গৃহসুখ বৃদ্ধি ও সপরিবারে আনন্দ উপভোগ। অন্যের দোষের দায়বহন করতে হতে পারে। ... বিশদ
হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো বঙ্গসাহিত্যের আদি যুগের প্রাচীনতম নিদর্শন হল চর্যাপদ। সেখানে নানা নিম্ন পেশাদারদের দেখা মিললেও ডাক্তারদের বোধ হয় পাওয়া যায় না। মধ্যযুগের প্রথম পর্বে ছ’শো বছরেরও বেশি আগে বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এ সম্ভবত প্রথম ডাক্তারদের খোঁজ আমরা পাই। কিন্তু ডাক্তার বোঝাতে সেখানে ‘বেজ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ বৈদ্য। শব্দটির ব্যবহার মধ্যযুগের শেষ পর্বেও ছিল। যেমন, শ্রীচৈতন্যদেবকে ঘিরে যে জীবনীসাহিত্য গড়ে উঠেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে রচিত বৃন্দাবন দাসের শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত। আয়ুর্বেদচর্চাকারী বৈদ্যদের কবিরাজ বলা হলেও সেই আমলে কিন্তু কবিরাজ বলতে চিকিৎসকদের বোঝাত না— অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিদের বোঝাত! যেমন বৈষ্ণব পদাবলীকার গোবিন্দদাস কবিরাজ।
মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফসল অনুবাদ সাহিত্যের ধারা। বাঙালির বাংলায় ‘রামায়ণ’ পড়তে পারার পিছনে সবথেকে বড় অবদান রয়েছে কৃত্তিবাস ওঝার কলমের। সেখানে মানুষ রাম-লক্ষণের চিকিৎসার ভার নিয়েছিলেন মনুষ্যেতর ভল্লুকগোত্রীয় জাম্বুবান। তাঁরই কথায় হনুমান বয়ে নিয়ে এসেছিলেন গন্ধমাদন পাহাড়। আবার ওঝা বলতে আগে লোকে পণ্ডিত বুঝত। বর্তমানে সচেতন লোকজন ওঝা বলতে কুসংস্কারভিত্তিক ঝাড়ফুঁক, তুকতাককারীদের বোঝেন। কিন্তু আজকের বহু কুসংস্কারাচ্ছন্নের মতো মধ্যযুগীয় সাহিত্যেও তারা গ্রামীণ বা লোকায়ত সাপে কাটার চিকিৎসকের মর্যাদা লাভ করত। ‘মৈমনসিংহগীতিকা’-র ‘মহুয়া’ পালায় চান্দ বিনোদকে সাপে কামড়ালে স্ত্রী মলুয়া মৃত স্বামীকে নিয়ে গাড়রী ওঝার বাড়ি গিয়েছিলেন। সাপের শত্রু গরুড়ের সঙ্গে মিল রেখে ওঝাদের গাড়রি বা গারুড়ি বলা হতো। বিখ্যাত মঙ্গলকাব্যধারার অন্যতম হল ১৪৯৪ সালে লেখা বরিশালের বিজয় গুপ্তের পদ্মা পুরাণ বা মনসামঙ্গল। সেখানে ওঝা জাতীয় লোকচিকিৎসকের ধন্বন্তরি নামকরণের মাধ্যমে পুরাণ অনুযায়ী চিকিৎসাবিদ্যার দেবতা ধন্বন্তরিকে মেলানো হয়েছে।
শাক্ত পদাবলীর ‘ভক্তের আকুতি’ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবি অষ্টাদশ শতাব্দীর কুমারহট্ট বা হালিশহরে রামপ্রসাদ সেনের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বৈদ্য বা চিকিৎসক। তাঁর গোত্রের নামও ছিল ধন্বন্তরি।
মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্য ছেড়ে এবার আমরা আসি উনিশ শতকের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যুগে। রামমোহনবিরোধী সাহিত্যিক-সাংবাদিক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘বৈদ্য সংবাদ’ নামে একটি নিবন্ধ। এক অর্থলোভী কবিরাজের হাতে পড়ে রোগীমৃত্যুর একটি ঘটনার নমুনা দিয়ে তিনি কবিরাজদের এক মহাসভা বা সমিতি গঠন করার দাবি তুলেছিলেন। পাশাপাশি এও বলেছিলেন যে এতে নিযুক্ত প্রধান কবিরাজের উপরেই চিকিৎসা করার দায়িত্ব বর্তাবে।
বঙ্গভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ অক্ষয় কুমার দত্ত ১৮৫০ সালের বৈশাখে লিখেছিলেন ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন’ প্রবন্ধ। প্রকাশিত হয়েছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়। সেখানে চিকিৎসকের প্রতিশব্দরূপে তিনি ‘ভিষগ্’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
মাইকেল মধুসূদনের পরে আসছে তাঁরই বন্ধু বিখ্যাত প্রাবন্ধিক-শিক্ষক-শিক্ষাপ্রশাসক ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের কথা। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘পারিবারিক প্রবন্ধ’।
সে যুগেও ভুল চিকিৎসার জন্য তাঁর সব থেকে ছোট ছেলে কলেরায় আক্রান্ত সিদ্ধেশ্বরকে হারিয়েছিলেন তিনি। আফিংঘটিত অ্যালোপ্যাথিক ওষুধকে দায়ী করে তারপর থেকে হোমিওপ্যাথির দিকেই ঝোঁকেন তিনি। বইটির তেতাল্লিশতম প্রবন্ধটির নাম ছিল ‘ডাক্তার দেখান’। তা হতে এটি পরিষ্কার যে ভূদেববাবুর বাড়ির রোগী রোগে পড়লে শুধুমাত্র ডাক্তার দেখাতেন না, ভূদেববাবুও রোগী এবং ডাক্তার দুজনকেই দেখে নিতেন! ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ নিজে খেয়ে-বুঝে, মাত্রা কমিয়ে বা বাড়িয়ে রোগীকে খাওয়াতেন তিনি!
একবার একজন ইংরেজ ডাক্তার এসে অভিভাবকের এত সচেতনতা দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন।
ভবানী-ভূদেবের এই দু’টি ঘটনা পড়ে মনে আসতেই পারে লোকমুখে প্রচলিত ডাক্তারবিরোধী প্রবাদ ‘জল জোলাপ জোচ্চুরি— এই তিন নিয়ে ডাক্তারি’। কিন্তু সব ক্ষেত্রে তা সঠিক নয়। শ্রীরামকৃষ্ণ সাহিত্য লেখেননি। কিন্তু তাঁর মুখের সরল কথাই অনুলিখিত কথামৃত হয়ে সাহিত্যরসের ভিয়েন হয়ে গিয়েছে। লোকের কষ্টের সময় টাকার বিনিময়ে ডাক্তারি করাটাকে মহৎ ভাবতে পারতেন না তিনি। ডাক্তারদের টাকাকড়িকে ‘রক্ত পুঁজ’ বলে মনে করতেন। বাস্তব জগতে কিন্তু এ কথার সবটুকু ঠিক নয়।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের ‘লোকরহস্য’(১৮৭৪) গ্রন্থের বহুচর্চিত প্রবন্ধ হল ‘বাবু’। সেখানে বাঙালি বাবুদের দশ অবতারের মধ্যে একটি ডাক্তার বলে ঠাওরেছিলেন। বিখ্যাত ‘আনন্দমঠ’(১৮৮২) উপন্যাসের পরিণতির রাশ যিনি টেনেছিলেন, তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। ক্রিয়াত্মক সত্তায় তিনি জীবন্মৃত জীবানন্দকে যেমন বাঁচিয়েছেন, ভাবাত্মক সত্তায় সত্যানন্দকে দেশের কল্যাণপথের সঠিক গন্তব্যের নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বনামধন্য প্রহসনকার অমৃতলাল বসু ছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দুই বছরের ছাত্র। তারপর কাশীতে হোমিওপ্যাথ লোকনাথ মৈত্রের কাছে হোমিওপ্যাথি শেখেন ও বাঁকিপুরে প্র্যাকটিস করতে শুরু করেন। ‘বিবাহ বিভ্রাট’(১৮৮৪),‘তাজ্জব ব্যাপার’(১৮৯০) ও ‘খাসদখল’(১৯১২) তাঁর বিখ্যাত প্রহসন। প্রথমটিতে তিনি হাজির করেছিলেন বিলেতফেরত ডাক্তার মিস্টার সিংকে। তিনি বিলেতে হয়তো পরীক্ষা না দিয়েই শুধুমাত্র কোর্স ফি দিয়ে ডিগ্রি কিনেছিলেন। দ্বিতীয় নাটকের মাধ্যমে সম্ভবত আমরা বঙ্গনাট্যসাহিত্যে প্রথম মহিলা ডাক্তাররূপে গিরিবালা লাহিড়ীকে পাই, যাঁর ডিগ্রি ছিল এল.আর.সি.পি.। তিনি স্ত্রী স্বাধীনতার জন্য ডিম্বাশয় বাদ দিয়ে মেয়েদের সন্তান প্রসব বন্ধ করার মাধ্যমে দাড়িগোঁফ গজানোর প্রস্তাব করেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে এর কিছুকাল আগেই প্রথম বাঙালিনী ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজ থেকে বেরিয়েছেন। ফরাসি নাট্যকার মলিয়ারের নাটকের প্রভাবে লেখা ‘খাসদখল’ নাটকটিতে চটকদার, অর্থলিপ্সু ডাক্তারদের ভীষণ ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ করেছিলেন নাট্যকার। সেখানে ছিলেন ডঃ মিত্র, গুণধর ঘোষ, ডাক্তার ব্যানার্জি সহ আনন্দ কবিরাজ।
আসি আলোকিত ঠাকুরবাড়ির কথায়। ১৯০৫ সালে প্রকাশিত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘প্রবন্ধ-মঞ্জরী’ গ্রন্থের ‘বসন্ত-রোগ’ নামের প্রবন্ধে টিকাবিশেষজ্ঞ ডাক্তার গয়ের কথা লেখা আছে। তৎকালে কলকাতায় বহুজনের মারাত্মক বসন্ত হয়েছিল, ঘটেছিল প্রাণহানি।
জ্যোতির ছোট ভাই রবি তো দুই হাতে যেন দুই শতাব্দীর শেষ ও প্রথম চার দশককে ধরে রয়েছেন। নিজে দেশের ডাক্তারের পাশাপাশি বিলাতে গিয়েও চিকিৎসা তথা অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন। ভিয়েনার ডাক্তারদের সবচেয়ে বিচক্ষণ বলে মনে করতেন। নিজেও শখের হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারি করতেন। অমর্ত্য সেনের মা অমিতা সেন একবার অসুস্থতার সময় গুরুদেবের কাছ থেকে বায়োকেমিক ওষুধ পেয়েছিলেন। এমনকী একজনের পোষ্য কুকুরেরও চিকিৎসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিরাহিমপুরে নিজের জমিদারিতে প্রজাদের জন্য ডাক্তারখানা স্থাপন করে অলীক সুখ অনুভব করতেন তিনি।
গল্পগুচ্ছের ‘নিশীথে’(১৮৯৫) গল্পের বক্তা ছিলেন চিকিৎসক। তাঁর কপালে রোগীরূপে জুটেছিলেন জমিদার দক্ষিণাচরণবাবু। ফলে একবার নিশুতি রাতে ডাক্তারের ঘরে এসে জমিদারবাবু ওষুধে কাজ না হওয়ার অভিযোগ করতে পেরেছিলেন। সারারাত রোগীর গল্প শুনতে হয়েছিল ডাক্তারবাবুকে। ‘চোখের বালি’(১৯০৩) উপন্যাসের মহেন্দ্র-বিহারীকে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররূপে এবং ‘নৌকাডুবি’(১৯০৬) উপন্যাসে দেশের নানাস্থানে সুনামের সঙ্গে ডাক্তারি করা সরকারি চিকিৎসক নলিনাক্ষ চট্টোপাধ্যায়কে পাওয়া যায়। ‘ডাকঘর’ নাটকে দুই বিপ্রতীপ মনোভাবের কবিরাজ চরিত্রের দেখা মেলে। লৌকিক কবিরাজ নাকে নস্যি দিয়ে, কথায় কথায় আয়ুর্বেদশাস্ত্র আওড়ে, শরতের আলোবাতাস থেকে অমলকে দূরে রেখে ঘরে আটক থাকার বিধান দেন। শেষে অলৌকিক পারমার্থিক জগতের রাজকবিরাজ এসে অমলের ঘরবন্দি দশার মুক্তি ঘটান। তাঁর স্পর্শে অমল রাতের সব তারা দেখতে পায়, রোগবেদনা হতে মুক্ত হয়। এক নিবিড় নিদ্রায় জড়িয়ে জীবন হতে মহাজীবনের পথে যাত্রা করতে পারে সে।
ডাক্তারদের প্রতি আমাদের এক বিশেষ মনোভাবকে রবীন্দ্রনাথ খোলসা করেছেন আজ থেকে একশো এক বছর আগে ‘কালান্তর’ গ্রন্থের ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন, ডাক্তারবাবু কোনও শারীরিক বিকারের সহজ ব্যাখ্যা না দিয়ে খটমট ইংরেজি নাম দিয়ে বললে আমরা তাঁকে বেশি সম্মান দিই। আমাদের মনে হয় ‘তাঁকে ষোলো টাকা ফি দেওয়া ষোলো-আনা সার্থক হল।’
সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখাতেই ডাক্তার বিষয়ে লিখেছেন বিশ্বকবি, কবিতাতেও তার কমতি ছিল না। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত ‘খাপছাড়া’ কাব্যে পাড়ায় আসা নাক উঁচু-নাড়ি টেপা ডাক্তার, কাশিকে ইনফ্লুয়েঞ্জা বলে চালানো ডাক্তারের পাশাপাশি ডাক্তার ময়জন এবং গ্রেগসনেরও দেখা মেলে।
রবিকে ছেড়ে আসি শরৎচন্দ্রমার আলোয়। বাজেয়াপ্ত হওয়া ‘পথের দাবী’ উপন্যাসের ‘পিনাল কোডের কোহিনূর’,‘রাজবিদ্রোহী’ সব্যসাচীকে বিপ্লবী দলের সকলে ডাক্তার বলতেন। জার্মানি থেকে ডাক্তারি পাশ করেছিলেন তিনি।
শরৎচন্দ্র ছেড়ে আসি রাজচন্দ্রের কথায়। পরশুরাম রাজশেখর বসুর একশো বছর আগে প্রকাশিত ‘গড্ডালিকা’ গল্পগ্রন্থের ‘চিকিৎসা-সঙ্কট’ গল্পের গত বছর শতবর্ষ পূর্তি হল। সেখানে যেন রকমারি ডাক্তারের মেলা বসেছে। ইউনানি চিকিৎসক হাকিম সাহেব, তামাকখেকো কবিরাজ তারিণী সেন, বত্রিশ টাকা ভিজিটের গড়গড়াটানা হোমিওপ্যাথ নেপালচন্দ্র রায়, গ্রে স্ট্রিটের বাড়িগাড়ি হাঁকানো অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার তফাদার সকলেই সেখানে রয়েছেন।
সামান্য আছাড় খেয়ে উদ্বিগ্ন নন্দদুলাল মিত্র রোগ নিরাময়ের জন্য এঁদের সকলের কাছে গিয়ে নিরাশ হয়েছিলেন। অবশেষে বউবাজারের লেডি ডাক্তার মিস বিপুলা মল্লিককে মিসেস বিপুলা মিত্র বানিয়ে রোগমুক্ত হন। বিবাহের পরে মিসেস মিত্রের একমাত্র রোগী হয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থেকে যান। ‘নিকশিত হেম’ (১৯৫৩) গল্পে বোম্বাইয়ের ডাক্তার কির্লোস্কারকে ট্রান্সজেন্ডার হওয়া নিরঞ্জনার চিকিৎসা করতে দেখা যায়।
অ্যালোপ্যাথি পড়ে তৎকালে সর্বপ্রধান হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হওয়া এবং ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের প্রতিষ্ঠাতা স্বনামধন্য মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রসঙ্গ রয়েছে তাঁর ‘গগন-চটি’ (১৯৫৭) গল্পে। স্পিচ থেরাপিস্ট ডাক্তার অনিল মিত্রের দেখা মেলে ‘দীনেশের ভাগ্য’(১৯৫৮) গল্পে।
রসায়নবিদ হয়েও তাঁর সাহিত্যে নানাবিধ ডাক্তারদের চাঁদের হাট বসিয়েছিলেন পরশুরাম। বিখ্যাত প্রবন্ধগ্রন্থ ‘লঘুগুরু’-র দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘ডাক্তারি ও কবিরাজি’-র প্রথম লাইনেই তাই তিনি যা লিখেছিলেন, তা অহমিকা নয়, যথার্থতার প্রমাণবাহক—‘আমি চিকিৎসক নহি, তথাপি আমার তুল্য অব্যবসায়ীর চিকিৎসা সম্বন্ধে আলোচনা করিবার অধিকার আছে।’ একশো বছর আগের এই লেখাটিতে পরশুরাম আয়ুর্বেদ, ন্যাচারোপ্যাথি, ফার্মাসি ইত্যাদি বিষয়ের প্রসারের দাবি তুলেছিলেন যা আজ অনেকাংশে রূপায়িত হচ্ছে।
চন্দ্রকিরণে রঞ্জিত কুমুদরঞ্জন মল্লিকের ‘বনতুলসী’ কাব্য ১৩১৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। এর মাত্র আট লাইনের একটি কবিতায় এক কবিরাজ মশাইয়ের বেদনাকে মর্মস্পর্শী ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন কবি। ‘ধন্বন্তরি-কল্প’ সেই কবিরাজ বুঝেছেন যে জগদীশ্বরের কাছে তিনি কিছুই করতে পারেন না, শুধু ‘নিমিত্তের ভাগী’ হয়ে থাকেন। গল্পকার জগদীশ গুপ্তের ‘পয়োমুখম্’গল্পে আমরা পাই বিষকুম্ভসম কবিরাজ কৃষ্ণকান্ত সেনশর্মাকে। ওষুধ না দিয়ে, ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ওষুধ বা বিষ দিয়ে পুত্রবধূদের মেরে ফেলা তার শখ ছিল।
আয়ুর্বেদ শিখতে গিয়ে ব্যাকরণ জানার উপযোগিতা বুঝতে না পারা তার মূর্খ পুত্র ভূতনাথ কিন্তু তার মতো অমানুষ ছিল না। তার বারবার বিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে মোটা টাকা আদায় যে পিতার শৌখিন ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, তা বুঝতে পেরেছিলেন। তৃতীয় স্ত্রীর অসুস্থতার সময় তাই বাবার দেওয়া ওষুধ খেতে না দিয়ে স্ত্রীকে বাঁচান তিনি।
আর যাঁর কথা না বললে বাংলা সাহিত্যে চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তিনি হলেন বিভূতিভূষণ। (চলবে)