পেশা ও ব্যবসায় অর্থাগমের যোগটি অনুকূল। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে পারে। ... বিশদ
সবাই ডাকছে। দেরি হয়ে যাচ্ছে। শেহজাদী জাহান আরাকে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচারিকারা আকুল হয়ে বলছেন। জাহান আরা শেষ মুহূর্তের সাজগোজ সম্পন্ন করছেন। যেতে হবে প্রাসাদের কেন্দ্রস্থলে। সেখানে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠান। বড় পুত্র দারা শিকাহের প্রতি সম্রাট দুর্বল হলেও মাঝেমধ্যে অবশ্য মনে হয় যেন বেশি কাছের জাহান আরা। কারণ তিনি কিছু দাবি করলে আজ পর্যন্ত শাহজাহান অগ্রাহ্য করেননি। তাঁর স্নেহ এতটাই যে এই জ্যেষ্ঠ কন্যাটিকে তিনি কিছুতেই মন খারাপ হতে দিতে চান না। যা নিয়ে ছোট কন্যা রোশনারার হয়ত সামান্য ঈর্ষা রয়েছে।
জাহান আরা এবার অলিন্দ ধরে হাঁটছেন। সন্ধ্যা হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। বাতিদানগুলিতে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রদীপ শিখা। শেহজাদী একা নয়। তাঁর সঙ্গে পিছনে রয়েছে একঝাঁক পরিচারিকা এবং এক সর্বক্ষণের প্রহরায় থাকা এক বৃহন্নলা খিদমদগার। তার হাতে একটি লাঠি। মূল্যবান পাথর লাগানো। আর সোনার জলের মোড়ক। একেবারে নীচে ছোট ছোট কয়েকটি ঘন্টা। জাহান আরা একটি করে পা ফেলছেন, আর পিছনে থাকা খিদমতগার সেই লাঠি মেঝেতে জোরে ঠুকে চিৎকার করছে, হোশিয়ার…খবরদার…। যাতে প্রত্যেকেই অবগত হয় যে সম্রাটের প্রিয়পাত্রী এবং মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম ক্ষমতাশালী নারী উপস্থিত হচ্ছেন।
জাহান আরার পরনে মসলিনের পোশাক। এতটাই স্বচ্ছ যে, এই মসলিনের জামা একটি নয়, একের পর এক স্তরে পরতে হয়। প্রতিটি পোশাকের একটি করে নিজস্ব নাম। ওই নামের একই পোশাক আর পাওয়া যাবে না। তৈরি হয় না। কোনওটির নাম আব ই রাওয়ান। কোনও পোশাককে বলা হয়েছে শবনম। আবার কোনও নাম বাফত হাওয়া।
মূল্যবান আতরের সুবাসে ভাসছে জাহান আরার যাত্রাপথ। হঠাৎ তাঁর সামান্য ভারসাম্য যেন নড়ে গেল। আর তৎক্ষণাৎ পাশেই থাকা বাতিদানে ঢুকে গেল তাঁর বহুমূল্য মসলিনের একাংশ। সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপশিখার আগুন নিমেষের মধ্যে গোটা শরীরকে ঘিরে ধরল। কারণ মসলিন এবং আতর, দুইই দ্রুত দাহ্য।
দুই পরিচারিকা জাপটে ধরল জাহান আরাকে। কিন্তু তাদের শরীরেও ধরে গেল আগুন। ছিটকে পড়ল তারা। আগুনের ভয়াবহতা এমনই যে, তাদের পরে মৃত্যু হয়। আর জাহান আরার গোটা শরীর অগ্নিদগ্ধ। অচেতন হয়ে গেলেন।
সুফী সন্ত, হাকিম, কবিরাজ, ইরানি চিকিৎসক…কেউ বাকি রইল না। শাহজাহান দরবারে বসা বন্ধ করে দিলেন। তাঁর উন্মাদপ্রায় দশা। জাহান আরাকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। শুধু চিকিৎসা নয়। মানুষের দোয়া চাই। গরিব, ভিখারি, ফকির, সাধু সন্তদের দিতে হবে দান। প্রিয় কন্যার জন্য সম্রাট শাহজাহান কী ব্যবস্থা করলেন? শয্যাশায়ী জাহান আবার বালিশের নীচে রাখা হল নগদ ৫ লক্ষ টাকা। কত? হ্যাঁ, ১৬৪৪ সালে ৫ লক্ষ টাকা! কেন? কারণ, প্রতিদিন এক হাজার টাকা করে দান করবেন তিনি। সর্বত্র খবর গেল। আগ্রা, শাহজানাবাদ (দিল্লি), অওধ থেকে মানুষ ছুটে আসছে এই দান পেতে।
অবশেষে আট মাস পর সম্পূর্ণ সুস্থ হলেন মোগল শেহজাদী জাহান আরা। পুরুষতান্ত্রিক মোগল দরবারেও ভাইয়েদের উচ্চকিত উপস্থিতি সত্ত্বেও আগে থেকেই জাহান আরা ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী। এবার সুস্থ হওয়ার পর সম্রাটের আরও স্নেহ ও আশীর্বাদ বর্ষিত হল তাঁর উপর।
সম্রাট শাহজাহান প্রথম উপহার দিলেন ওজন উৎসব। অর্থাৎ জাহান আরাকে বসানো হল একটি পাল্লায়। অন্য পাল্লায় সোনা। তাঁর ওজনের সমতুল সোনা তাঁকে উপহার দেওয়া হল। এ পর্যন্ত এই উপহার পেয়েছে পুরুষেরা। এরপরের উপহার সুরাত বন্দর। সুরাত বন্দরের বাণিজ্য, সুরাত নগরীর শান ক্ষমতা, বন্দর ও নগরীর থেকে আয় হওয়া রাজস্ব সব জাহান আরা ভোগ করবেন। একটি নতুন জাহাজ দেওয়া হল তাঁকে। জাহাজের নাম সাহিবি। বিদেশি বণিক সুরাত বন্দরে যে বাণিজ্যই করবেন তার ফরমান নিতে হবে জাহান আরার থেকে।
এই গোটা পর্বে একটি মানুষ নিজেকে ক্রমেই উপেক্ষিত ভাবছিলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন সম্রাটের তাঁর প্রতি কোনও স্নেহ অথবা কর্তব্য অবশিষ্ট নেই। সব স্নেহ দখল করে নিয়েছেন বড় পুত্র দারা শিকোহ। তাই এই মানুষটি যাঁর নাম আওরঙ্গজেব, বারংবার ভাবছেন এবার সব ছেড়ে চলে যাবেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে। তবে সেসব তাঁর নিছক কৌশল না তো? প্রকৃতপক্ষে তিনি গোপনে সুযোগই কি খুঁজছিলেন না যে, কীভাবে দারা শিকোকে পরাস্ত করা যায়?
যখনই আওরঙ্গজেব হতাশ বা ক্রুদ্ধ হয়েছেন, চিঠি লিখেছেন একমাত্র জাহান আরাকে। এই একজন নারীকে আওরঙ্গজেব চিরকাল গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। অথচ তিনি জানতেন তাঁর এবং দারা শিকোহের সিংহাসন দখলের লড়াইয়ে বরাবর জাহান আরা দারা শিকোহের প্রতিই পক্ষপাত করেছেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব চিঠি লেখা বন্ধ করেননি কখনও জাহান আরাকে। এমনকী নিজে যখন সিংহাসনে বসেছেন সব বাধা কাটিয়ে, দারাকে হত্যা করে, তারপরও কিন্তু শাহজাহানের আমলে অসীম ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের অধিকারী জাহান আরার প্রতি প্রকাশ্যে অসম্মান প্রদর্শন করেননি আওরঙ্গজেব। বার্ষিক কতটা টাকা বরাদ্দ করেছিলেন তিনি জাহান আরার জন্য? ১৭ লক্ষ টাকা!
১৬৮১ সালে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জাহান আরা শাহজানাবাদে থেকে গিয়েছেন। বিপুল ধনসম্পত্তির অধিকারিণী জাহান আরা নিজের সমাধির নকশা এবং কাঠামোর অবয়ব নিজেই নির্মাণ করে গিয়েছিলেন আগেই। লিখে গিয়েছিলেন নিজের সমাধিলিপিও। অঢেল টাকা ব্যয় করা সমাধি নয়। সামান্য সাধারণ মানুষের মতো সমাধিস্থল হয়েছে নিজের পূর্বনির্ধারিত স্থানে। ধর্মপ্রাণ জাহান আরা দিল্লির পবিত্র নিজাম উদ্দিন আউলিয়া দরগার অভ্যন্তরে সকলের চোখের আড়ালে একান্ত নির্জনে আজও শুয়ে আছেন সমাধিতে।
যেখানে লেখা-‘আমার সমাধির উপরে যেন থাকে না কোনও আচ্ছাদন। সবুজ ঘাসের জন্ম হোক….’