢ় হলদে রঙের পরত লাগলে মনে হয় সোনা যেন গলে পড়ছে পাহাড়ের গা বেয়ে। ক্রমশ সেই সোনালি রং একটু একটু করে লালচে হতে থাকে। হঠাৎ দেখলে সত্যিই মনে হয় উনুনে আঁচ দেওয়া হয়েছে বুঝি। গাঢ় হলুদ থেকে কমলা, তারপর লাল, তারপর গোলাপি হয়ে হঠাৎ ছাই রঙে ঢেকে যায় পাহাড়শ্রেণি। রঙের পরত সরে গেলে পাহাড়ের গায়ে সন্ধে নামে একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছেও ভেবেছিলাম এমনই অভিজ্ঞতার সাক্ষী হব আরও একবার। কিন্তু বিকেল গড়িয়ে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নামল পাহাড়ের গায়ে, অথচ সূর্যাস্তের লালিমা দেখতে পেলাম না। বরং বিকেলের পড়ন্ত আলোয় সাদা ঝকঝকে পঞ্চচুল্লিকে দেখলাম একটু একটু করে ধূসর হতে হতে অন্ধকারে ঢেকে গেল। আমাদের রিসর্ট, দর্মা হাইটস-এর এক কর্মচারী জানাল, পাহাড়ের উল্টো দিকে এসে গিয়েছি আমরা। তাই মুন্সিয়ারির দৃশ্য এখানে মিলবে না। তাই বলে এই সৌন্দর্য যে নেহাত কম তাও নয়। ক্রমশ সন্ধে নামলেও আকাশের সাদা মেঘের গায়ে সূর্যের রঙের ছটা পুরোপুরি ম্লান হয়নি। সেই আলোয় শেষবারের মতো দেখে নেওয়া যায় পঞ্চচুল্লির পাঁচটি শিখর। তারপরেই ঝুপ করে রাত নামে। অন্ধকারে ঢেকে যায় চারপাশ। আর তখনই একটু একটু করে জ্বলে ওঠে গ্রামের ঘরবাড়ি, দোকান, হোটেল বা হোমস্টেগুলো। মনে হয় পাহাড়ের পায়ের কাছে অজস্র জোনাকি যেন পাখনা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। আর তারপরেই তারার আলোয় ভরে যায় আকাশ। বিশালাকার পঞ্চচুল্লির মাথার উপর হাজার তারার মেলা বসে। সেই আলো আকাশপথে একটু একটু করে নেমে আসে পাহাড়ের উপর। তারার নীলচে আলোয় এক অন্যরকম রূপকথার সৃষ্টি হয় চোখের সামনে। 
সূর্যাস্তের শেষ রংটুকু না লাগলেও দর্মা থেকে পঞ্চচুল্লির উপর রোদের প্রথম কিরণ দেখার মতো। না, পাহাড়ের গায়ে সূর্য ওঠে না। কিন্তু তার আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়ে পর্বত শিখরে। সেই শোভা থেকে চোখ ফেরানো দায়। বরফাবৃত পাহাড়চূড়ায় সূর্যের আলো যেন সোনার মুকুটের মতো ঝলমল করে ওঠে। ভারি অপরূপ সেই রূপমাধুরী। গ্রামের পথে রোদের আলো পড়েছে, সেই আলো অনুসরণ করে আমরা চলেছি মেঠো পাথুরে পথ দিয়ে পায়ে হেঁটে, একেবারে পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত। মোটামুটি দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার হাঁটা পথে পৌঁছলাম পঞ্চচুল্লির পায়ের কাছে। পাহাড়ের বিপুলায়তনের সামনে ক্ষুদ্র লাগছে সবকিছু। গাঢ় ছায়া পড়েছে পাহাড়ের ঠিক নীচে। মাথা উঁচু করেও পঞ্চচুল্লির বিশালতার নাগাল পাওয়া অসম্ভব। মন শুধু বলল, ‘হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে  যাহা-কিছু সব আছে আছে আছে—/নাই নাই ভয়, সে শুধু আমারই, নিশিদিন কাঁদি তাই।’ 
কমলিনী চক্রবর্তী 
ছবি:আনন্দরূপ বিশ্বাস
5d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কর্মের উন্নতি হবে। হস্তশিল্পীদের পক্ষে সময়টা বিশেষ ভালো। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মের প্রসার। আর্থিক দিকটি অনুকূল।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.৮০ টাকা৮৬.৫৪ টাকা
পাউন্ড১০৫.৩৬ টাকা১০৯.০৯ টাকা
ইউরো৮৭.০০ টাকা৯০.৩৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা