উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
৫
স্বাধীনতার পরে জন্মেছি। মুক্তির আনন্দময়, দেশভাগ ও দাঙ্গার বেদনাময় ওই দিনটি দেখা হয়নি। তবে শৈশবকাল থেকে আপন পরিবারের অভিজ্ঞতায় উদ্বাস্তু জীবনের সংগ্রামময় দিনগুলি চোখের সামনে দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। তবু স্বাধীনতার দিনটি, না, ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট নয়, তখন তো জন্মাইনি, স্বাধীনতার ২৫ বর্ষ তথা রজতজয়ন্তী আর স্বাধীনতার ৫০ বছরের সুবর্ণজয়ন্তীর দিন দু’টি আমার জীবনে কাকতালীয়ভাবে স্মরণীয়।
নিজের সবচেয়ে স্মরণের দিনটি বলতে হলে ওই দু’টি দিনের কথাই বলতে হবে, কারণ দু’টি দিনই কাকতালীয়ভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িত। তা কেবল স্বাধীনতা দিবস বা ওই দু’টি দিনের রৌপ্যোাজ্জ্বল বা স্বর্ণ আভায় জ্বলজ্বলে বলে নয়, আমার জীবনে ওই দু’টি দিন চমকপ্রদ। কাকতালীয় বলেই এমনটি ঘটেছে আমার, যা আদৌ সুখকর নয়।
এক্ষেত্রে যেহেতু স্মরণীয় একটি দিনকেই গুরুত্ব দিতে হবে, আমি ১৯৯৭ সালের ১৫ আগস্টের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী দিনটির কথাই বলব। কিন্তু যেহেতু ১৯৭২-এর স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর দিনটির কথা একটু না বললে সুবর্ণজয়ন্তীর সঙ্গে তার কাকতালীয় মিলটি বোঝা যাবে না, তাই আমি সংক্ষিপ্তাকারে ১৯৭২-এর ১৫ আগস্ট দিয়েই শুরু করব।
আমার সমবয়সি বা আমাদের অগ্রজ যাঁরা, তাঁদের কাছে এই রাজ্যেহর ওই সময়,পরিস্থিতি, ওই ১৯৭০-’৭১-’৭২ সালগুলি নিয়ে বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। রাজনৈতিক ওই অগ্নিগর্ভ সময়ে হানাহানি, সংঘর্ষ, পুলিস-প্রশাসনের দমন পীড়ন, গণহত্যাি, জেলে জেলে বন্দিহত্যাা— এসব ঘটনায় জনজীবন, বিশেষত তরুণপ্রাণ ছিল সন্ত্রস্ত। পাশাপাশি ওই বাংলায় মুক্তিযুদ্ধে রক্তস্নাত অভ্যু্দয়ে জন্ম নিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। আমরা ওই আগুন ঝড়ের সময়েরই কিশোর, সদ্য তরুণ। হয়েছিল কী, বরানগর-কাশীপুর গণহত্যাত, কোন্নগর-নবগ্রাম গণহত্যাণ, বারাসত-আমডাঙা গণহত্যাু এবং জেলে জেলে বন্দিহত্যাণর প্রতিবাদে আমাদের অঞ্চলে ওই ১৯৭২ সালে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীর দিনটির সন্ধেতেই একটি মশাল মিছিলের উদ্যোোগ নিয়েছিল কয়েকটি গণসংগঠন। নিষেধবিধির ওই সময়ে এই মিছিলের প্রস্তুতি ছিল সংগোপন। সে মিছিল তো বেরিয়েছিল। আমি, আমার বন্ধুরা সে মিছিলে ছিলাম। বেশ কিছুটা পথ যাওয়ার পর ওই মিছিল আক্রান্ত হয়। গুলি-বোমা এড়িয়ে কী করে জানি না, আমি ও আমার বন্ধু অষ্টু ছুটতে ছুটতে রেললাইনের পাশে একটি গর্তে পড়ে যাই। প্রাণভয়ে কাদায় বুক ডুবিয়ে সারা রাত সেখানে বসে থাকি। ভোরবেলায় স্থানীয় গোয়ালারা আমাদের উদ্ধার করেন। গরম দুধ খাইয়ে তাঁরা আমাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন। পরে জানতে পারি, অনেকে ধরা পড়েছিলেন। অলোকদার মিসা হয়ে গিয়েছিল। প্রাণরক্ষার ওই রজতজয়ন্তীর দিনটি জীবনভর মনে থাকবে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, ১৯৯৭-এর ১৫ আগস্ট। আমি তখন বরানগরে থাকি। ওই দিনটির কয়েকদিন আগে আমার কাছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংহতি পরিষদের কয়েকজন এলেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে তাঁরা একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেছেন। ওই দিন সকালে ওই অনুষ্ঠানে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের ৫০ জন কৃতীকে, যাঁরা ১৯৪৭-এর স্বাধীনতার দিনটির পরে জন্মেছেন, তাঁদের একটি স্বর্ণমণ্ডিত পদক ও মানপত্র দেবেন। কবি হিসেব ওই ৫০ জন কৃতীর তালিকায় আমার মতো অকৃতীকেও তাঁরা রেখে দিয়েছেন। শুনে আমি আশ্চর্য হলাম, কুণ্ঠিতও। অবশ্যক কিন্তু কিন্তু করে রাজিও হয়ে গেলাম।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনটিতে ওই অনুষ্ঠানে যাব বলে সাতসকালে দাড়ি কামাচ্ছি। পাশের বাড়ি থেকে ডাক এল, ফোন এসেছে। তখন বাড়িতে বাড়িতে ল্যা ন্ডফোনও ছিল না। তাই পাশের বাড়ির ফোন। ফোনে শোকসংবাদ পেলাম কুট্টিমামা মারা গিয়েছেন। আমার তিন মামার মধ্যেি এই ছোটভাইটি ছিলেন মায়ের খুব আদরের। আমাদের চার ভাই-বোনের খুব প্রিয় ছিলেন কুট্টিমামা। বালক বয়স থেকে আমার যে বই পড়ার অভ্যেবস, তা গড়ে দিয়েছিলেন এই মামা-ই, ফি বছর আমাকে বই উপহার দিয়ে দিয়ে। তাঁর মৃত্যুফর বয়স হয়নি, অকালেই ৫৮ বছরে মারা গেলেন তিনি। এই দুঃসংবাদে আমাকে আমার স্ত্রী প্রস্তাব দিলেন, ট্যা ক্সি নিয়ে প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উদ্যোীক্তাদের অনুরোধ করে আগেভাগে পদক, মানপত্র নিয়ে ওই ট্যা ক্সিতেই নিউ আলিপুরে কুট্টিমামার বাড়িতে চলে যেতে। আমি তা-ই করলাম। বরানগরে পাড়াতেই থাকেন ট্যা ক্সিচালক। সমস্যারও হল না। সংহতি পরিষদের ওই অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের বিজ্ঞানী, বাংলাদেশের স্থপতির সঙ্গে আলাপ পরিচয়ও হল না।
নিউ আলিপুরে কুট্টিমামার বাড়িতে পৌঁছনোর পর আমরা তাঁর মরদেহ নিয়ে দুপুরে পৌঁছলাম কেওড়াতলা শ্মশানে। সারি সারি মৃতদেহ। কুট্টিমামার স্থান হল ৩০/৩২ জনের পরে। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর মেঘলা দিনটিতে আমি দেখলাম তরুণী বধূর সিঁদুর লেপা মৃত মুখখানি, যেন হেসে লাফিয়ে উঠবে- তেমন মৃত কিশোর, যেন ঘুমন্ত- এমন যুবক, সর্বাঙ্গে যেন ‘বাবা মুস্তাফা’র সেলাই, ময়নাতদন্ত হওয়া এমন মৃতদেহও।
সারিতে কুট্টিমামা যখন অষ্টম বা নবম স্থানে, বেলা সাড়ে ৫টা, বাঁশদ্রোণী থেকে একজন ট্যা ক্সিতে এসে খবর দিলেন আমার ঝুন্টুমাসি মারা গিয়েছেন। কুট্টিমামার পরের বোন। কুট্টিমামার খুব আদরের এই অবিবাহিতা বোনটি ছিলেন শিক্ষিকা। দাদার মৃত্যুরসংবাদ পেয়েই হৃদরোগে অসুস্থ হয়েছিলেন, পাড়ার প্রতিবেশীরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েছিলেন। সেখানেই মৃত্যুক। কেওড়াতলা শ্মশানে এ খবর পৌঁছতেই আমার মেজমামা, যিনি খুব ধীরস্থির, আমার সঙ্গে কয়েকজন শবযাত্রী দিয়ে বললেন, তুমি যাও, হাসপাতাল থেকে ঝুন্টুমাসিকে নিয়ে এসো।
এই ঝন্টুমাসি, অর্চনা সেন, বালকবয়সে আমি যখন কবিতা লেখার চেষ্টা শুরু করি, তিনি এমএ পড়তেন। একদিন আমার খাতা খুলে বলেছিলেন, আরে, তুই তো দেখছি আধুনিক কবিতা লিখছিস! তখন কবিতাকে আধুনিক কবিতা বলা হতো। ওই বয়সে তিনি আমাকে এনে এনে দিতেন ‘কবি ও কবিতা’, ‘লা পয়েজি’, ‘উত্তরসূরি’ কবিতাপত্রগুলি।
হসপিটাল থেকে ঝুন্টুমাসির মৃতদেহ নিয়ে রাত সাড়ে ৭টা নাগাদ পৌঁছই কেওড়াতলায়। কুট্টিমামার দাহ কাজ তখন সবে শুরু হয়েছে। আবার সারি। ঝুন্টুমাসির মরদেহ ২৭-২৮ জনের পরে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাতটি শেষ হয় আরও আরও বালক, কিশোরী, শিশু, যুবকের অকাল মৃত্যুুর দেহ দেখতে দেখতে।
কাকতালীয়, তবু স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী আর সুবর্ণজয়ন্তীর দিন দুটি আমার স্মৃতিতে এক সুতোয় বাঁধা। সামনে ২০২২- এ স্বাধীনতার প্ল্যাীটিনাম জয়ন্তী। আমি বড় চিন্তায় আছি। উদ্বেগেও।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল