গৃহসুখ বৃদ্ধি ও সপরিবারে আনন্দ উপভোগ। অন্যের দোষের দায়বহন করতে হতে পারে। ... বিশদ
শিশুদের দিকে তাকান। একবার হাঁটতে শেখার পর সারাদিনে কতটুকু তারা হাঁটল, কতখানি তাতে কাজ হল, সেদিকে কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। তাদের ওই পথ চলাতেই আনন্দ! আর সেই কারণেই ওদের শরীর ছিপছিপে হয়। রোগবিরেত যা হয়, তাও দ্রুত সেরে যায়। বড়দের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একইরকম। হাঁটলেই শরীরের প্রভূত উন্নতি হয়। বিশেষ করে শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটে। কারণ হাঁটলেই শরীরের বিভিন্ন পেশিগুলিতে প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেনের দরকার পড়ে। দ্রুত হারে সেই অক্সিজেন পেশিতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শরীরে রক্ত সঞ্চালনের হারও বাড়ে।
পেশির বৃদ্ধি
হাঁটাহাঁটির অভ্যেসে শরীরের পেশিরও বৃদ্ধি ঘটে। কারণ পেশিতে যত বেশি রক্ত সঞ্চালন হয়, পেশির আকারও তত বাড়তে থাকে। ফ্যাট জমে কম। আমাদের শরীরের মেটাবলিজম প্রক্রিয়ারও বিরাট পরিবর্তন হয় হাঁটাহাঁটির অভ্যেসে। মেটাবলিজম বা বিপাকক্রিয়ার গন্ডগোলেই রাজ্যের অসুখ এসে ভিড় করে শরীরে।
হাঁটাহাঁটি করলেই মেটাবলিজম বাড়ে। খেয়াল করে দেখুন গ্লুকোজের মেটাবলিজমের অভাবেই কিন্তু ডায়াবেটিস হয়। হাঁটাহাঁটির অভ্যেসে শর্করার বিপাক স্বাভাবিকভাবে হয়। এই কারণেই ডায়াবেটিস রোগীকে নিয়মিত হাঁটতে বলা হয়। এমনকী যাঁদের ডায়াবেটিস নেই, তাঁরাও নিয়মিত হাঁটলে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়। এমনকী একটানা তিনমাস ১০ হাজার পা হাঁটলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাও হ্রাস পেতে থাকে।
মনমেজাজ ভালো রাখে
রোজকার জীবনের নানা ধরনের সমস্যা আমাদের গ্রাস করে। সেই সমস্যা থেকে মন খারাপ হয়। হতাশা ঘিরে ধরে। কাজ করতে ইচ্ছে হয় না। দেখা গিয়েছে, হাঁটাহাঁটি করলে আমাদের শরীরে এন্ডোর্ফিন হরমোন বের হয়। এই হরমোন দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। মানসিকভাবে ইতিবাচক থাকতে পারি আমরা।
কোন বয়সে হাঁটবেন?
যে কোনও বয়সেই হাঁটা যায়। খুব বেশি বয়সে হনহন করে হাঁটতে না পারলেও চিন্তা নেই। প্রথমে ধীরেসুস্থে হাঁটলেও চলবে। তাতে আত্মবিশ্বাস বাড়বে। তবে হাঁটতে হবে। তাহলেই সমগ্র শরীরের উপকার হবে। জানলে অবাক হবেন, সারা শরীরের পেশির বৃদ্ধিতেই হাঁটাহাঁটি কাজে আসে।
হাঁটলে কী কী লাভ?
পায়ের পেশি: কাফ মাসল শক্তিশালী হয় রোজ চল্লিশ মিনিট হাঁটলে। এই কাফ মাসলের মধ্যে থাকে গ্যাস্ট্রোনিমিয়াস, সোলিয়াস পেশি। এই পেশিগুলির উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। উন্নতি হয় কোয়ড্রিশেপস পেশিরও। আবার হ্যামস্ট্রিং মাসলের অন্তর্ভুক্ত বাইসেপস ফিমোরিস, সেমিমেমব্রানোসাস, সেমি টেনডোনিয়াস পেশিগুলিও ক্রমে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এছাড়া থাই-এর পেশির মধ্যে আছে পেক্টিনিয়াস, অ্যাডাকটর ব্রেভিস, অ্যাডকটর লংগাস, ভাসটাস মিডিয়ালিস, ভাসটাস ইন্টারমিডিয়াস এবং রেকটাস ফিমোরিস। হাঁটলে এই পেশিগুলিও ক্রমশ শক্তিশালী হয়। পায়ের পেশিগুলি শক্তিশালী হওয়ার অন্যতম ভালো ফল হল, অস্টিওআর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে। এছাড়া পায়ের রক্তবাহী নালীগুলির মধ্যে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক হয়। এটি হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ তাতে হ্রাস পায় ডিপ ভেন থ্রম্বোসিস-এর আশঙ্কা।
পিঠ ও কোমর: ইরেকটার স্পাইনি, সোয়াস মেজরের মতো পেশিগুলি শরীরের ভার বয়। মেরুদণ্ড সোজা থাকে এই পেশিগুলির সহায়তায়। নিয়মিত হাঁটাহাঁটির অভ্যেসে এই পেশিগুলি শক্তিশালী হয়।
কাঁধ: সঠিকভাবে হাঁটলে ডেলটয়েড, টেরিস মেজর এবং মাইনর, রমবয়েড ইত্যাদি পেশিগুলির জোর বাড়ে। কারণ হাঁটার সময় হাতেরও সঞ্চালন ঘটে।
বুক: পেকটরলিস মেজর এবং মাইনর পেশিগুলি কাঁধের সঙ্গে সংযুক্তি বজায় রাখে। এছাড়া ভারী কিছু তুলতে, ছুড়ে ফেলতে সাহায্য করে পেশিগুলি। হাঁটলে এই মাসলগুলিরও বৃদ্ধি হয়।
হাত: হাতের সেরেটাস অ্যান্টিরিওর, ডরসির মতো পেশিগুলির সচলতা বৃদ্ধি পায়।
পেট: হাঁটাহাঁটি করলে রেকটাস অ্যাবডোমিনিজ, ট্রান্সভার্স অ্যাবডোমিনিজ, অবলিকাস মাসলের মতো পেটের পেশিগুলির জোর বাড়ে। উল্লেখ্য, রোজ হাঁটলে এই পেশিগুলির সঠিক সঞ্চালন হয়। এছাড়া পেটের অন্দরে থাকা বৃহদন্ত্রের পেরিস্টলসিস বা সংকোচন-প্রসারণ হয় সঠিকভাবে। তাতে কনস্টিপেশন প্রতিরোধ করা যায়।
ফুসফুস: হনহন করে বা দ্রুত বেগে হাঁটলে ফুসফুসের ব্যায়াম হয়। ফুসফুসকে বেশি পরিমাণ বাতাস টানতে হয় ও ছাড়তে হয়। এর ফলে ফুসফুস থেকে বেশি পরিমাণে কার্বন ডাই অক্সাইড বেরতে থাকে। এইভাবে খুব অল্প বয়স থেকে নিত্য হাঁটাহাঁটির অভ্যেস ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের আশঙ্কা কমিয়ে দেয়।
ওজন হ্রাস: হাঁটলেই আমাদের ক্যালোরি বা শক্তির দরকার হয়। আর পরিশ্রম করতে শুরু করলেই শরীর দেহে জমানো ফ্যাট গলিয়ে এনার্জির জোগান দেয়।
সুতরাং শুধু হেঁটেই অতিরিক্ত মেদ ঝরানো সম্ভব। রোজ অন্তত ৪০ মিনিটে ৩-৪ কিমি হেঁটে পার করতে পারলে ওজন কমবে। সপ্তাহে অন্তত একদিন অবশ্যই বিশ্রাম নিন।
মেরুদণ্ড: যাঁদের মেরুদণ্ডে বাতের সমস্যা আছে, তাঁদের বিভিন্ন ধরনের এক্সারসাইজ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এমন ক্ষেত্রে তাঁরা হাঁটাহাঁটি করতে পারেন নিশ্চিন্তে।
দূরে রাখে ফ্রি র্যাডিক্যালস এবং ক্যান্সার: আমরা জানি বিপাকক্রিয়ার দরুন শরীরে নানা ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান তৈরি হয়। এই উপাদানগুলি আবার কোষের ক্ষয় ঘটায়। কোষের অকালমৃত্যু, জিনের নানা সমস্যা তৈরি করতে পারে। এই ধরনের উপাদানগুলিকে বলে ফ্রি । শরীরে ফ্রি বাড়লে ক্যান্সারের আশঙ্কাও বাড়ে। নিয়মিত হাঁটাহাঁটির অভ্যেসে বিপাকক্রিয়ার উন্নতি হয়, বিবিধ উপকারী হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে, যা এই ধরনের ফ্রি প্রতিহত করতে সাহায্য করে। এছাড়া হাঁটলে শরীরে ঘাম বের হয় আর ঘামের মাধ্যমে ক্ষতিকর বর্জ্য বেরিয়ে যেতে থাকে।
কীভাবে হাঁটবেন
• হনহন করে দ্রুত হাঁটবেন। • হাঁটাহাঁটির সময় চপ্পল নয়। চেষ্টা করুন স্নিকার্স পরতে। মেশিনে হাঁটলেও স্নিকার্স পরবেন • পেট পুরে খাবার খেয়ে হাঁটবেন না। চেষ্টা করুন খালি পেটে হাঁটতে। তা সম্ভব না হলে অন্তত খাবার খাওয়ার আধঘণ্টা পরে হাঁটুন।
• রাতে খেয়েই শুয়ে পড়বেন না। হালকা হাঁটাহাঁটি করুন। রাতে খাবার পর হাঁটলে খাবার হজম হয়। গ্যাস-অম্বল হয় না। কোষ্ঠকাঠিন্যও প্রতিরোধ হয়।
ভ্রমণ প্রাণায়াম: বিখ্যাত যোগগুরু শিবানন্দ সরস্বতীর এক বিখ্যাত আবিষ্কার ভ্রমণ প্রাণায়াম। তা কেমন? তা হল, হাঁটতে হাঁটতেও প্রাণায়াম অভ্যেস করা যায়। এই প্রাণায়ামে হাঁটার সময় চার পা শ্বাস নিতে নিতে এগন, তারপর চার পা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে এগন। অভ্যেস হয়ে গেলে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়ার সময়কাল বাড়াতে পারেন। এই ভ্রমণ প্রাণায়ামে শ্বাসকষ্ট কমে, মেদ কমে এবং শরীরে তরতাজা ভাব অনুভূত হয়।
কিছু টিপস
বয়স সত্তরের উপরে হলে হাঁটাহাঁটি শুরু করার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কিছু কিছু শারীরিক সমস্যায় ইচ্ছেমতো হাঁটাহাঁটি করা যায় না।
কিছু ভুল ধারণা
বাড়ির কাজে, বাজারে, মলে হেঁটে শরীর ও স্বাস্থ্যের বিশেষ উন্নতি হয় না। নির্দিষ্ট ছন্দে এবং বাধারহিত হাঁটলে তবেই মেলে উপকার। বাজারে, হাটে, কিংবা বাড়ির কাজের হাঁটাহাঁটিতে ছন্দের অভাব সুস্পষ্ট। তাই শরীরে উন্নতি করতে হলে হাঁটার জন্য একটা সময় বের করুন। এতে শরীরে মেদ জমবে না। হাঁটুর উপর চাপ কম পড়বে। অল্পবয়সেই অস্টিওআর্থ্রাইটিসের কবলে পড়তে হবে না।
চেয়ারে বসে হাঁটা
একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে পড়ুন। এরপর বসে বসেই ডান-পা’কে যতটা পারুন উপরে তুলে পেটের কাছে আনুন। তারপর ডান পা’কে মেঝেয় নামিয়ে বাম পা’কে পেটের কাছে তুলুন। এইভাবে মার্চ করার মতো বারবার একবার ডান পা আর একবার বাম পা তুলুন।
শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখুন। একইসঙ্গে হাঁটবার সময় যেভাবে হাতদু’টি আন্দোলিত হয়, সেইরকমভাবে হাতদু’টিকে দোলান। অনেক বেশি উপকার পাবেন। ৫ মিনিট ব্যায়ামটি করতে পারেন। শুধু বয়স্ক কেন, ডায়াবেটিস, কোলেস্টেরলের সমস্যায় আক্রান্ত অফিসকর্মীরা অফিসের চেয়ারে বসেই এই ব্যায়ামটি করুন। উপকার পাবেনই।
প্রাণায়াম
তবে শুধু হাঁটাহাঁটি নয়, তার সঙ্গে দরকার প্রাণায়াম করার। শীতকাল চলছে। তাই নিম্নলিখিত প্রাণায়ামগুলি করুন ৫ মিনিট করে।
ভ্রামরী: বাবু হয়ে বসুন। দু’ হাতের আঙুল দিয়ে দু’ কানের ছিদ্র ও চোখ বন্ধ করুন। এর পর নাক দিয়ে শ্বাস নেওয়ার পর ভ্রমরের মতো গুঞ্জন করতে করতে নাক দিয়েই শ্বাস ছাড়ুন। শ্বাস ত্যাগের সময় কানের পর্দায় এক কম্পন অনুভব করবেন। শ্বাস নিয়ে গুঞ্জন করে শ্বাস ছাড়ার প্রক্রিয়াকে ১ সেট বলে। এইভাবে ৬ বার করুন। এই প্রাণায়াম কানে কম শোনা, কানে ব্যথা, প্রদাহ কমায়।
উজ্জয়ী: এক্ষেত্রে প্রথমে পদ্মাসনে, বাবু হয়ে বা চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসুন। হাত দু’টি থাকবে হাঁটুর উপর। তর্জনিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ধরুন। অন্য আঙুলগুলি টানাটান থাকবে। মাথা সামান্য ঝুঁকে থাকবে। এমতাবস্থায় দুই নাক দিয়ে খুব ধীরে ধীরে আরাম করে ফুসফুস ভর্তি শ্বাস নিন। শ্বাস নেওয়া হয়ে গেলে ১ সেকেন্ড শ্বাস চেপে রাখুন। তারপর ধীরে ধীরে আরাম করে দুই নাক দিয়ে পুরো শ্বাস ছাড়ুন।
খেয়াল রাখবেন, ঠিক যতটা সময় ধরে যতটা শ্বাস নিচ্ছেন, ঠিক ততখানি সময় ধরে শ্বাস ছাড়তে হবে। এভাবে মিনিট খানেক করুন। এই প্রাণায়াম ফুসফুসের কার্যক্ষমতা বাড়ায়। মনকে শান্ত, একাগ্র করে তোলে।