উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
বাঙালির চলচ্চিত্র উদ্যোগের অন্যতম পুরোধা ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় বা ডি জি। বাংলা ছবির আদিলগ্নেই ডি জি উপলব্ধি করেছিলেন যে, শুধুমাত্র বিদেশি মেয়েদের দিয়ে অভিনয় করিয়ে বাংলা সিনেমা কখনও পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে পারবে না। তিনি চেয়েছিলেন, চলচ্চিত্রের অভিনয়ে বাংলার মেয়েরাও ধীরে ধীরে আসুক। সেইসময় সামাজিক নিষেধকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে এই মনোভাব পোষণ করা বেশ কঠিন ছিল। এইজন্য তাঁকে অনেক অপবাদও সইতে হয়েছে। তবুও দমে যাননি ডি জি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্যে শান্তিনিকেতনে কাটানো আধুনিক মনের মানুষটি অভিনেত্রী সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলকাতার সোনাগাছির গণিকাপল্লিও ঘুরতে বাদ রাখেননি। অবশেষে স্ত্রী রমলা ও কন্যা মণিকাকে সামাজিক বিধি-নিষেধের বেড়া অগ্রাহ্য করে সিনেমায় নিয়ে এসেছিলেন। চারের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের আদিপর্বে সিনেমায় মলিনা দেবীর আত্মপ্রকাশের পিছনেও তাই পরোক্ষে ডি জির অবদান রয়েছে।
বাঙালি অথচ ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ ছবি দেখেননি, আধুনিক প্রজন্মের হাতেগোনা কয়েকজন বাদ দিলে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর যাঁরা এই ছবিটি দেখেছেন, তাঁদের আর মলিনা দেবীকে আলাদা করে চিনিয়ে দেওয়ার দরকার পড়ে না। ছায়াছবিতে মেসমালিক তুলসী চক্রবর্তীর স্ত্রীর ভূমিকায় মলিনা দেবীর মুখে ‘কই কোথায় গেলে গো’ সংলাপটি তো বাংলা ছবির ইতিহাসে অন্যতম জনপ্রিয়। মলিনা দেবী ছিলেন হাওড়ার মানুষ। জন্ম ১৯১৬ সালে। প্রথাগত শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। অল্পবয়সেই পড়াশোনায় ছেদ টানতে বাধ্য হয়েছিলেন। অভাবের তাড়নায় মাত্র ৮ বছর বয়সেই রোজগারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে হয়েছিল। শিশুশিল্পী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন মিনার্ভা থিয়েটারে। ওই একরত্তি বয়সে অভিনয় বলতে আসলে নাটকের দলে নাচ। সেইসময় মিনার্ভা থিয়েটারে ‘আত্মদর্শন’, ‘মিশরকুমারী’ প্রভৃতি নাটকের মাঝখানে মাঝখানে একদল সখী নাচতে নাচতে বেরিয়ে যেত। সেই সখীর দলেই নাচতেন মলিনা দেবী।
মিনার্ভা থিয়েটারের নাচের মাস্টারের কাছেই নাচের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন মলিনা। তখন প্রায় সারারাত ধরে থিয়েটার হতো। একেকটি নাটকে নাচের দৃশ্য থাকত বড়জোর মিনিটখানেক। কিন্তু ওইটুক সময় হলে কী হবে, নাচের দৃশ্যের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে হতো শিল্পীদের। দিনের পর দিন রাতজাগা কি ওইটুকু মেয়ের পক্ষে সম্ভব! ঘুমে চোখ জুড়িয়ে আসত ছোট্ট মলিনার। ক্লান্তিতে একেকদিন আর চোখ খুলে রাখতে পারতেন না, ঘুমিয়েই পড়তেন। কখনও সখনও নাচের ড্রেসের বাক্সের ফাঁকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়তেন। নাচের সময় শুরু হতো খোঁজ। তারপর খুঁজে পেলে দলের সদস্যরাই চড়-থাপ্পড় মেরে ঘুম থেকে তুলে দিত। ঘুম চোখ মুছতে মুছতে স্টেজে গিয়ে হাত-পা ঘুরিয়ে নাচতে শুরু করে দিত ছোট্ট মলিনা। পরবর্তীকালে এই নাচের অভিজ্ঞতাটাকেই কাজে লাগিয়ে দারুণভাবে নাচ শিখে নিয়েছিলেন তিনি। মলিনা দেবীর নাচের গুরু ছিলেন ললিত গোঁসাই। ললিতমোহন গোস্বামী। তিনি নাচ শেখাতেন দারুণ। হীরেন বসুর পরিচালনায় নিউ থিয়েটার্সের ‘মহুয়া’ ছবিতে মলিনা দেবীর নাচ ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছিল। হীরেনবাবু নিজে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নাচে-গানেও পারদর্শী ছিলেন। সেই ছবিতে মলিনা দেবীর সঙ্গে অভিনয় করেছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী ও দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘মহুয়া’ ছবিটি একটানা প্রায় মাস তিন-চারেক চলেছিল।
মিনার্ভা থিয়েটার দিয়ে অভিনয় জগতে প্রবেশ করলেও পরবর্তীকালে এই দল ছেড়ে দিয়ে মনমোহন থিয়েটারে নাম লেখান মলিনা। তবে এই দলবদল অবশ্য স্বেচ্ছায় হয়নি। টাকাপয়সা নিয়ে মিনার্ভা থিয়েটারের কর্তাদের সঙ্গে তাঁর পরিবারের কিছু গন্ডগোল হয়েছিল। ফলে মিনার্ভা কর্তৃপক্ষ তাঁকে দল থেকে ছেঁটে ফেলেন। সেখান থেকে মনমোহন থিয়েটারে এসে কমবয়সি ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করতেন। ‘জাহাঙ্গির’ নাটকে বালক দারা সাজতেন তিনি। আর ‘কণ্ঠহার’ নাটকে শ্যামল বলে একটা ছেলের চরিত্র করতেন। তবে বেশিদিন তাঁর পুরুষ সেজে অভিনয় করা হল না। এ প্রসঙ্গে মলিনা দেবী নিজেই অক্ষেপ করতেন, ‘ছেলে আর বেশিদিন সাজা গেল কোথায়! গায়ে-গতরে পুরুষ্ট হয়ে ছেলের রোল থেকে ছাঁটাই হয়ে গেলাম।’ আর শুধু ছেলের চরিত্র নয়, ছাটাই হয়ে গেলেন এই থিয়েটার থেকেও। আসলে মনমোহন থিয়েটারে তখন একগাদা মেয়ে। নতুন কোনও মহিলা চরিত্রে যে ঢুকবেন মলিনা, সেই সুযোগ পেলেন না। তাই আবার ফিরে গেলেন নাচিয়ের রোলে। এবার স্টার থিয়েটার। ততদিনে নাচে পোক্ত হয়ে গিয়েছেন তিনি। স্টারে ‘শকুন্তলা’ আর ‘স্বয়ংবরা’ এই দুটো নাটকে নেচেছিলেন তিনি।
থিয়েটারে অভিনয়ের সুযোগ পেলেও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। থিয়েটার থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার পর প্রতিদিন স্টুডিওপাড়ায় ঘুরতেন সিনেমায় কাজ পাওয়ার আশায়। তবে অত সহজে কি আর কাজ মেলে? অনেক লড়াইয়ের পর ছবিতে অভিনয়ের শিকে ছিঁড়ল ১৯৩০ সালে । রাধা ফিল্মসের নির্বাক ছবি ‘শ্রীকান্ত’-তে একটা ছোট্ট রোলে সুযোগ পেলেন তিনি। পরিচালক ছিলেন তারাকুমার ভাদুড়ি। সেই ছবির নায়ক ছিলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের বছর ১৯৩১ সালে ম্যাডান থিয়েটারের ‘দেবী চৌধুরানি’ মলিনার দ্বিতীয় ছবি। সেই বছরই তিনি অভিনয় করলেন আরও একটি ছবিতে। ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্র্যাফটের ‘চাষার মেয়ে’। একটি ছবিতেও তাঁর ভূমিকা সেরকম বলার মতো কিছু ছিল না। কিন্তু ওই ‘চাষার মেয়ে’-ই মলিনা দেবীকে ছবির মেয়ে করে তুলল। সিনেমাতে থিতু হলেন তিনি।
সিনেমায় অভিনয়ের কাজ খুঁজতে গিয়েই ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রবাদপুরুষ প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়ার সঙ্গে একটা মজাদার কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। বড়ুয়া সাহেবের অবশ্য তখনও চলচ্চিত্রের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়নি। তবে, ছাত্রাবস্থা থেকেই নাটক সম্বন্ধে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। তৎকালীন বাংলা পেশাদার রঙ্গমঞ্চের প্রায় সব নাটকের দর্শকাসনেই প্রমথেশ বড়ুয়া থাকতেন। বড়ুয়া সাহেবকে চলচ্চিত্র সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলেন সেই ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় অর্থাৎ ডি জি।
(ক্রমশ)
অঙ্কন: সুব্রত মাজী