নিজস্ব প্রতিনিধি, কলকাতা: পরপর চারদিন। অচলাবস্থা কাটার ক্ষীণ সম্ভাবনা ভেস্তে গেল সেই শর্তেরই ঠেলায়। অথচ চেষ্টা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দুপুরে পৌঁছে গিয়েছিলেন সরাসরি স্বাস্থ্যভবন চত্বরে জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্নামঞ্চে। চারদিকে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ স্লোগান, আশপাশে সরকার বিরোধী দেওয়াল লিখন পেরিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন আন্দোলনকারীদের মাঝে। বলেছিলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নয়, তোমাদের দিদি হিসেবে এসেছি।’ অনুরোধ করেছিলেন, ‘কাজে ফিরে এসো। তোমাদের যা দাবি, সব সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করা হবে। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তদন্ত হবে। একজন দোষীও ছাড় পাবে না। কিন্তু আমাকে একটু সময় দাও। একদিনের কাজ এটা নয়।’ তাঁর সদিচ্ছা দেখে জুনিয়র ডাক্তারদের তরফ থেকেও আলোচনা চেয়ে ই-মেল করা হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। উত্তরও আসে—কালীঘাটে সন্ধ্যা ৬টায় বৈঠক হবে। ১৫ জন প্রতিনিধিকে নিয়ে আলোচনার কথা বলা হয়েছিল চিঠিতে। ৩৪ জন পৌঁছে গেলেও মেনে নেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তাও পুনরাবৃত্তি হল নবান্নের। প্রথমে সরাসরি সম্প্রচারের দাবি, পরে ভিডিওগ্রাফির। সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন বিষয় বলে রাজি হয়নি প্রশাসন। দু’ঘণ্টা অপেক্ষার পর নিজে বেরিয়ে এসে মমতা বলেন, ‘আমার উপর ভরসা রাখো। মিনিটসের কপি আমি সই করে দেব। আর সুপ্রিম কোর্ট অনুমতি দিলে শেয়ার করা হবে রেকর্ড করে রাখা ভিডিও।’ তারপরও এক ঘণ্টা। অপেক্ষায় ছিল রাজ্যের তিন পরিচালক শক্তি—মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিব মনোজ পন্থ, স্বরাষ্ট্র সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী। ছিলেন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যও। মুখ্যমন্ত্রী যখন হাল ছেড়ে অন্দরমহলে চলে গেলেন, নমনীয় হলেন আন্দোলনকারীরা। তখন বেরিয়ে যাচ্ছেন চন্দ্রিমাদেবী এবং মুখ্যসচিব। ঘড়ির কাঁটা রাত ন’টা পেরিয়ে গিয়েছে। তাঁরা জানালেন, আর কীভাবে সম্ভব? মুখ্যমন্ত্রীর দিনভরের প্রচেষ্টাও গেল বিফলে। কাটল না অচলাবস্থা।
অথচ দিনের শুরুটা এমন হতাশাজনক ছিল না। দুপুর সওয়া ১টা। স্বাস্থ্য ভবনের ধর্নামঞ্চে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে প্রতিবাদীরা। হঠাৎ কয়েকজন পুলিসকর্তা এসে খবর দিলেন, ‘ম্যাডাম আসছেন।’ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই সকলকে সবাক করে ঢুকে পড়লেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন, ‘আমি আপনাদের আন্দোলনকে কুর্নিশ জানাই। সারারাত ঝড়জল হয়েছে। আপনাদের কষ্ট হয়েছে। ৩৩-৩৪ দিন আপনারা রাস্তায়। আমিও ঘুমাতে পারছি না। কারণ, আমি আপনাদের পাহারাদার। আর কষ্ট করবেন না। এবার কাজে ফিরুন। তিলোত্তমার বিচার হোক, আমিও চাই। আমি নিজে সিবিআইকে অনুরোধ করব, দ্রুত যেন বিচার হয়। তিনমাসের মধ্যে যেন দোষীর ফাঁসির সাজা হয়। কিন্তু বাকি অভিযোগের জন্য আমার একটু সময় লাগবে। আমি আপনাদের যন্ত্রণা বুঝি। আপনাদের প্রতি কোনও অবিচার হতে দেব না।’ তাঁর অনুরোধ, ‘আপনারা আমার ভাইবোন। কোনও অ্যাকশন নেব না। আমরা ইউপি পুলিস নই। ওরা এসমা জারি করে। আপনারা কাজে ফিরুন।’
মমতার এই আন্তরিকতায় সাড়া পড়ে যায় ডাক্তারদের মধ্যেও। তাঁরা স্বাগত জানান মুখ্যমন্ত্রীকে। তারপরই শুরু হয় বৈঠকের উদ্যোগ। কিন্তু সেটাও ভেস্তে গেল ভিডিও-শর্তে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে হাতজোড় করে বলেন, ‘আপনাদের সতীর্থরা তো আপনাদের বিশ্বাস করেই পাঠিয়েছেন। আর এখানে তো একটা সিকিওরিটিরও ব্যাপার আছে। আপনারা যদি বাড়িতে এসে মিটিং নাই করেন তাহলে আমাকে চিঠি দিলেন কেন? এত অসম্মান করা কেন? আগেও তিনদিন দু’ঘণ্টা করে বসেছিলাম। প্লিজ, এটুকু রেসপেক্ট তো দেবেন!’ পরে আন্দোলনকারীদের একাংশ দাবি করেন, ‘আমাদের বেরিয়ে যেতে বলা হয়েছে। এমনও বলা হয়, না হলে বাস ডেকে বের করে দেওয়া হবে।’ সূত্রের খবর, শর্ত আরোপের এই দাবির ক্ষেত্রেও মতভেদ হয়ে গিয়েছিল আন্দোলনকারীদের মধ্যে। একাংশ বলছিলেন, আলোচনাটাই আগে। কারণ, স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং সিপির পদত্যাগ সহ পাঁচ দফা দাবি নিয়ে সরকারের অবস্থান জানাটা বেশি প্রয়োজন। কিন্তু আর এক পক্ষ অনড়ই ছিল। সবাই একমত হওয়ার মধ্যেই সময় ফুরিয়েছে। ফল, মমতার দিনভরের প্রচেষ্টা ব্যর্থ। অব্যাহত রোগী ভোগান্তি।