বিদ্যা ও কর্মে উন্নতির যুগ অর্থকরি দিকটি কমবেশি শুভ। মানসিক চঞ্চলতা ও অস্থিরতা থাকবে। স্বাস্থ্যের ... বিশদ
‘সুরজিৎ, প্লিজ এবার ফোনটা ধরিস..’
ইংরেজি গান শুনে বড় হয়েছি। স্কুলের পাঠ শেষ করে কলকাতায় এসে সেই ইংরেজি গানই করতে শুরু করেছিলাম। সেটা আটের দশকের শুরু। একই গান, সঙ্গে ঘ্যাঙর ঘ্যাঁঙ বাজনা। হঠাৎ করে একদিন রিহার্সালে বাংলা গান হল। বাকিটা ইতিহাস। অনেক ঝড় ঝাপ্টা, প্রশংসা-সমালোচনা পেরিয়েছি। চুলে পাক ধরেছে। বেড়েছে বয়সও। তবে এখনও ভূমির হয়ে মঞ্চে উঠলে ২০ বছর আগের সৌমিত্র হয়ে যাই। হুট করে যেন পুরনো দিনটা ফিরে আসে। কেমন ছিল শুরুর সেই দিনগুলো? বর্তমান বিনোদনের পাঠকদের আজ সেই কথাই জানাব।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি। ওয়েস্টার্ন মিউজিক নিয়ে তুমুল ব্যস্ত তখন। কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে জমিয়ে রিহার্সাল চলছে। বেস গিটারিস্ট দীপঙ্করের সঙ্গে একটি লম্বা রোগা ছেলে রিহার্সালে আসতে শুরু করল। চুপ করে বসে আমাদের গান বাজনা শুনত। সেই ছেলেটাই হঠাৎ একটা বাংলা গান ধরল। আমি হারমনি করলাম। যেন ম্যাজিক হল। ছেলেটির নাম সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়। সেই শুরু হল আমাদের একসঙ্গে গানবাজনা। ইংরেজি গানের বদলে জায়গা নিল ওঁর আর আমার লেখা কয়েকটা বাংলা গান, সঙ্গে প্রচলিত লোকগীতি। তখনও বাংলা ব্যান্ড করার সিদ্ধান্ত নিইনি। গান করছি নিজেদের মনের খিদে মেটানোর জন্য। রিহার্সালে আসত সাংবাদিক সদ্যপ্রয়াত প্যাট্রিক ঘোষ। প্যাট্রিকই আমাদের প্রথম গানকে সিরিয়াসলি নিতে বলেছিল। ওঁর কথাতে এবং ওঁর টাকাতেই আমাদের প্রথম ডেমো রেকর্ডিং। কান্দে শুধু মন, রঙ্গিলা আর দে না গো- এই তিনটি গান রেকর্ড করে আবার আমরা যে কে সেই।
এরপর বন্ধুদেরই ডেমো ক্যাসেটটা যেই শোনাচ্ছি ওমনি দেখছি সেটা কপি করে নিচ্ছে। প্রশংসাও করছে। সুরজিৎকে বললাম, চল একসঙ্গে কিছু বাংলা গান তৈরি করে গাই। কিন্তু, সুরজিৎ নিমরাজি। বেশ কিছুদিন ওঁর পিছনে লেগে থেকে তৈরি হল আমাদের ব্যান্ড। এবার শ্রোতাদের কাছে পৌঁছনোর পালা। ডেমো ক্যাসেট নিয়ে ছুটলাম স্পন্দনের রেণু রায়ের কাছে। রেণুদি একটা গান শুনেই বলে দিলেন, হলের ব্যবস্থা করে দেবেন। টিকিটও ছাপিয়ে দেবেন। হল ভরানোর দায়িত্ব আমাদের। এবার পালা নাম ঠিক করার। সুরজিতের সঙ্গে ওর বান্ধবী (এখন স্ত্রী) কমলিনী আমাদের রিহার্সালে প্রায়ই আসত। ওই একদিন ‘ভূমি’ নামটা বলে। আমরা রাজি হয়ে যাই। তারপর এল সেই দিন...২৪ জুলাই, ১৯৯৯। জ্ঞানমঞ্চে পর্দা উঠতেই দেখলাম হল ভর্তি। সামনের আসনে বসে সম্পর্কে আমার মামি অপর্ণা সেন। প্রথম গান নাও ছাড়াইয়া দে... । অত লোক দেখে নার্ভাস হয়ে সেটা গাইলাম হাল ছাড়াইয়া দে। দর্শকরা ভুলটাতো ধরতে পারলেনই না উল্টে তুমুল হাততালিতে আমাদের এনার্জি বাড়িয়ে দিলেন। আমি গানের পাশাপাশি কঙ্গা বাজালাম। সুরজিৎ গিটার আর গান। শুভেন খলজিরা, সঞ্জয় পারকাশন, বাম্পি কি-বোর্ড। গিটারে টুকি, আর বেসে অভিজিৎ ঘোষ। যাই হোক, শো সুপারহিট হল। যাত্রা শুরু করল ভূমি।
গত ১২ মার্চ ভূমি ১৭৬০তম অনুষ্ঠান করল। স্বপ্নের সফরে ভালোর পাশাপাশি কিছু মন খারাপ করা ঘটনাও আছে। অনেকে এসেছে, আবার চলে গিয়েছে। সাময়িক ধাক্কা সামলে ভূমির বোঝাই করা গানের গাড়ি কিন্তু চলা থামায়নি। আমার ছেলেকে নিয়ে মোট ২৬জন ভূমির। অভিযোগ শুনি, ভূমি ভেঙে ‘রবি ও নবীন’ করেছিলাম। আদৌ তা নয়। অন্যরকম গান করব বলে করেছিলাম। কিন্তু, ভূমির শো থাকলে ওটা করব না বলাই ছিল। দেখলাম লোকে বলছে ‘ভূমি’ কি ভেঙে গেল? তখন ‘রবি ও নবীন’ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। দু’বছরে ৮৪টি শো করে, দু’বার বিদেশ সফর করেও এক সন্তানকে রক্ষা করতে আরেক সন্তানকে শেষ করতে হল।
সুরজিৎ দল ছাড়ার পর ভেবেছিলাম দেড়-দু’ঘণ্টা একা টানতে পারব না। তবে মঞ্চে উঠে আর সমস্যা হয়নি। ওঁকে ছাড়াই ভূমি ২০০টির বেশি শো করে ফেলেছে। গত বছর ব্যান্ডের ১৯তম জন্মদিনে শোয়ে আসার আমন্ত্রণ জানাতে ওঁকে ফোন করেছিলাম। ধরেনি, পাল্টে ফোনও করেনি। এবার আমরা ২০-তে পা দিচ্ছি। ২৭ জুলাই বিশেষ অনুষ্ঠান। সুরজিৎ, প্লিজ এবার ফোনটা ধরিস...
‘বান্ধবীর অপেক্ষায় রঙচটা চেয়ারে বসেই গানটা লিখেছিলাম’
বেশ কিছু দিন আগে ঊষাদি আমাকে বলেছিলেন, সুরজিৎ জীবনে অনেক গান গাইবে। কিন্তু, মনে রেখ যে গান তোমার পায়ের তলার মাটি শক্ত করল সেটাই তোমার ভগবান। আজ বর্তমান বিনোদনের পাঠকদের আমার সেই ভগবানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। যার নাম ‘বারান্দায় রোদ্দুর’।
১৯৯৭ বা ৯৮ সাল। ততদিনে ‘মন আমার’ বলে একটি সোলো অ্যালবাম করেছি। একদমই চলেনি। ‘কালী আমার মা’ বলে একটা বাংলা ছবিতে মিউজিকও করেছি। বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল করে দিন গুজরান চলছে। বাবা অবসর নেওয়ার পর নাকতলায় একটি দু’কামরার ফ্ল্যাট কিনেছিলেন। গ্রাউন্ড ফ্লোরে। দু’টো ছোট ঘর, ডাইনিং কাম ড্রয়িং রুম আর ছিল একটা সাদামাঠা বারান্দা। বারান্দার ভিউ হচ্ছে দারোয়ানের বাথরুম। বুঝতেই পারছেন অবস্থা। কিন্তু, তাও ওই বারান্দাই ছিল আমার সব। একটা রঙ চটা প্লাইউড ওঠা চেয়ার ছিল। তাতে বসেই সিগারেটের ধোঁয়ার রিং ছাড়া অথবা অলস দুপুর কাটানো, এটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। কমলিনী (স্ত্রী) তখন চাকরি করে। একদিন ওঁর আমাদের বাড়িতে আসার কথা। বলেছিল, অফিসে গিয়ে সই করে আসবে। ২টোর সময় বলল, বম্বে থেকে বস এসেছে। মিটিং সেরে বেরোতে ৬টা বাজবে। সেদিন বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করতে করতেই রঙচটা চেয়ারে বসে ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ লিখে ফেললাম! এখন ভাবলে অবাক লাগে। আমার মনে হয়, ওই স্বতঃস্ফূর্ততাটাই ম্যাজিক করেছিল। আজ গানটির ২০ বছর পূর্তিতে কয়েকটা না বলা কথা বলি। ‘বারান্দায় রোদ্দুর’-এর যে কথাগুলো শোনেন তার সঙ্গে আরও ৮-১০ লাইন ছিল। পরে অপ্রয়োজনীয় মনে হওয়ায় ফেলে দিয়েছি। আমার গানের খাতায় ‘বারান্দায় রোদ্দুর’-এর লেখাটা দিলাম। আশা করি আমার বাংলা বানানের করুণ দশা দেখেও পাঠক মাফ করবেন।
যাই হোক, গান লেখা, সুর হল। সন্ধ্যার দিকে কমলিনীর অফিসে আবার ফোন করলাম। বললাম, আসিসনি যখন গানটা শোন। ও শুনে তারিফ করল। এরপর বন্ধু বিক্রমজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে টুকিকে গানটা শোনাই। ও বলল, মামা এ তো হিট! জানিয়ে রাখি, ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ শুরুর আগে যে প্রিলিউডটা শোনেন তার সম্পূর্ণ ক্রেডিট টুকির। প্রিলিউড শুনলেই শ্রোতারা বুঝে ফেলেন ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ বাজছে।
ম্যাক্স মুলার ভবনের গার্ডেন ক্যাফেতে একটি অনুষ্ঠানে সৌমিত্রর সঙ্গে আলাপ। পরে ওঁদের ব্যান্ডের রিহার্সালে যাওয়া শুরু করলাম। হঠাৎ যেন গতি বেড়ে গেল। সমুর চাপাচাপিতেই তৈরি হল ‘ভূমি’।
ভূমির ইতিহাস সমু লিখেছে তাই আমি বিস্তারিত যাচ্ছি না। বরং প্রথম অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের গল্প শোনাই। তখন শোয়ের দৌলতে কলকাতার কলেজে কলেজে ‘বারান্দায় রোদ্দুর’-এর মতো ভূমির বেশ কয়েকটি গান পরিচিতি পেয়েছে। শকুন্তলা বড়ুয়ার কন্যা পিলু আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। ওঁর সূত্রে আমাদের প্রথম অ্যালবাম করার সুযোগ আসে। বেহালার একটি রেকর্ডিং স্টুডিওতে ১০-১২ দিন ধরে রেকর্ড হয়েছিল। যে সংস্থা আমাদের অ্যালবাম বের করেছিল তার আর্টিস্ট অ্যান্ড রেপাটোর ম্যানেজার (এঅ্যান্ডআর) পদে ছিলেন সদ্যপ্রয়াত প্রমোদ শঙ্কর। বম্বেতে বসে আমাদের রেকর্ড করা গানগুলি শুনে আমাকে ফোনে প্রতিটা গানের প্রশংসা করে বললেন, ‘বেটা ইয়ে যো বারান্দায় রোদ্দুর গানা হ্যায় না ইয়ে ফির সে রেকর্ড করো। ইয়ে সুপারহিট হোগা’। কিছু দিনের মধ্যে নিজেই কলকাতায় এলেন। ওঁর সামনেই আবার রেকর্ড করলাম। এখন বুঝি, আমরা বুঝতে না পারলেও প্রমোদজি কিন্তু বুঝে ফেলেছিলেনএই গান ইতিহাস গড়বে। এরপর মুক্তির পালা। আরও প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের অ্যালবাম একসঙ্গে বেরোবে। সাংবাদিকদের ডাকা হয়েছে। সবার অ্যালবামের একটি গান শোনানো হচ্ছে। আমাদের গান শুরু হল, মরা কান্না দিয়ে। ‘ওঁরে পচা রে...’ সঙ্গে কুকুরের ডাক। সাংবাদিকরা দেখলাম মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। প্রমোদজির শত অনুরোধেও একজন সাংবাদিকও সেদিন আমাদের সঙ্গে কথা বলেননি। ভাবলাম, এটাও বোধহয় গেল খরচের খাতায়। ছ’সাত মাস কোনও খবর নেই। টুক টাক অনুষ্ঠান করছি। ধীরে ধীরে বুঝলাম লোকে আমাদের গান শুনছে। ‘যাত্রা শুরু’-র শুধু ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ নয় ১০টি গানই সুপারহিট হয়েছিল। মজার কথা শুনবেন, আজ পর্যন্ত অ্যালবামটা কোনও অ্যাওয়ার্ড পায়নি। সব অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে মনোনয়ন পেলেও খালি হাতে ফিরেছি। শ্রোতারাই আমাদের সেই খারাপ লাগা মিটিয়ে দিয়েছেন। যেখানে শো করতে গিয়েছি, হাউসফুল। আন্দুলে তো একবার পদপিষ্ট হওয়ার অবস্থা। বাধ্য হয়ে মাঝপথে অনুষ্ঠান থামাতে হয়েছিল। ব্যান্ড মানেই শহরকেন্দ্রিক এই ধারণা ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ ভেঙে দিয়েছিল। গ্রামে গঞ্জে গেলে লোকে প্রশ্ন করত, আপনাদের মধ্যে ভূমিটা কে? জানেন এই ‘বারান্দায় রোদ্দুর’-এর জন্য একবার বড় সমস্যায় পড়েছিলাম। গানটা নিয়ে বাংলাজুড়ে তখন তুলকালাম চলছে। প্রতিটি অনুষ্ঠানে কমপক্ষে দু’বার গাইতে হত। হাবড়ায় গিয়েছি অনুষ্ঠান করতে। প্রথমে আর শেষে ওই গান করে ফেলেছি। এবার নামব... হঠাৎ স্টেজে উঠে এল চারটে ছেলে। তাঁদের দাবি, পরপর চারবার ‘বারান্দায় রোদ্দুর’ না গাইলে নামতে দেবে না। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোনও মতে একবার গাওয়ার পর আয়োজকরা তাঁদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে নামিয়ে দেন।
একটা আফশোস দিয়ে লেখাটা শেষ করি। গানটা হিট হওয়ার পর মা আমায় বলেছিল একটা আরামকেদারা কিনে দেবে। সেটা আর হয়নি। মা চলে গিয়েছেন বছর দুয়েক হল। আমার আর আরামকেদারা প্রাপ্তি হল না।