গৃহসুখ বৃদ্ধি ও সপরিবারে আনন্দ উপভোগ। অন্যের দোষের দায়বহন করতে হতে পারে। ... বিশদ
অ্যালোভেরার আশ্চর্য গুণ
ডাঃ নবনীতা মহাকাল
ঘৃতকুমারী নামটি সবাই না শুনে থাকলেও এই গাছটিকে সবাই অ্যালোভেরা নামে ভালোই চেনেন। ঔষধি এই ভেষজের নানা গুণের কথা পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষের জানা। শরীরে নানা প্রয়োজনীয় পুষ্টির জোগান দিতে আর অসুখ-বিসুখ সারিয়ে তুলতে অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারীর তুলনা নেই। এই উদ্ভিদ খাদ্য-পানীয় হিসেবে যেমন কার্যকরী তেমনই আবার বাহ্যিক প্রয়োগ করার যোগ্য। ঘৃতকুমারীর রস পান করে, স্যালাড হিসেবে খেয়ে এবং ত্বক ও চুলে ব্যবহার করে যে কোনও ব্যক্তি দারুণ উপকৃত হতে পারেন। আজকের এই প্রতিবেদনে ঘৃতকুমারীর বিভিন্ন উপকারিতার কথা আপনাদের জানাতে চেষ্টা করব। তাই প্রথমেই আমরা জেনে নেব আয়ুর্বেদ ও আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এর গুণাগুণ।
কী বলছে আয়ুর্বেদ
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে এই গাছটি কুমারী বা ঘৃতকুমারী নামে পরিচিত। এই গাছ অল্প জলে জীবনধারণ করতে পারে ও শীতল গুণের কারণে এর নামকরণ হয়েছে কুমারী। এই গাছের পাতার শাঁস ঘি-এর মতো দেখতে, তাই ঘৃতকুমারী নাম। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে উল্লেখিত এর গুণাগুণগুলি (রসপঞ্চক) হল নিম্নরূপ:
রস-তিক্ত, মধুর।
গুণ – স্নিগ্ধ, পিচ্ছিল।
প্রকৃতি- শীত।
বিপাক- কটু।
দোষ-কর্ম- ত্রিদোষনাশক।
কর্ম: ভেদন, রসায়ন, নেত্র রোগে উপকারী, বর্ণবৃদ্ধিকর, কুষ্ঠঘ্ন, কৃমিঘ্ন ইত্যাদি। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে যেসব রোগে ব্যবহার করা হয়ে থাকে সেগুলি হল— যকৃত বিকার, কামলা, রজঃ অবরোধ, পাণ্ডু, নেত্ররোগ, ত্বকবিকার, অর্শ রোগ, গুল্ম, শোথ ইত্যাদি।
আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে: ঘৃতকুমারী (বৈজ্ঞানিক নাম: অ্যালয় ভেরা), (ইংরেজি: মেডিসিনাল অ্যালো, বার্ন প্লান্ট) একটি রসালো উদ্ভিদ প্রজাতি। এটি অ্যালয় পরিবারের একটি উদ্ভিদ। ঘৃতকুমারী গাছ অনেকটাই কাঁটাওয়ালা ফণীমনসা বা ক্যাকটাসের মতো। অ্যালোভেরা ক্যাকটাসের মতো দেখতে হলেও ক্যাকটাস নয়। লিলি প্রজাতির। এটি প্রায় কাণ্ডবিহীন এক উদ্ভিদ। পাতা আছে কিন্তু তা পাতার মতোও না, অদ্ভুত দর্শনের এই মরু উদ্ভিদটির আদি নিবাস আরবের মরু অঞ্চল হলেও আফ্রিকা এবং এশিয়াসহ পৃথিবীর সব উষ্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলেই এদের পাওয়া যায়। ক্যাকটাস বা মরু জাতীয় উদ্ভিদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হল—এদের মূল বা শিকড় সাধারণত গাছটির যে অংশ মাটির বাইরে তার থেকে অনেক লম্বা। দূর থেকে জল সংগ্রহ করতে হয় বলে তাকে এমন লম্বা হতে হয়। তাই এই ব্যবস্থা। কিন্তু ঘৃতকুমারী এ ব্যাপারে ব্যতিক্রম, তার মূল অন্যান্য মরু উদ্ভিদের তুলনায় অনেক ছোট। এর রসাল পাতায় পত্ররন্ধ্র বা স্টোমাটার সংখ্যাও তুলনামূলকভাবে বেশ কম। দুষ্প্রাপ্য ও কষ্টার্জিত জল বাষ্পমোচন বা প্রস্বেদন (ট্রান্সপিরেশন)-এর মাধ্যমে যাতে বেরিয়ে যেতে না পারে তার জন্য পাতার কিনারা কাঁটায় রূপান্তরিত। লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বছরের অভিযোজন ও অভিব্যক্তির ফল। উদ্ভিদটি শরীরের মধ্যে যে পরিমাণ জল রাখে সেই পরিমাণ জলই হয়তো তাকে কেউ কোনওদিনই দেয় না, বা সে প্রকৃতি থেকেও পায় না। তবু্ও সে বেঁচে থাকে। মৃত্যুঞ্জয়ী এই উদ্ভিদটি উদ্ভিদকুলের এক বিস্ময়।
অমর এই গাছটিকে একবার বাড়িতে এনে একটু মাটি বা বালিমাটি দিয়ে একটা টবে বসালে তারপর এক দু’বছর যদি তার কথা ভুলেও যান এবং জল না দিতে পারেন তাহলে আক্ষেপ বা অপরাধবোধেও ভুগবেন না এই ভেবে যে, ‘আহা রে! কেষ্টর জীবটাকে শখ করে বাড়িতে ডেকে আনলাম কিন্তু একটু জল খেতেও দিলাম না বছরভর, পাপ হয়ে গেল মনে হয়। মনখারাপ করার কিছু নেই, দু’এক বছর পরেও গিয়ে দেখবেন আপনি তাকে ভুলে গেলেও সে কিন্তু আপনাকে দেখবে বলে অপেক্ষা করে আছে তার সন্তানসন্ততি সহ বংশবিস্তার করে। এই কারণেই হয়তো এর অপর নাম অমর উদ্ভিদ বা অমরত্বের গাছ—প্লান্ট ইমমর্টালটি। আবার এই নাম দ্ব্যর্থকও হতে পারে। কারণ, মানবদেহে এর গুণাগুণের নিরিখেও হতে পারে তার এই নাম।
ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রে অ্যালোভেরার ব্যবহার পাওয়া যায় সেই খ্রিস্টপূর্ব যুগ থেকেই। ঘৃতকুমারীর পাতা ও শাঁস ব্যবহার করা হয়। এর পাতার রস যকৃতের জন্য উপকারী। ঘৃতকুমারীর পাতার শাঁস বেটে ফোঁড়ায় লাগালে যন্ত্রণা কমে যায়। পোড়াস্থানে লাগালে উপকার পাওয়া যায়। হাঁপানি ও অ্যালার্জি প্রতিরোধে ঘৃতকুমারী বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যকরী। এটি ত্বকের জন্য খুব উপকারী। ত্বকের দাগ, ব্রণ এবং শুষ্কতা দূর করতে অনেক কার্যকরী।
ভিটামিন ও খনিজ কী আছে ঘৃতকুমারীতে?
প্রশ্নটা হওয়া উচিত কী নেই ঘৃতকুমারীতে? অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী নানা ধরনের ভিটামিন ও খনিজের এক সমৃদ্ধ উৎস। ভিটামিন-এ, সি, ই, ফোলিক অ্যাসিড, কোলিন, বি-১, বি-২, বি-৩ (নিয়াসিন) ও ভিটামিন বি-৬ এর দারুণ উৎস এটা। অল্পসংখ্যক উদ্ভিদের মধ্যে ঘৃতকুমারী একটি যাতে ভিটামিন বি-১২ আছে। প্রায় ২০ ধরনের খনিজ আছে ঘৃতকুমারীতে। এর মধ্যে আছে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, জিঙ্ক, ক্রোমিয়াম, সেলেনিয়াম, সোডিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম, কপার ও ম্যাঙ্গানিজ। অ্যামাইনো আর ফ্যাটি অ্যাসিডেরও ভালো উৎস অ্যালোভেরা। গবেষণায় জানা যায়, মানবদেহের জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় কিছু ভিটামিন, এনজাইম, অণুখনিজ পদার্থ, ত্বকের পুষ্টি ও ত্বকের প্রদাহ রোধকারী, ক্ষয় রোধকারী ও অন্যান্য বহু প্রয়োজনীয় অতি ঔষধি গুণসম্পন্ন মোট ৭৫ রকমের জৈব ও অজৈব বস্তুর সন্ধান মিলেছে আজ পর্যন্ত এই হেলাফেলার গাছটিতে। যার মধ্যে আছে ১৮ থেকে ২০ রকমের প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড। এগুলো সে সঞ্চিত রাখে রসালো পাতার ওই হড়হড়ে রস-এ বা অ্যালো জেল-এ।
বিভিন্ন রোগে ঘৃতকুমারীর ব্যবহার ও উপকারিতা
পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারীর নামের তালিকার শুরুর দিকেই থাকবেন রানি ক্লিওপেট্রা। মিশরের লোককাহিনি বলছে, রূপচর্চায় অ্যালোভেরা ব্যবহার করতেন রানি। অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী প্রাচীনকাল থেকেই রূপচর্চায় এক ভরসার নাম। এদিকে গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়ছে। সেই সঙ্গে ত্বক আর চুলে স্পর্শ করতে শুরু করেছে অদ্ভুত রুক্ষতা। এই জ্বালা ধরানো আবহাওয়ায় কীভাবে বারান্দা বা ছাদের ঘৃতকুমারী দিয়ে আপনার ত্বক আর চুলের যত্ন করবেন, জেনে নেওয়া যাক।
আধুনিক প্রসাধনী সামগ্রীর অন্যতম কাঁচামাল এই অ্যালোভেরা বা ঘৃতকুমারী। ত্বক ও চুলের জন্য এটা দারুণ উপকারী। এটা ত্বকের নানা ক্ষত সারিয়ে তুলতে কার্যকরী। রোদে পোড়া, ত্বকে ফুসকুড়ি ও পোকার কামড়ের মতো বাহ্যিক সমস্যাগুলো সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। বাহ্যিক ক্ষতে ঘৃতকুমারীর রস মাখলেও ব্যথার উপশম হবে, কেননা বেদনানাশক হিসেবেও এটা অতুলনীয়। চুল পরিষ্কার করতে, চুলে পুষ্টি জোগাতে এবং চুল ঝলমলে উজ্জ্বল রাখতে ঘৃতকুমারীর রস দারুণ কাজের। নিয়মিত ঘৃতকুমারীর রস খেলে আপনার বাড়তি ওজন নিয়ন্ত্রণে আনাও সহজ হবে। ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে ত্বককে মসৃণ ও কোমল রাখতে আজকাল প্রসাধনী তৈরিতেও ব্যবহার করা হয় ঘৃতকুমারীর নির্যাস।
ত্বক ও চুলের যত্নে ঘৃতকুমারী
অ্যালোভেরাতে আছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ত্বক থেকে বয়সের ছাপ, ব্রণের দাগ, ট্যান দূর করে।
নিয়মিত অ্যালোভেরা ব্যবহারে ত্বকে আসে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা। অ্যালোভেরা প্রাকৃতিক হাইলাইটার।
অ্যালোভেরাতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদান ব্রণ নিরাময়ে সাহায্য করে। নিয়মিত ব্যবহারে ব্রণের দাগ দূর হয়। গরমকালে অ্যালোভেরার ভেতর থেকে জেল বের করে আইস ট্রেতে বরফের কিউব তৈরি করেও ব্যবহার করতে পারেন। ঘৃতকুমারীর নির্যাসের সঙ্গে ভিটামিন-ই ক্যাপসুল মিশিয়ে ত্বকে আলতোভাবে ঘষতে পারেন। নিয়মিত ব্যবহারে ধীরে ধীরে মেচেতার দাগ কমে যাবে।
অ্যালোভেরার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান চুল পড়া ও খুশকির সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতেও কার্যকর।
ঠোঁটের মৃত কোষ দূর করতে চালের গুঁড়োর সঙ্গে ঘৃতকুমারীর রস মিশিয়ে ঘষতে পারেন। নিয়মিত ঘৃতকুমারীর জেল ব্যবহারে ঠোঁট থাকবে উজ্জ্বল ও কোমল।
মানসিক চাপ ও রোগ প্রতিরোধ
ঘৃতকুমারী দারুণ অ্যাডাপ্টোজেন। শরীরের প্রাকৃতিক ক্ষমতাকে বাড়িয়ে বাহ্যিক নানা চাপ ও রোগ প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালনকারী উপাদানকে অ্যাডাপ্টোজেন বলা হয়ে থাকে। ঘৃতকুমারী দেহের অভ্যন্তরীণ সিস্টেমের সঙ্গে মিশে গিয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় করে তোলে এবং দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে। শারীরিক ও মানসিক চাপ মোকাবিলার পাশাপাশি পরিবেশগত দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে দেহকে সুরক্ষা দিতে পারে ঘৃতকুমারী।
পরিপাক বা হজমে সহায়ক
হজমের সমস্যা থেকেই শরীরে অনেক রোগ বাসা বাঁধে। তাই সুস্বাস্থ্যের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে খাবার-দাবার পরিপাক বা হজমের প্রক্রিয়াটি ঠিকঠাক রাখা। পরিপাক যন্ত্রকে পরিষ্কার করে হজম শক্তি বাড়াতে ঘৃতকুমারী অত্যন্ত কার্যকর। ঘৃতকুমারীর রস পান করার দারুণ ব্যাপার হল এটা কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়েরিয়া দুটি ক্ষেত্রেই কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। পরিপাক ও রেচন তন্ত্রকে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে মুক্ত রাখে বলে ঘৃতকুমারীর রস পান করলে পেটে কৃমি হওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকে না, কিংবা কৃমি থাকলেও সেটা দূর হয়।
ডায়াবেটিসে উপকারী
ঘৃতকুমারীর রসে অ্যান্টিডায়াবেটিক যৌগ থাকার কারণে এটি যকৃতের দ্বারা শর্করা মেটাবলিজম করে। তাই যাঁরা ডায়াবেটিসের সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা নিয়মিত অ্যালোভেরা রস খেলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে আনতে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে উপকার পাবেন।
হার্ট ও দাঁতের যত্নে
অ্যালোভেরার জ্যুস কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে রাখে। এটি দূষিত রক্ত দেহ থেকে বের করে দেয় এবং হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে থাকে। এছাড়াও অ্যালোভেরা জ্যুস দাঁত এবং মাড়ির ব্যথা ও ইনফেকশন নিবারণে সহায়তা করে। অ্যালোভেরার জ্যুস শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। এটি আবার ব্লাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণ করে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি রক্তে অক্সিজেন বহন করার ক্ষমতাকেও বাড়ায়। যার ফলে দীর্ঘদিন আপনার হার্ট ভালো থাকে।
অ্যালক্যালাইন সমৃদ্ধ খাবার
সুস্বাস্থ্যের জন্য খাবার-দাবারে অ্যালক্যালাইন সমৃদ্ধ খাদ্য ও অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাদ্যের ভারসাম্য বজায় রাখার কথা বলা হয়। এক্ষেত্রে ৮০/২০ বা ৮০ ভাগ অ্যালক্যালাইন সমৃদ্ধ খাবার ও ২০ ভাগ অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ঘৃতকুমারী এমন খাবার যা অ্যালক্যালাইন তৈরি করে। কিন্তু আজকাল নগরজীবনে আমাদের খাদ্যাভ্যাস এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে প্রায়শই অ্যাসিডের সমস্যায় ভুগতে হয়। ফলে অতিরিক্ত অ্যাসিডের ভোগান্তি থেকে বাঁচতে মাঝেমধ্যে ঘৃতকুমারীর রস খেতে হবে।
অ্যামাইনো ও ফ্যাটি অ্যাসিডের উৎস
মানব দেহের নানা প্রয়োজনীয় প্রোটিনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ অ্যামাইনো অ্যাসিড। এমন ২২টি অ্যামাইনো অ্যাসিডকে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, এর মধ্যে ৮টি অত্যাবশ্যক। ঘৃতকুমারীতে শরীরের জন্য অত্যাবশ্যক এই ৮টি অ্যামাইনো অ্যাসিডই আছে। আর এতে মোট অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে ১৮ থেকে ২০ ধরনের। এ ছাড়া নানা ধরনের ফ্যাটি অ্যাসিডেরও দারুণ উৎস এই ঘৃতকুমারী।
প্রদাহ ও ব্যথা কমায়
শরীরে নানা ধরনের প্রদাহ দূর করতে খুবই কার্যকর ঘৃতকুমারী। এতে বি-সিস্টারোলসহ এমন ১২টি উপাদান আছে যা প্রদাহ তৈরি হওয়া ঠেকায় এবং প্রদাহ হয়ে গেলে তা কমিয়ে আনে। ঘৃতকুমারীর এইসব গুণ হাত-পায়ের জড়তা দূর করে এবং গাঁটের ব্যথা কমাতেও সহায়তা করে।
ওজন কমাতে সহায়ক
খাবার হজমে সহায়তা এবং শরীরকে দূষণমুক্ত করার মধ্যে দিয়ে ঘৃতকুমারী স্বাস্থ্যের যে প্রাথমিক উন্নতি ঘটায়, তার অবধারিত ফল হল ওজন ঠিকঠাক থাকা। এমনিতে ওজন কমানো নিয়ে অনেকে সমস্যায় থাকলেও নিয়মিত ঘৃতকুমারীর রস পান করলে মাত্রাতিরিক্ত ওজনের সমস্যা অনেক কম হবে। এছাড়া শরীর দূষণমুক্ত রাখতে পারার কারণে কর্মশক্তি বেড়ে যাবে, ওজনও কমবে।
একনজরে অ্যালোভেরার বিশেষ উপকারিতা—
অ্যালোভেরায় থাকা ল্যাকটেটিভ উপাদান পেট পরিষ্কার করতে সাহায্য করে। হজমশক্তি বাড়ায়। অ্যালোভেরার জ্যুস ক্লান্তি দূর করে দেহকে সতেজ করে।
এর ঔষধি গুণ রক্তচাপ কমায় এবং রক্তে কোলেস্টেরল ও সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে সাহায্য করে।
দেহে ক্ষতিকর পদার্থ প্রবেশ করলে তা অপসারণ করতে সাহায্য করে অ্যালোভেরা।
বিভিন্ন চর্মরোগ ও ক্ষত সারায়।
অ্যালোভেরায় প্রচুর পরিমাণে জলীয় উপাদান থাকায় এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখে।
অ্যালোভেরার আঠালো রস খাদ্যনালী ও পরিপাকতন্ত্রকে পরিষ্কার করতে পারে।
অ্যালোভেরার উপাদান দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আরও সক্রিয় করে এবং দেহের ভারসাম্য রক্ষা করে। এটি দেহে শ্বেত ব্লাড সেল গঠন করে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করে।
অ্যালোভেরা জ্যুসের অ্যান্টিইনফ্লামেটরি উপাদান শরীরে জমে থাকা মেদ দূর করে এবং কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই ওজন কমাতে সাহায্য করে।
অ্যালোভেরার উপাদানগুলো হাড় ও মাংসপেশিকে শক্তিশালীকে করে। হৃদযন্ত্রের সমস্যা প্রতিরোধ করে।
ত্বকের র্যাশ, চুলকানি, রোদে পোড়া দাগ দূর করে অ্যালোভেরা জেল। এই জেল ত্বকে লাগালে ত্বক উজ্জ্বল ও মসৃণ থাকে এবং বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না।
চুলের শুষ্ক ভাব এবং ত্বকের চুলকানি দূর করার জন্য অ্যালোভেরা জেল সহায়ক। এর অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল উপাদান চুল পড়া ও খুশকি দূর করে।
কীভাবে খাবেন?
অনেকেই জানেন না অ্যালোভেরা কীভাবে খেতে হবে। এটি জ্যুস বা স্যালাড হিসেবে খাওয়া যায়। প্রতিদিন সকালে অ্যালোভেরা জ্যুস পান করতে পারলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা যায়। অ্যালোভেরা কিউব করে কেটে স্যালাড বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া স্মুদি বা শরবতে মিশিয়ে নিয়েও খেতে পারেন এই কিউব।
সতর্কতা জেনে রাখা ভালো—
অ্যালোভেরা খেলে অনেক সময় পেটের সমস্যা ও অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
অনেকের ত্বকে অ্যালোভেরা জেল ব্যবহার করলে ফুসকুড়ি, জ্বালাপোড়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
নিয়মিত খাদ্যতালিকায় অ্যালোভেরা রাখতে চাইলে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়া ভালো।
রোগহর হলুদ
ডাঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ
ডাঃ বিশ্বজিৎ ঘোষ
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে হলুদ
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের বিভিন্ন সংহিতায় হলুদের বিবিধ গুণাবলি নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। রাজনিঘন্টু মতে, হরিদ্রা কটু, তিক্ত, উষ্ণ, কফ, বাত, কুষ্ঠ, মেহ, কণ্ডু, ব্রণ নাশক এবং দেহের বর্ণ উজ্জ্বলতাকারক। চরক সংহিতায় হলুদের বহুবিধ ব্যবহারের মধ্যে প্রমেহ নাশে হলুদ, মধু ও আমলকী রস বেশ উল্লেখযোগ্য মুষ্টিযোগ। সুশ্রুত সংহিতায় মূলত কুষ্ঠ (এখানে কুষ্ঠ অর্থ বিবিধ ত্বকের সমস্যা) নিবারণে হলুদ সেবনের বিধান প্রশংসনীয়। চক্রদত্তের মতে, গুড় সংযুক্ত হলুদ শ্লীপদ অর্থাৎ পায়ের একপ্রকার শোথ চিকিৎসায় হিতকর। ‘বঙ্গসেন সংহিতা’ মতে মূত্র শর্করা সমস্যায় যেখানে মূত্রের সঙ্গে বালির মতো পদার্থ নির্গত হয় সেক্ষেত্রে তুষদোকের (চাল ধোওয়া জল) সঙ্গে গুড় হলুদ সেবনে উপরিউক্ত সমস্যার নিবৃত্তি ঘটে। আবার ধন্বন্তরী নিঘন্টু মতে হলুদ—‘কন্ডু কুষ্ঠ ব্রনাতহন্তি দেহবর্ণবিধায়িনী’, অর্থাৎ হলুদ ত্বকজ বিকারনাশক, ব্রণনাশকারী ও বর্ণপ্রসাদক।
খাওয়ার বিধি:
রোগ ব্যাধি বিশেষে হলুদ সেবনের মাত্রা ও অনুপান ভিন্ন ভিন্ন। তবে প্রাথমিকভাবে হলুদ কাঁচা হলে দু থেকে তিন চামচ রস দিনে দু’বার ও হলুদ গুঁড়ো হলে ছোট চামচের এক চামচ দিনে দু’বার খাওয়া যায়।
দুধ হলুদের গুণাগুণ:
আয়ুর্বেদ মতে একক দ্রব্য বা ভেষজ যতটা কার্যকরী তা সঠিক অনুপান বা সহপানের সঙ্গে গ্রহণ করলে তার কার্যকারিতা অনেকাংশে বেড়ে যায়। ঠিক সেভাবেই দুধ ও হলুদ একসঙ্গে সেবন, পৃথক সেবন থেকে অধিক লাভজনক। বর্তমান গবেষণায় দেখা গেছে যে এই দুধ হলুদের মধ্যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল,ও অ্যান্টিইনফ্লামেটরি ক্ষমতা বর্তমান। যা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং আবহাওয়া পরিবর্তনজনিত সর্দি, কাশি, স্বরভঙ্গ ও যে কোনও ইনফেকশনজনিত কাশিতে এটি অব্যর্থ। প্রধানত বাচ্চাদের ক্ষেত্রে যেখানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যাঁরা প্রতিনিয়ত সর্দি, কাশিতে ভোগেন তাঁদের জন্য এই দুধ হলুদ অমৃত সমান। এছাড়াও আয়ুর্বেদ মতে এটি রক্তশুদ্ধিকর, বর্ণপ্রসাদক, বেদনানাশক, ক্যান্সার প্রতিরোধক ও অনিদ্রার হিতকর।
খাদ্যগুণে হলুদ:
খাদ্যগুণে হলুদ আয়রন ও ম্যাগনেশিয়ামে ভরপুর, এছাড়াও হলুদে ভিটামিন বি ৬, ফাইবার, কপার ও পটাশিয়াম থাকে, যা সুস্থ শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান। এছাড়া খাদ্যে রং আনতে হলুদের একটা ভূমিকা আছে।
বিবিধ চর্মরোগের সমস্যায় ব্রহ্মাস্ত্র হলুদ:
অ্যালার্জি, শীতপিত্ত, ছুলি বা এগজিমা জাতীয় ত্বকের সমস্যায় স্নানের আগে কাঁচা হলুদ ও দূর্বা বাটা মাখুন। সমস্যা পুরনো হয়ে থাকলে এক চামচ ত্রিফলা চূর্ণের সঙ্গে ১/৪ ভাগ হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে দিন পনেরো সেবনীয়। হলুদ কটু এবং তিক্তরস প্রধান দ্রব্য এবং গুণে উষ্ণ ও রুক্ষ যা অ্যালার্জি জাতীয় ত্বকের রোগের প্রধান কারণ দেহের দূষিত কফ ও পিত্তকে প্রশমিত করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে হলুদের ভূমিকা:
দেখুন ক্যান্সারের ক্ষেত্রে হলুদের অবদান বলতে গেলে অনেক বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত। তবে সংক্ষেপে বলতে গেলে হলুদের প্রধান রাসায়নিক উপাদান হল কারকিউমিন, গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে এই কারকিউমিন বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার যেমন (ব্রেস্ট ক্যানসার, ফুসফুসের ক্যান্সার, প্রস্ট্রেট ক্যান্সার, স্কোয়ামাস সেল ক্যান্সার) ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত করে এবং কোষের মৃত্যু ঘটায়।
ব্রণের সমস্যায় হলুদ:
যাদের ব্রনের সমস্যা আছে তাদের ক্ষেত্রে হলুদের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রয়োগ যথেষ্ট কার্যকরী। যেমন, সকালে খালিপেটে একটুকরো কাঁচা হলুদ বা হলুদের রস দুই থেকে তিন চামচ সেবনীয়। সঙ্গে নিমপাতা ও হলুদ বাটা একসঙ্গে মিশিয়ে ব্রণতে প্রলেপ দিলে রক্তবিকার জনিত দূষিত ব্রণও দ্রুত আরোগ্য লাভ করে। তবে নজর রাখুন নিয়মিত পেট পরিষ্কার ও সুপথ্যের প্রতি।
বলিরেখা দূর করতে হরিদ্রা:
জৌলুসহীন ত্বক বা মুখের বলিরেখার জন্য হলুদ গুঁড়ো, টম্যাটোর রস, কাঁচা দুধের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়মিত ব্যবহার করুন। ত্বকের উজ্জ্বলতা যেমন ফিরে আসে সঙ্গে বলিরেখাও মিলিয়ে যায়। দীর্ঘস্থায়ী ফল পেতে এর পাশাপাশি অনিদ্রা ও মানসিক উদ্বেগ থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন।
চোখের নীচে কালি থেকে মুক্তি দেয় হলুদ:
চোখের নীচের কালো দাগ সব সৌন্দর্যের বড় অন্তরায়। এক্ষেত্রে হলুদ গুঁড়ো দুধের সরের সঙ্গে মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে চোখের চারপাশে প্রলেপ দিয়ে মিনিট ১৫ রাখুন। তারপর গোলাপ জলে ধুয়ে ফেলুন। সঙ্গে রাতজাগা ও অন্ধকারে দীর্ঘক্ষণ মোবাইল বা ল্যাপটপ ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
তারুণ্য বজায় রাখতে হলুদ:
চিরযৌবন প্রাপ্তির আশা প্রায় সবাই করে। সেক্ষেত্রে কাঁচা হলুদ ও কাঁচা আমলকীর পেস্ট বানিয়ে নিন। মেশাতে পারেন কয়েক ফোঁটা গ্লিসারিন। এটি ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখবে, আবার লোমকূপের গভীরে গিয়ে ত্বকে পুষ্টিও যোগাবে। অন্যদিকে প্রত্যহ পরিমাণমতো ব্রেকফাস্ট জরুরি কারণ আয়ুর্বেদ মতে সপ্তধাতুর পুষ্টির ক্ষেত্রে জঠরাগ্নির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অবাঞ্ছিত দাগের সমস্যায় হলুদ:
অনাকাঙ্ক্ষিত দাগ বা ক্ষতরোপণ হওয়ার পর দাগ থেকে গেলে একচামচ গাওয়া ঘিয়ের সঙ্গে হলুদ মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে মাখুন। রোজ দু’বার ব্যবহার করলে তা ধীরে ধীরে কমে যায়। তৈলাক্ত ত্বকের ক্ষেত্রে ঘিয়ের পরিবর্তে ঘৃতকুমারীর রস ব্যবহার করা যায়।
ব্যথা যন্ত্রণায় হলুদ:
হলুদের অ্যান্টিইনফ্লামেটরি গুণের দরুন এটি বিবিধ ব্যথা যন্ত্রণা কমাতে কার্যকর।
যন্ত্রণা ও ফোলা কমাতে হলুদ লেপ:
মচকে যাওয়া জনিত যন্ত্রণা ও ফোলায় চুন ও হলুদ গুঁড়ো গরম জলে মিশিয়ে পেস্টের মতো করে লেপ দিলে আক্রান্ত স্থানের ফোলা ও যন্ত্রণার আরাম হয়।
চক্ষুস্য হলুদ:
চোখের প্রাথমিক সমস্যা অর্থাৎ ঘন ঘন পিঁচুটি পড়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া বা চোখের চুলকুনি ভাব ইত্যাদি ক্ষেত্রে হলুদ জল দিয়ে চোখ ধুলে আরাম পাওয়া যায়।
রোগ নিরাময়ে নিম
ডাঃ আব্দুর রহমান
কথিত আছে, গরুড় যখন স্বর্গ থেকে অমৃত কলস নিয়ে যাচ্ছিল তখন তার ডানার ঝাপটায় অমৃতের কয়েক ফোঁটা মর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল, আর এই অমৃতের কয়েক ফোঁটা নিম গাছেও পড়ার ফলে নিমের মধ্যে রোগ নিরাময়কারী গুণের সঞ্চার ঘটে। নিম গাছের পাতা থেকে ফল প্রতিটা অংশ সমানভাবে উপকারী। আমাদের প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির ভিত্তি, আয়ুর্বেদ গ্রন্থ-‘চরক-সংহিতা’এবং ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় নিমের ঔষধ গুণাবলি উল্লেখ করা হয়েছে। আয়ুর্বেদিক গ্রন্থে এটিকে ‘সর্ব রোগ নিবারণী’ (সমস্ত অসুস্থতার সর্বজনীন উপশমকারী) হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ঔষধি গুণের কারণে পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে নিম।
প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময়ের একটি আদর্শ ভেষজ উপাদান নিম। এতে প্রায় ১৩০টিরও বেশি জৈবিকভাবে সক্রিয় যৌগ রয়েছে। ফলে এটি একটি শক্তিশালী ইমিউনো-উদ্দীপক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান হিসেবেও কাজ করে।
আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে নিম পাতায় রয়েছে ভিটামিন ও খনিজের ভাণ্ডার। এছাড়াও এই পাতায় প্রচুর পরিমাণে উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টও মজুত রয়েছে। আর এই উপাদান কিন্তু আমাদের একাধিক প্রাণঘাতী রোগের হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম।
তাই আজকে আমরা নিম পাতার একাধিক চমকে দেওয়া গুণাবলি সম্পর্কে জেনে নেব। আশা করছি, এই প্রতিবেদনটি শেষ পর্যন্ত পড়ার পর আপনিও নিমের তেতো স্বাদের ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়বেন।
আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে নিমগাছ:
নিমের ইংরেজি নাম Neem, বৈজ্ঞানিক বা উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম হল Azadirachta indica Juss., এটি Meliaceae পরিবারের একটি গাছ। নিমকে নিম্ব, ভেপা, তামার আরও অনেক নামে ডাকা হয়। নিমের জনপ্রিয়তা অনাদিকাল থেকে চলে আসছে। নিমের পাতা থেকে ছাল, শেকড় থেকে ফুল, ফল থেকে বীজ সবগুলোই আবশ্যকীয়ভাবে কাজে লাগে। নিমের গুণ অতুলনীয়। নিম অনেক দ্রুতবর্ধনশীল গাছ। নিম বহুবর্ষজীবী মাঝারি ধরনের চিরহরিৎ বৃক্ষ। নিমের বহুবিধ গুণের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জন্য এত উপকারী গাছ আজ অবধি আবিষ্কৃত হয়নি। এজন্য বলা হয় নিম পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বৃক্ষ। নিমের এ গুণাগুণের কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নিমকে ‘একুশ শতকের বৃক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছে। নিমের গুণাগুণ সম্পর্কে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের ধারণা থাকলেও নিম নিয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়েছে হাল আমলে। বর্তমান সময়ে মানুষের মধ্যে নিম নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
রাসায়নিক উপাদান: নিমের ছাল, ফুল, ফল, বীজে ও তেলে বিভিন্ন ধরনের তিক্ত উপাদান যেমন স্যাপোনিন, এলকালয়েড নিমবিডিন, নিম্বন, নিম্বিনিন, নিম্বডল, ট্রাইটারপেনয়েড, সালনিন, এজাডিরাকটিন, জৈব অ্যাসিডমেলিয়ানোন, নিম্বোলাইড, কুয়েরসেটিন ও গ্লাইকোসাইড, ট্যানিন, মারগোসিন, এজমডারিন এসব যৌগ থাকে।
তাছাড়া নিমে রয়েছে অসংখ্য আশ্চর্যজনক উপকারিতা। এটি অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল পাশাপাশি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এবং এটি ভাইরাল, হেলমিন্থিক এবং প্রদাহজনিত রোগ প্রতিরোধ করে. এটি অ্যান্টিক্যারিওজেনিক এবং অ্যান্টিকার্সিনোজেনিকও।
এবার আয়ুর্বেদের দৃষ্টিতে দেখে নেওয়া যাক
নিমকে আয়ুর্বেদে ‘অরিষ্টা’ বলা হয়—যার অর্থ হল ‘নিখুঁত, সম্পূর্ণ এবং অবিনশ্বর’। এর একটি সংস্কৃত নাম ‘নিম্ব’ শব্দটি এসেছে ‘নিম্বাতি স্বাস্থ্যমদদাতি’ শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘সুস্বাস্থ্য দেওয়া’। ‘পিঁচুমর্দ’ সংস্কৃতে নিমের আরেকটি নাম যার অর্থ কুষ্ঠরোগ ধ্বংসকারী এবং ত্বকের সংক্রমণ নিরাময়কারী।
নিম এমন একটি গাছ, যার কাণ্ড থেকে শুরু করে পাতা, ছাল, ফল সহ প্রায় সমস্ত অংশেরই ঔষধি গুণ রয়েছে। তাই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে নিম গাছকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আয়ুর্বেদিক অন্তর্নিহিত গুণাগুণ (রসপঞ্চক)
রস- তিক্ত, কষায়
গুণ- লঘু, রুক্ষ
বিপাক- কটু
প্রকৃতি- শীত
দোষকর্ম- পিত্ত, কফনাশক
কর্ম- নিমপাতা-কৃমিঘ্ন, নেত্র রোগে উপকারী, বিষঘ্ন, কুষ্ঠঘ্ন, রুচিকর, ব্রণনাশক, কাসহর, শ্বাস রোগে উপকারী
নিম ছাল- জ্বরনাশক, শোথহর, প্রমেহহর, কুষ্ঠঘ্ন, কৃমিঘ্ন, শ্রমহর।
নিমফল- কুষ্ঠ অর্থাৎ ত্বক রোগে উপকারী, অর্শ রোগে উপকারী, গুল্ম রোগে উপকারী
নিমফুল – কৃমিঘ্ন, বিষঘ্ন
নিমবীজ- কৃমিঘ্ন, কুষ্ঠঘ্ন
নিমের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য উপকারিতা—
রক্তে শর্করা কমাতে নিমের ব্যবহার
ডায়াবেটিসের মতো অসুখকে নিয়ন্ত্রণে না রাখতে পারলে কিডনি, লিভার, চোখ, স্নায়ুসহ দেহের একাধিক অঙ্গের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই যেনতেনপ্রকারেণ ডায়াবেটিসকে কন্ট্রোলে রাখতে হবে। আর এই কাজে আপনাকে সাহায্য করতে পারে নিম পাতা। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত এক গবেষণা জানাচ্ছে, নিয়মিত নিম পাতা খেলে অনায়াসে ব্লাড সুগারকে স্বাভাবিকের গণ্ডিতে বেঁধে রাখা যায়। তাই ডায়াবেটিস রোগীর ডায়েটে অবশ্যই নিম পাতাকে জুড়ে দেওয়া দরকার। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নিম যেভাবে কাজ করে বলে গবেষণায় মনে করা হয়—
খাদ্যের শর্করাকে গ্লুকোজে রূপান্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসেচক হল অন্ত্রের গ্লুকোসাইডেজ। নিম পাতার নির্যাস অন্ত্রের এই উৎসেচকের কার্যকারিতা ৩৫ শতাংশ থেকে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দেয়, ফলে পরিপাকের পর খাদ্য থেকে গ্লুকোজ খুব দ্রুত ও বেশি মাত্রায় রক্তে প্রবেশ করতে পারে না।
নিম ইনসুলিন নিঃসরণকারী অগ্ন্যাশয়ের বিটা কোষের সংখ্যা ও সংবেদনশীলতা বাড়ায়।
কোষে শক্তি হিসাবে প্রবেশের পর অতিরিক্ত গ্লুকোজ গ্লাইকোজেন আকারে শরীরের বিভিন্ন কোষে জমা হয়। এর ফলে রক্তে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজের উপস্থিতি থাকে না। গ্লুকোজকে এই গ্লাইকোজেনে রূপান্তর করতে গ্লুকোজ-৬-ফসফেট ডিহাইড্রোনেজ নামক উৎসেচক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ডায়াবেটিসে এই উৎসেচকের কার্যকারিতা কমে যায়। নিম পাতার নির্যাস এই উৎসেচকের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
রক্তে মাত্রাতিরিক্ত গ্লুকোজের উপস্থিতিতে বিটা কোষ ইনসুলিন নিঃসরণ করে। কিন্তু সেরোটোনিন ইনসুলিন নিঃসরণে বাধা সৃষ্টি করে। নিম সেরোটোনিনের কাজে বাধা দেওয়ার মাধ্যমে ইনসুলিনের নিঃসরণ স্বাভাবিক রাখে।
আর্থ্রাইটিসের ব্যথা কমায়
আধুনিক জীবনাভ্যাসের কারণে বয়সের কাটা ৩০ পেরতে না পেরতেই এখন অনেকেই আর্থ্রাইটিসের ফাঁদে পড়ছেন। আর তারপর সারাজীবন ধরে ব্যথা, জ্বালা সহ্য করে চলেছেন। তবে বিশ্বাস করুন, আপনার এই সমস্যার সহজ সমাধান করে দিতে পারে নিম পাতা। আসলে নিমে রয়েছে ‘নিম্বিডিন’নামক একটি উপাদান। আর এই উপাদান কিন্তু জয়েন্টের প্রদাহ দূর করতে সিদ্ধহস্ত। ফলে আর্থ্রাইটিসের ব্যথা-জ্বালা কমতে সময় লাগে না। তাই এই রোগে ভুক্তভোগীরা অবশ্যই রোজের ডায়েটে নিম পাতাকে জায়গা করে দিতে পারেন।
সংক্রমণে উপকারী : নিমের মধ্যে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল এবং অ্যান্টিভাইরাল গুণ রয়েছে। তাই নিয়মিত নিম পাতা খেলে যে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ফাঙ্গাসের মতো জীবাণুর সঙ্গে লড়াই করবে, তা তো বলাই বাহুল্য। এই কারণেই বছরে একাধিকবার যাঁরা বিভিন্ন রকম সংক্রমণে ভোগেন তাঁদের ডায়েটে নিম পাতা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই কাজটুকু করতে পারলেই সুস্থ থাকার পথ আরও প্রশস্ত হবে।
যকৃতের রোগে উপকারী: আমাদের শরীরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হল যকৃৎ বা লিভার। এই অঙ্গটি খাবার হজমে সাহায্য করা থেকে শুরু করে শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেওয়া সহ একাধিক কাজ একা হাতে সামলায়। তাই যকৃতের সুস্থ থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। আর যকৃৎকে সুস্থ রাখতে চাইলে ডায়েটে নিম পাতাকে জায়গা করে দিতেই হবে। এভাবেই ফ্যাটি লিভার, লিভার ফাইব্রোসিস সহ একাধিক প্রাণঘাতী রোগকে দূরে রাখতে পারবেন, তা গবেষণায় প্রমাণিত।
গ্যাস অম্বলে উপকারী: নিমে এমন কিছু অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা কি না পাকস্থলীতে অ্যাসিডের ক্ষরণ কয়েকগুণ কমাতে পারে। তাই যাঁরা নিয়মিত বুক জ্বালা এবং টক ঢেকুর ওঠার মতো সমস্যায় ভোগেন তাঁরা নিজেদের খাদ্য তালিকায় নিমকে জায়গা করে দিন। এতেই কিন্তু উপকার মিলবে হাতেনাতে।
চুলের সমস্যা কমাতে: নিমে থাকে ‘অ্যাজাডাইর্যাক্টিন’ ও ‘নিমবাইডিন’ নামক দু’টি উপাদান। উকুন নিধনে ও মাথার ত্বকের চুলকানির বা খুশকির সমস্যায় এই উপাদানগুলি খুবই কার্যকরী। নিম পাতার রস মাথায় নিয়মিত লাগাতে পারলে চুলকানির সমস্যা কমে যায়। অথবা নিম তেল মাখলেও সমান উপকা??