রাজনীতি আমাদের মজ্জায়। দুর্নীতি, লোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা শিরায় শিরায়। ডানবাম সবাই এই দোষে কমবেশি দুষ্ট। শিক্ষা নিয়ে রাজনীতি বড় কম হয়নি। ধর্ম, সম্প্রদায় নিয়েও লড়াই সপ্তমে। অর্থনীতি, সমাজনীতি, কর্মসংস্থান, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক, দুর্নীতির আমি তুমি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ, সবই সঙ্কীর্ণ দলীয় আকচাআকচির শিকার। এমনকী পবিত্র মন্দির-মসজিদও। কিন্তু এই তেইশ সালের বাজেট অধিবেশনের একদম অন্তিম পর্বে নতুন এক ইস্যু রাজনীতির উত্তপ্ত ময়দানে সাড়া ফেলে দিয়েছে। কোনও কেলেঙ্কারি নয়, টাকার নয়ছয় নয়, উন্নয়নের ধারাপাত নয়, স্রেফ দেশের অবমাননা। সরকার ও বিরোধী দু’তরফই যেখানে কাঠগড়ায়, সেখানে দেশমাতার অপমান যে সংসদ পণ্ড করার অস্ত্র হতে পারে (পড়ুন দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার!) তা জানা গেল এই অমৃতকালে এসে। সরকার পক্ষ মানে শাসক বিজেপি রাহুল গান্ধীর লন্ডনের মাটিতে করা মন্তব্যকে হাতিয়ার করে রে রে করে আসরে নেমেছে। সর্বত্র গেল গেল রব। ভারত জোড়ো যাত্রা ফেরত রাহুল বিদেশে সফরে গিয়ে বলে এসেছেন, দেশে গণতন্ত্র বিপন্ন। সংসদের ভিতরে বিরোধীদের বলতে দেওয়া হয় না। যদিও বা বলার সুযোগ মেলে মাইকের সুইচই বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিঃসন্দেহে গুরুতর অভিযোগ। কিন্তু তিনি ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত অধিবেশন অচল করে রাখার কৌশল কি সুস্থ সংসদীয় প্রক্রিয়ার পরিচয় বহন করে। শুক্রবার লোকসভা টিভি মিউট হয়ে গিয়েছে। সরকার পক্ষ বলছে যান্ত্রিক ত্রুটি। কিন্তু এমন হাতে গরম প্রমাণ বিরোধীরা ছাড়বে কেন? তাই আগামী ৬ এপ্রিল বাজেট অধিবেশনের শেষপর্যন্ত কাজ কতটা স্বাভাবিক হবে তা নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন থাকছেই। বলা বাহুল্য, সরকার পক্ষ নিজেই যখন অধিবেশন অচল রাখার কারিগর, তখন একটা সন্দেহ কিন্তু জাগেই। এই সুযোগে গলাবাজির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় আদানির সঙ্গে যোগ, মূল্যবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান, মন্দা, গ্রামের চাষবাসের সঙ্কট নিয়ে আলোচনা। দিনের পর দিন অধিবেশন পণ্ড হলে লাভ কার? কে না জানে আসল সমস্যা থেকে চোখ ঘুরিয়ে দেওয়ার অপর নামই রাজনৈতিক কৌশল।
কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে, দেশের অপমান করছে কারা? শুধুই কংগ্রেস, শুধুই বিরোধীরা? আমি যদি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নোবেল পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। ১৪০ কোটি দেশের মানুষকে যেভাবে তিনি সুখে শান্তিতে রেখেছেন, উন্নয়ন করেছেন, তাতে আলবাত যোগ্য। এতবড় দেশে যেভাবে কোভিডের টিকাকরণ সম্পন্ন হয়েছে, তা তাঁর সাফল্য বটেই। কিন্তু আমার চাওয়াটা তো সব নয়। ঘোষণাটা আসতে হবে নোবেল কমিটি থেকে। তবেই দেশের গৌরব, সম্মান যা কিছু। নোবেল কমিটির উপ প্রধান অ্যাসলে তোজে দিল্লিতে এসেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকার প্রশংসা করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মোদিজি ও ভারতের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন। এটুকু ঠিক ছিল। একথা ঠিক, আমাদের রাষ্ট্রনায়ক যেমন দেশের সর্বত্র চরকিপাকের মতো ঘুরেছেন, তেমনই বিদেশে নিজের একটা মর্যাদার স্থান তৈরি করেছেন। বিদেশি শক্তি আজ ভারতকে যথেষ্ট সম্ভ্রমের চোখে দেখে, এটাই গেরুয়া শিবিরের দাবি। একজন গর্বিত দেশবাসী হিসেবে তা মেনে নিতে বাধা নেই। উত্তর-পূর্ব ভারতে আগের অনেক প্রধানমন্ত্রীরই পা পড়েনি। কিন্তু মোদি গিয়েছেন। আবার ইউরোপ, আমেরিকাতেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছেন। জি-২০তে এখন আমাদের প্রধানমন্ত্রীই নেতৃত্বে আসীন।
এটুকু গৌরবগাথা ও তার আকাশচুম্বী আস্ফালন ঠিকই ছিল। কিন্তু একটা ফেক নিউজ ছড়িয়ে গত বৃহস্পতিবার বেলা গড়াতেই যা হল, তা তাঁর পদের অপমান। দেশের তো বটেই, আরও দুঃখের সেই ভুয়ো খবর নিয়ে এক শ্রেণির লোকের তিল কে তাল করার প্রচেষ্টা, উদ্বাহু হওয়া। যখন কে দেশের অপমান করেছেন, এই প্রশ্নে সংসদ এক সপ্তাহেরও বেশি প্রায় অচল, তখন এই ঘটনা কি বিদেশের সামনে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করবে? একথা অস্বীকার করার জায়গা নেই, নরেন্দ্র মোদি আমাদের অনেক কিছু দিয়েছেন। সাহস দিয়েছেন, তেজ দিয়েছেন, নুইয়ে পড়া মেরুদণ্ড জুড়ে দিয়েছেন, জোট রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে দশকেরও বেশি সময় ধরে একদলীয় শক্তিশালী সরকার দিয়েছেন। নোটবন্দি উপহার দিয়েছেন। জিএসটি দিয়েছেন। কিন্তু তা বলে নোবেল কমিটির অন্যতম কর্তার দিল্লি সফরের সময় এমন এক ভুয়ো খবর ছড়িয়ে কারা দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি করল, তার তদন্ত হবে না? প্রোঅ্যাক্টিভ সিবিআই, আইবি
সমেত পোড়খাওয়া এজেন্সি ও তার গোয়েন্দারা এর দুধ কা দুধ, পানি কা পানি করতে আসরে নামবে না। ওসব না হয় ছেড়েই দিলাম। একটা কথা চালু আছে, দুঁদে গোয়েন্দা অজিত দোভালই নাকি বর্তমান মোদি সরকারের চোখ-নাক-জিহ্বা। একমাত্র অমিত শাহকে ছেড়ে দিলে আর কোনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও
ধারেভারে তাঁর সমকক্ষ নন। সরকারের অঘোষিত নাম্বার থ্রি! তাহলে তিনি তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় রাষ্ট্রনায়ককে জড়িয়ে দেশের এই অপমানের পর এখনও চুপ কেন?
‘সংসদ হচ্ছে গণতন্ত্রের মন্দির’, কথাটা আমার নয়, স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির। প্রায় ৯ বছর আগে সেই মন্দিরে মাথা ঠুকে তিনি প্রবেশ করেছিলেন ক্ষমতার অলিন্দে। সেখানে দাঁড়িয়ে সেই তিনিই যদি আগের জমানাকে ছোট করতে ‘লস্ট ডেকেড’ আখ্যা দেন, তা
দেশের পক্ষে অবমাননাকর নয় কি? কিংবা রাষ্ট্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহরুজিকে অহরহ কটাক্ষ। নেতা আসে, নেতা যায়, পোশাকের রং বদলায়, শাসনের ঢঙ বদলায়, কিন্তু দেশটা, দেশের মানুষ একই
থাকে। স্বাধীনতা লাভের পর ৭৫ বছরের শাসন ব্যবস্থার অর্ধেকেরও বেশি সময় যে দেশটা কংগ্রেস শাসনে ছিল, তা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
সেই অতীতকে অস্বীকার করার অর্থ দেশের
ইতিহাস, দেশের গৌরবকেই খাটো করা। কোনও রাজনৈতিক দলকে মুছে দিতে গিয়ে দেশের অতীতকে অস্বীকার করলে আখেরে গরিমা বাড়ে না। সমগ্র জাতিটাই ছোট হয়ে যায়!
তবে একইসঙ্গে কংগ্রেসকে আরও পরিণত মনের পরিচয় দিতে হবে। শাসক দলকে আক্রমণ করার অর্থ দেশকে ও তার সরকারকে অপমান করা নয়। তাই যে সংসদে তিনি বিদেশ যাওয়ার আগেও বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছেন, চাঁচাছোলা ভাষায় প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন, সেখানে কোনমুখে তিনি বলেন, কাউকে বলতেই দেওয়া হয় না। আসলে এই বক্তব্যের কোনও ভিত্তি নেই। বিরোধীরা বলতে উঠলে সংসদের মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়, এই অভিযোগেরও প্রমাণ দিতে হবে। রাহুল গান্ধী বৃহস্পতিবার আরও একটি বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছেন বিজেপির হাতে। হঠাৎই বলে ফেলেছেন, ‘দুর্ভাগ্যজনক হল আমি একজন সংসদ সদস্য।’ পাশে বসা প্রবীণ নেতা এমপি জয়রাম রমেশ ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। এতদিন রাজনীতি করার পরও যদি মেন্টর কিংবা টিউটর নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে হয়, তাহলে তা শুধু কংগ্রেস নয়, দেশের বিরোধী রাজনীতিরই দুর্ভাগ্য। ভুললে চলবে না এত ক্ষয়, বিপর্যয়ের পরও বিজেপিকে ছেড়ে দিলে কংগ্রেস একমাত্র জাতীয় দল। কংগ্রেসকে টুকরো টুকরো করে সেই ভোটব্যাঙ্ককে যত আঞ্চলিক দলের মধ্যে ভেঙে দেওয়া যায়, মোদি-অমিত শাহের হাসি তত চওড়া হওয়া নিশ্চিত। কারণ ১৮টা ছোট দল মিলে কেন্দ্রে সরকার চালানো খুব সোজা কাজ হবে না। নানা স্বার্থের সংঘাতে সেই মধুচন্দ্রিমা যে অচিরেই ভাঙতে বাধ্য, তা বিলক্ষণ বোঝে গেরুয়া নেতৃত্ব। তাই কংগ্রেস সহ বিরোধীদের অণু-পরমাণুতে বিভক্ত করার খেলা চলতেই থাকবে। কিন্তু সরকার আর বিরোধী পক্ষের এই ক্ষমতা দখলের নোংরা খেলার মাঝে পড়ে দেশের প্রান্তিক মানুষের কী লাভ? চাকরি নেই, রোজগার নেই, একটা রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ২০০ টাকা। আদার ব্যাপারীর জাহাজের খোঁজ করে লাভ কী? সাধারণের লক্ষ্য তো একটু শাকান্ন জোগাড় করা, মার্সিডিজ নয়!
তবু পাঁচ বছর অন্তর সাধারণ নির্বাচন আসে। জনগণ আর একবার নেতাদের মিথ্যে আশ্বাসের শিকার হয়। দইয়ের ফোঁটা পরে বুথে যায়। তারপর নেতার অবস্থা বদলায়, দোতলা বাড়ি চকমকে মাল্টিস্টোরেড হয়, ঝাঁ চকচকে গাড়ির লাইন লাগে। ‘বোকা’ জনগণ থাকে সেই তিমিরেই। এই হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতির চলমান বারোমাস্যা। আমেরিকার ভবিষ্যদ্বাণী যদি সত্যি হয় তাহলে ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির রিপ্লে দেখাও অসম্ভব নয়। আসল সমস্যা, বেঁচে থাকার লড়াই থেকে চোখ ঘোরাতে আবার সাত সকালে দুম করে সার্জিকাল স্ট্রাইক। বালাকোটের সময় পাকিস্তানের রাজনীতি, অর্থনীতি এতটা শোচনীয় অবস্থায় ছিল না। কিন্তু এই মুহূর্তে ওদের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে। বিদেশি মুদ্রা ভাণ্ডার তলানিতে। ধুরন্ধর নেতারা জানেন, দেশের অপমানের সঙ্গে জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিতে পারলে ওই টনিকে তৃতীয়বার কেন্দ্রের কুর্সি দখলে চোনা ফেলার সাধ্য কার? নেতামাত্রই জানে আম জনগণের স্মৃতি বড্ড দুর্বল! তাই একই ফাঁদে ফেলার বারবার চেষ্টা।