মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
ক্রমশ হাতদুটো আপনার নাকের ওপর চাদর ঢাকা দিয়ে দিল। তারপরেই টের পেলেন গলায় দশটা আঙুলের চাপ বসতে শুরু করেছে। দমবন্ধ অবস্থাতেই বুঝতে পারলেন, বুকের ওপর কে যেন চেপে বসে আছে। বাঁচতে হবে! যে করেই হোক বাঁচতে হবে। নইলে কীভাবে মারা গেলেন সেটাও কেউ জানতে পারবে না! শরীরের শেষ শক্তিটুকু জড়ো করে আপনি চিৎকার করে উঠে বসতে চাইলেন!
ব্যস! ঘুম ভেঙে গেল। কী আশ্চর্য! কোথায় অশরীরী! সবকিছুই তো স্বাভাবিক! কোথাও কিছু নেই। এই তো আপনার চেনা ঘর, চেনা দেওয়াল! চেনা ফ্যান ঝুলছে শিলিং থেকে!
তবে কি আপনি কি স্বপ্ন দেখছিলেন! তা কী করে হবে? স্বপ্ন কি সত্যিই এতো জ্যান্ত হয়? আপনি তো কয়েক মুহূর্ত আগেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন কেউ একজন আপনাকে শ্বাসরোধ করে মারতে চাইছিল! হাত পা অসাড় হয়ে গিয়েছিল! তাহলে? কেমন করে ঘটল এমন ঘটনা? ঠিক কী হয়েছিল আপনার সঙ্গে?
এতক্ষণ ধরে যে পরিস্থিতির কথা বলা হল, তা নিশ্চয় খুব চেনা চেনা লাগছে? গত কয়েক শতাব্দী জুড়েই মানুষের এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে নানা দেশে রয়েছে নানা মতবাদ। চীন, পূর্ব আফ্রিকা, মেক্সিকো, নিউফাউন্ডল্যান্ড এমনকী আমেরিকার বাসিন্দারাও ভাবেন শয়তানের অনুচরেরা সত্যিসত্যিই নেমে আসে পৃথিবীতে। তারাই শ্বাসরোধ করে আত্মাকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। এমনকী শারীরিকভাবেও ঘনিষ্ঠ হতে চায়! মাঝেমধ্যে আত্মীয় পরিজন, চেনা বন্ধুর রূপ ধরে আসে তারা! ভারতেও এমন ভূত নেমে আশার তত্ত্বে কেউ কেউ এখনও বিশ্বাস করেন।
কিন্তু ঘুম নিয়ে গবেষণাকারীরা বলছেন, এই ভয়াবহ অনুভূতি, সঙ্গে হাত পা অসাড় হয়ে যাওয়া আসলে ‘স্লিপ প্যারালিসিস’-এর লক্ষণ। ঘুমের মধ্যে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার মতো অভিজ্ঞতা হওয়ার পিছনে দায়ী থাকতে পারে ঘুমের নানা পর্যায় এবং মনের অসুখ। এছাড়া আরও কিছু কারণ রয়েছে।
তার আগে জেনে নিই কী এই স্লিপ প্যারালিসিস?
স্লিপ প্যারালিসিস হল একইসঙ্গে জড়ভরত ও জাগ্রত থাকার অনুভূতি। আসলে ঘুমের বিভিন্ন পর্যায় থাকে। দেখা গিয়েছে দুটি পরিস্থিতিতে স্লিপ প্যারালিসিস-এর অনুভূতি হয়—
১) জাগ্রত অবস্থা থেকে ঘুমন্ত অবস্থায় যাওয়ার সময়। চিকিৎসা পরিভাষায় এই অবস্থাকে বলে হিপনোগজিক বা প্রিডরমাইটাল স্লিপ প্যারালিসিস। ২) ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগ্রত অবস্থায় ফেরার সময় যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে হিপনোপমপিক বা পোস্টডর্মাইটাল স্লিপ প্যারালিসিস।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার মতো অনুভূতি স্থায়ী হতে পারে কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট অবদি! কারও কারও স্লিপ প্যারালিসিস-এর সঙ্গে নার্কোলেপ্সি মতো সমস্যাও থাকতে পারে। প্রশ্ন হল নার্কোলেপ্সি কী? আমাদের ঘুম নিয়ন্ত্রিত হয় ব্রেনের মাধ্যমে। ব্রেনের যখন ঘুম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়, তখন হয় নার্কোলেপ্সি। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তি যে কোনও সময় যে কোনও জায়গায় হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়তে পারেন।
হিপনোগজিক স্লিপ প্যারালিসিস
ঘুম আসতে শুরু করলেই আপনার জাগ্রত অবস্থা লোপ পেতে থাকে। আপনার শরীর ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে পড়ে। এই কারণেই আলাদা করে হাত পায়ের শিথিল অবস্থায় চলে যাওয়ার বিষয়টি আপনার নজরে পড়ে না।
হিপনোপমপিক স্লিপ প্যারালিসিস
ঘুমে দুটি অবস্থা থাকে। ক) র্যা পিড আই মুভমেন্ট (আরইএম) ও খ) নন র্যাপপিড আই মুভমেন্ট (এনইআরএম)। ঘুমের বিভিন্ন সময়ে আমরা এই দুই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাই। এনইআরএম চক্র প্রথমে আসে ও মোট ঘুমের ৭৫ শতাংশ দখল করে থাকে। এনইআরএম স্লিপ-এর সময় আমাদের শরীর সম্পূর্ণভাবে বিশ্রাম অবস্থায় চলে যায়। এই সময়ে শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোষ কলায় মেরামতি চলে। এনইআরএম চক্রের শেষের দিকে ঘুম চলে যায় আরইএম পর্যায়ে। এই সময় চোখ দ্রুত নড়াচড়া করে। এই সময়েই মানুষ স্বপ্ন দেখে। তবে বাকি শরীর শিথিল অবস্থাতেই রয়ে যায়। এককথায় মোবাইলের মতো শরীরের সমস্ত পেশি ‘টার্নড অফ’ হয়ে যায়।
মজার ব্যাপার হল আরইএম পর্যায় শেষ হওয়ার আগেই কেউ জেগে গেলেই হয় চিত্তির। সে দেখে শরীরের সমস্ত অঙ্গ অবশ হয়ে গেছে। এমনকী গলা দিয়ে টুঁ শব্দটিও বেরচ্ছে না!
কাদের স্লিপ প্যারালিসিস হয়?
প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জনের স্লিপ প্যারালিসিস হতে পারে। সাধারণত বয়ঃসন্ধিকালেই এই অবস্থার অভিজ্ঞতা প্রথম হয়। জানলে অবাক হবেন, একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্লিপ প্যারালিসিস হওয়ার ইতিহাস পাওয়া যায়!
যে কারণে স্লিপ প্যারালিসিস হতে পারে
পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব।
ঘুমের অভ্যেসের পরিবর্তন বা যে সময়ে ঘুমানোর অভ্যেস, সেই সময়ের পরিবর্তন হলে।
প্রচণ্ড মানসিক চাপ পোয়াতে হলে।
বাইপোলার ডিজঅর্ডারের রোগী হলে।
চিত হয়ে শুয়ে ঘুমোলে।
নার্কোলেপ্সি থাকলে।
রাতে ঘুমনোর সময় পায়ে টান ধরার সমস্যা থাকলে।
অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভ ডিজঅর্ডার-(এডিএইচডি) এর ওষুধ খেলেও কারও কারও এমন সমস্যা হতে পারে।
ড্রাগ, অ্যালকোহল নেওয়ার অভ্যেস থাকলে।
স্লিপ প্যারালিসিস নির্ণয়ক পরীক্ষা
ঘুমিয়ে পড়ার সময় বা ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময় বারবার নিজের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে অবশ হতে দেখলে তা নিশ্চিতভাবে স্লিপ প্যারালিসিস। সাধারণত প্যারালিসিস-এর আলাদা করে কোনও চিকিৎসা করার দরকার পড়ে না। তবে স্লিপ প্যারালিসিস-এর লক্ষণগুলির জন্য খুব বেশি দুশ্চিন্তা হলে, একই কারণে সারাদিনভর ক্লান্তি অনুভব করলে ও রাতে ঘুমোতে না পারলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
চিকিৎসা
৬ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন।
চিকিৎসক অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ দিতে পারেন।
মানসিক সমস্যা থেকেও স্লিপ প্যারালিসিস হতে পারে। তাই কোনও মনের অসুখ থাকলে তার চিকিৎসা আগে করতে হবে।
নার্কোলেপ্সি বা পায়ে টান ধরার সমস্যা থাকলে তার চিকিৎসা করাতে হবে।
ঘরোয়া চিকিৎসা
ঘুমের মধ্যে যে ভূত বা দৈত্যি-দানো আসছে সে ঘুমেই মিলিয়ে যাবে! তাই ভয় পাবেন না। ঠিক সময়ে ঘুমনোর চেষ্টা করুন। মনের মধ্যে দুশ্চিন্তা পুষে ঘুমোতে যাবেন না। স্ট্রেস এড়াবার চেষ্টা করুন। স্ট্রেস কমাতে ধ্যান করতে পারেন। পাশ ফিরে ঘুমোনের চেষ্টা করুন। তবে ঘন ঘন স্লিপ প্যারালিসিস-এর শিকার হলে অতি অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।