পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
ঠিক উল্টোদিকের রাস্তা হল আসল পুরনো দিল্লির স্পর্শ পাওয়ার দরজা। জাহান আরার ছোট বোন রোশন আরার ছিল একটু প্রেমিক খোঁজার অভ্যাস। তিনি যেন বিশ্বপ্রেমিক। এই রাস্তায় ছিল তাঁর একাধিক পরিচারিকা আর এক সহেলির বাড়ি। আসতেন সেখানে রোশন আরা। আরও অগ্রসর হলে একের পর এক গলি। কোনওটা বিখ্যাত পরোটাওয়ালা গলি। কোনওটা জিলাপিওয়ালা। কোথাও আতরওয়ালা। মুঘল মুঘল মুঘল। চাঁদনী চক, পুরনো দিল্লি জুড়ে শুধুই কি মুঘলদের নানারকম স্পর্শ আর কাহিনি ছড়িয়ে আছে?
এখানেই একটি আশ্চর্য ব্যতিক্রম! সুনহেরি মসজিদের কথা আমরা আগেই জেনেছি এই গুপ্ত রাজধানীর কিস্সায়। সেই যে মসজিদের অলিন্দের উপর বসে নাদির শাহ চাক্ষুষ করেছিল দিল্লির গণহত্যা, সেই মসজিদের ঠিক পাশের এই গুরুদ্বারের এত মাহাত্ম্য কীসের? এটাই আজকের গল্প। এই হল চাঁদনী চকের সিস গঞ্জ গুরুদ্বার। অবিরত ভক্তদের আনাগোনা। দেশবিদেশ থেকে। এই গুরুদ্বার এখানে কেন? পুরনো দিল্লির চাঁদনী চকে তো মুঘল ইতিহাসের রমরমা। এখানে আচমকা মুঘলদের অসংখ্য স্মৃতিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গুরুদ্বার থাকার কারণ কী?
শিখ ধর্মের নবম গুরু তেগ বাহাদুর বাংলায় গিয়েছেন। ধর্মপ্রচার আর অনুগামীদের আমন্ত্রণে। ১৬৭৫ সাল। হঠাৎ তাঁর কাছে সংবাদ এল দিল্লি, আগ্রার মতো এলাকায় হিন্দুদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছে। গুরু তেগ বাহাদুর জানতে পারলেন, শয়ে শয়ে হিন্দু ব্রাহ্মণ, যাদের অনেকেই কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ তাদের জেলবন্দি করেছেন সম্রাট আওরঙ্গজেব। কারণ কী? জিজিয়া কর চালু করার প্রতিবাদ করেছে তারা। এই অপরাধ।
পণ্ডিত কৃপারাম এসেছেন গুরু তেগ বাহাদুরের কাছে। বললেন, গুরু মহারাজ আপনার অসীম শক্তি। আওরঙ্গজেবের বাহিনীর এই অত্যাচার থেকে আপনিই রক্ষা করতে পারেন আমাদের। গুরু তেগ বাহাদুরের প্রভাব যে অবিরত বেড়ে চলেছে এবং তাঁর অনুগামী ও ভক্তের সংখ্যা ক্রমেই চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে জায়গিরদার, সামন্ত, সুবেদারদের কাছে। অতএব তাঁর এই ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠা কানে এসেছে আওরঙ্গজেবের।
কিন্তু হিন্দু ভাইদের এই আকুল প্রার্থনায় গুরু তেগ বাহাদুর চুপ করে থাকতে পারেন না। তিনি আনন্দপুর থেকে রওনা হলেন আগ্রা। আর এই সংবাদ পেয়েই আওরঙ্গজেবের নির্দেশ, ‘গ্রেপ্তার কর ওকে!’ তেগ বাহাদুরকে পাকড়াও করে দিল্লিতে আনা হল। এরকম নিরীহ দর্শন মানুষ আবার এত শক্তিশালী ধর্মপ্রচারক? তাঁর এত শয়ে শয়ে ভক্ত ও অনুগামী? হাসি পাচ্ছে আওরঙ্গজেবের। তিনি বললেন, তোমার নাকি অলৌকিক শক্তি? কই দেখাও তো? গুরু তেগ বাহাদুর রাজি হলেন না। তাঁর এই অকুতোভয় আচরণকে মুঘল সম্রাট মনে করলেন বেয়াদপি। গুরু তেগ বাহাদুর একটি গাছের পাতায় নখ দিয়ে কিছু লিখে গলায় বাঁধলেন। বললেন, এই পাতা যতক্ষণ আমার সঙ্গে আছে, ততক্ষণ আমার গলা কেটে ফেললেও আমাকে নত করা যাবে না। আওরঙ্গজেবের এই বেয়াদপি সহ্য হল না। তিনি বললেন, তাহলে গলাটাই বরং কেটে ফেলা যাক। হত্যার নির্দেশ দিলেন। আবার বললেন, বাঁচতে চাইলে তোমার গোপন অলৌকিক শক্তি দেখাও। গুরু তেগ বাহাদুর নীরব হয়ে হাসছেন। তাঁকে জনতার মাঝখানে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে বললেন আওরঙ্গজেব। জনতাকে সাক্ষী রেখে এরপর তাঁর শিরোশ্ছেদ করা হল। একদিকে মস্তক লুটিয়ে পড়ল। অন্যদিকে পবিত্র দেহ। রক্তাক্ত কাণ্ড। সেই পাতায় লেখা ছিল, আমি তোমাকে মস্তক দিলাম, গোপন শক্তিটা কিন্তু দেখালাম না! হঠাৎ সেই রাতে দিল্লিতে উঠল ঝড়। সম্রাটের নির্দেশ ছিল কেউ যেন গুরু তেগ বাহাদুরের শরীর আর মস্তক সরাতে না আসে। তাহলে তাদেরও হত্যা করা হবে। ১৬৭৫ সালের ১১ নভেম্বর।
কিন্তু আচমকা ঝড়ে দিশাহারা হয়ে গেল মুঘল প্রহরীরা। চারদিক অন্ধকার। কালি আঁধি! ধুলো আর ঝড়ের মধ্যে গুরুর দুই শিষ্য আচমকা এগিয়ে এল অকুস্থলে। জাইতা ভাই নিয়ে গেল মস্তক। সোজা আনন্দপুরের দিকে। আর লাকি শাহ ভাই বানজারা গুরুর মস্তকহীন দেহ নিয়ে ছুটল নিজের গ্রামের দিকে। সে কী করল এরপর? নিজের বাড়িতেই আগুন লাগিয়ে দিল! আর সেই আগুনে শেষকৃত্য সম্পন্ন হল গুরু তেগ বাহাদুরের!
নতুন দিল্লির পার্লামেন্ট ভবনের পিছনে থাকা গুরুদ্বার রেকাবগঞ্জ। এখানেই বাড়িতে আগুন ধরিয়ে সৎকার করা হয়েছিল গুরু তেগ বাহাদুরকে। আজও যাঁর মাহাত্ম্য অম্লান। আর চাঁদনী চকের ওই যে অনবদ্য গুরুদ্বারটি দাঁড়িয়ে রয়েছে একঝাঁক মুঘল স্থাপত্যের হর্ম্যের মধ্যে একক এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে, সেটিই হল সিস গঞ্জ গুরুদ্বার। ঠিক এখানেই হত্যা করা হয়েছিল গুরু তেগ বাহাদুরকে! এখন সন্ধ্যা। চাঁদনী চকের রহস্যময় বাতাসে ভাসছে পবিত্র গ্রন্থসাহিব পাঠের অনুরণন!