দীপঙ্কর মণ্ডল: জল ছাড়া যেমন মাছ থাকতে পারে না, তেমনি বাইরে ঘুরতে বা অফিসের কাজে গেলে হোটেল ছাড়া থাকা কার্যত অসম্ভব। আর সেখানে খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের যাবতীয় দায়িত্ব থাকে হোটেলের কর্মী-আধিকারিকদের উপর। ডাক্তার হতে যেমন এমবিবিএস, উকিল হতে যেমন ল’ পাশ করতে হয়, তেমনই নামী হোটেলগুলিতে আকর্ষণীয় বেতনের কাজ পেতে হলে হোটেল ম্যানেজমেন্টের শংসাপত্র জরুরি। কয়েকদিন আগে উচ্চমাধ্যমিক সহ দিল্লি বোর্ডগুলিরও দ্বাদশের ফল প্রকাশ হয়েছে। স্কুল ছাড়ার পর ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ কলেজে ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হবে। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যাবে একটা অংশ। বহু ছাত্রছাত্রীই খোঁজ করতে শুরু করে দ্বাদশের পর কোন কোর্স করলে দ্রুত চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে। এমন পড়ুয়াদের জন্য রইল হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স বিষয়ক আলোচনা।
হোটেল ম্যানেজমেন্ট কী?
এককথায় হোটেল পরিচালনা করার জন্য যে দক্ষতার প্রয়োজন হয় তা পড়ানোর নামই হোটেল ম্যানেজমেন্ট। এই কোর্সে ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা দুই স্তরে ভর্তি হওয়া যায়। স্নাতক ডিগ্রি করতে তিন থেকে চার বছরের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ডিপ্লোমায় লাগে এক থেকে দেড় বছর। প্রবেশিকা পরীক্ষায় র্যাঙ্ক অনুযায়ী স্নাতকে ভর্তি হওয়া যায়। ক্লাস শুরুর পর মাতৃভাষা ছাড়াও ইংরেজি ও হিন্দিতে ঝরঝরে কথা বলার অভ্যাস করানো হয়। প্র্যাক্টিক্যাল অর্থাৎ হাতে কলমে প্রশিক্ষণ এই কোর্সে অনেক বেশি। রান্না করা থেকে প্লেটে খাবার পরিবেশন করা সবই শেখানো হয়। হোটেল বুকিং, হসপিটালিটি, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সবেতেই পারদর্শী করা হয় এই কোর্সে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট বা হোটেল পরিচালনার কাজ পুরোটাই পরিষেবামূলক। নতুন মানুষের সঙ্গে কথা বলা, অতিথির ছোট ছোট ভালো ও খারাপ লাগাগুলিকে গুরুত্ব দেওয়া খুব প্রয়োজনীয়। নিজের ভালো বা খারাপ লাগার প্রতিফলন কিছুতেই দেখানো যাবে না। হাসিমুখে অতিথিদের সঙ্গে মিশতে হবে। এই সমস্ত গুণ থাকলে এই পেশায় সফল হওয়া যায়।
সিলেবাস
হোটেল ম্যানেজমেন্টে স্নাতক ডিগ্রির কোর্সের মেয়াদ ৩ বছর। প্রথম এক বছর পরই হয় ৬ মাসের ইন্টার্নশিপ। প্রতিষ্ঠান থেকেই ব্যবস্থা করা হয়। কোনও শিক্ষার্থী চাইলে নিজের পছন্দ মতো ইন্টার্নশিপ করতে পারেন। তবে স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকেই তা করতে হয়। নিউট্রিশন, অ্যাপলিকেশন অব কম্পিউটার, ফুড প্রোডাকশন, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ সার্ভিস, সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং, হাউসকিপিং, ফ্রন্ট অফিস, হোটেল ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রিন্সিপ্যাল অব ফুড সায়েন্স, কমিউনিকেশন, অ্যাকাউন্টেন্সি, রিসার্চ মেথডলজি, ফুড সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি, ফাইনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট, স্ট্র্যাটেজিক ম্যানেজমেন্ট সহ আরও কিছু বিষয় থাকে তিন বছরের স্নাতক সিলেবাসে। উচ্চমাধ্যমিকস্তরের পরীক্ষায় পাশ করার পর মূলত তিনটি কোর্সে ভর্তি হতে পারেন ছাত্রছাত্রীরা। সেগুলি হল— ব্যাচেলর অব হোটেল ম্যানেজমেন্ট, ডিপ্লোমা ইন হোটেল ম্যানেজমেন্ট, বিএসসি ইন হোটেল ম্যানেজমেন্ট এবং বিবিএ ইন হোটেল ম্যানেজমেন্ট।
চাকরির সুযোগ
বেশিরভাগ হোটেল ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে ক্যাম্পাসিংয়ের সুযোগ আছে। কোর্স শেষে শহরের বা ভিন রাজ্যের এমনকী বিদেশের নামী হোটেলে কাজের সুযোগ পেয়ে যান শিক্ষার্থীরা। এই বিষয়টি নিয়ে পড়াশোনা শেষে চাকরির ক্ষেত্রও অনেক বেশি। হোটেল ম্যানেজার, ইভেন্ট ম্যানেজার, গেস্ট রিলেশন, ক্লায়েন্ট রিলেশন, ক্যাটারিং ম্যানেজার, অ্যাকমোডেশন ম্যানেজার, শেফ সহ আরও বহু ক্ষেত্র রয়েছে। হোটেল ম্যানেজমেন্ট কোর্স করার পর বাড়িতে কাজের অভাবে বসে আছেন, এমন কারও খোঁজ পাওয়া মুশকিল। হোটেল ছাড়াও জাহাজে চাকরিও সুযোগ থাকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পাশ পড়ুয়াদের। তবে, সে ক্ষেত্রে অন্তত এক বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হয়।
বিশেষজ্ঞের বক্তব্য
কলকাতার এক হোটেল ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সঞ্জীবন মাইতি বললেন, করোনার সময় হোটেল শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখন সবকিছু স্বাভাবিক। এই মুহূর্তে ব্যাপকভাবে প্রশিক্ষিত কর্মী দরকার। আমাদের শিল্পে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে বিরাট ফারাক দেখা দিয়েছে। এই কারণে আমি দ্বাদশ পাশের পর পড়ুয়াদের ডিগ্রির পরিবর্তে ডিপ্লোমা পড়ায় বেশি উৎসাহ দেব। তিন-চার বছর ধরে না পড়ে এক-দেড় বছরেই ডিপ্লোমা করা যায়। আর তারপরেই নিশ্চিত চাকরি। পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর হোটেল আছে। বিভিন্ন গোষ্ঠী আগ্রহ দেখাচ্ছে। কর্পোরেট প্রয়োজন ছাড়াও বেড়াতে গিয়েও ভালো হোটেল খোঁজেন সবাই। সেক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত কর্মী লাগে। পেশাদার কর্মী হিসাবে দেশবিদেশে কাজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাংলার ছেলেমেয়েরা এই পেশায় সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে।