মুক্তির উল্লাসে কয়েকদিন মেতে উঠেছিল ওরা। সম্প্রতি বিডন স্ট্রিট শুভম আয়োজিত ১৯তম শুভম নাট্যমেলায়। করোনাকালে সবচেয়ে কষ্টে আছে মনে হয় ওরাই। স্কুল বন্ধ, পার্ক বন্ধ, মাঠ বন্ধ, সাঁতার, সাইকেল, ফুটবল, ক্রিকেট, হুটোপাটি, দাপাদাপি, খুনসুটি, বেয়াদপি... সব বন্ধ। শুধু অনলাইন ক্লাস আর অপলক নজরদারির ঘেরাটোপে হাঁসফাঁস করছিল ওদের সরল শৈশব, কৈশোরের বেলা অবেলাগুলো। কোভিড বিধি সামান্য শিথিল হতেই তাই ওরা হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ল কারওর বাড়ির ছাদে, দুদ্দাড়িয়ে নেমে পড়ল বৃষ্টি ভেজা উঠোনে। হৃদয়ের হার্ডডিস্কে সেভ করে রাখা কষ্টে শেখা নাটকের সংলাপগুলো চিৎকৃত উল্লাসে আউড়াল ওরা। ঝালিয়ে নিল যে যার ভূমিকা। কারণ, ওদের কানেও বার্তা ‘রটি গেছে ক্রমে’, মঞ্চ খুলেছে। সেই মায়া কাননে বসবে আবার নাট্যমেলা। ওদের হট্টমেলা। ওরা আবার নাচবে, গাইবে, হাসবে, হাসাবে। অভিনয় করবে। সেজে উঠেছিল গিরিশ মঞ্চ, মিনার্ভা থিয়েটার, বাংলা অ্যাকাডেমি। তিনদিনের নাট্যমেলার অনাড়ম্বর উদ্বোধনী সন্ধ্যার অতিথি সোহিনী সেনগুপ্ত বললেন, ‘মঞ্চটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠেছে।’ নাট্যমেলার প্রথম সন্ধ্যার প্রথম নাটক ‘নট ফর সেল’। কৌশিক চট্টোপাধ্যায় লিখিত ও শুভদীপ ধাড়া পরিচালিত নাটকটি প্রথমেই একটি প্রশ্ন তুলে দিয়ে যায়, ‘আচ্ছা পুতুলরা কি কেবল আমাদের ছোটবেলারই সঙ্গী? যারা সেই প্রথম থেকে আমাদের আনন্দ দেওয়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ বড় হয়ে গেলে কেন তাদের কথা মুছে যায় আমাদের মন থেকে?’ পুতুলেরও আশা আছে, আনন্দ-ভালোবাসা আছে। ভাষা আছে। অপূর্ব মঞ্চ উপস্থাপনায়, চমৎকার কোরিওগ্রাফিতে, আলো-আবহের নান্দনিকতায় সেই কথাটাই বলে গেল একঝাঁক পুতুলের মতো শিশু-কিশোর অনবদ্য অভিনয়শৈলী দিয়ে। পরের নাটক ‘ক্যাপচার’ মঞ্চস্থ করল তুলনায় বয়সে বড়রা। মুহূর্তের অসাবধানতা যে কত বড় বিড়ম্বনা ডেকে আনতে পারে, গুঁড়িয়ে দিতে পারে ভবিষ্যৎ—সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল বিডন স্ট্রিট শুভম রেপার্টারি প্রযোজিত মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের অণু-নাটক ‘কালো ব্যাগ’ অবলম্বনে তৈরি নাটকটি। নির্দেশক অস্মিতা খাঁ। প্রথম সন্ধ্যার শেষ নাটক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘ভীমবধ’-এ আবার মঞ্চ মাতাল শিশু-কিশোররা।
দ্বিতীয় দিনের শুরুতে মিনার্ভা থিয়েটারে মঞ্চস্থ হল সুনির্মল বসুর কবিতা অবলম্বনে লেখা নাটক ‘সামিয়ানা’। নির্দেশক অনমিত্র খাঁ। গুজব যে কত সর্বগ্রাসী এই একাঙ্কটি তার প্রমাণ। মোহনপুরার ভগ্নপ্রায় জমিদার বাড়িতে কেন আবার শামিয়ানা টাঙানো হচ্ছে, সেই নিয়ে অজপাড়া গ্রামের বাসিন্দাদের নানা জনের নানা মত। এই নাটকের অন্যতম আকর্ষণ, দলের প্রাণপুরুষ আশিস খাঁ অভিভাবকদেরও শামিল করে দিয়েছিলেন তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে। এদিন নাট্যমেলার শেষ নিবেদন ছিল তুষার দে লিখিত ও শ্যামল সরকার নির্দেশিত নাটক ‘অথ শিক্ষা বিচিত্রা’। অবৈজ্ঞানিক ও অপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার পরম্পরা কীভাবে সমাজ ও সভ্যতাকে শাসন করে চলেছে, তার অনবদ্য নাট্যপ্রয়োগ।
শেষ সন্ধ্যায় বাংলা অ্যাকাডেমির সভাঘরে আলোচিত হল ‘শৈশব সময় সঙ্কট’। কারোনা পরিস্থিতির জেরে দীর্ঘ বন্দিদশায় শিশুমনে কী প্রভাব পড়েছে বা পড়তে পারে তাই নিয়ে বললেন বিশিষ্ট মনোবিদ মোহিত রণদীপ ও নাট্য ব্যক্তিত্ব তীর্থঙ্কর চন্দ।
—প্রিয়ব্রত দত্ত