উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
নরম মাটি পেলে বিড়ালেও আঁচড়ায়। টলিউডের অনেক প্রযোজক, পরিচালকই এই সহজ, সরল, আমুদে মানুষটির সাদাসিদে স্বভাবের সুযোগ নিয়ে তুলসী চক্রবর্তীকে নানাভাবে হেয় করতেন। চরিত্রাভিনেতা বলে তাঁকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন না। মেকআপ শিল্পীরাও তাঁকে নিয়ে রঙ্গতামাশা করতেন। এসব কিছুই মুখ বুঝে সহ্য করতেন তুলসী। কোনওরকম প্রতিবাদের ধার ধারতেন না। তবে সাড়ে চুয়াত্তরের পরেও যে তুলসী চক্রবর্তী বড় চরিত্রে সুযোগ পাননি তার দায় শুধুমাত্র প্রযোজক-পরিচালকদের নয়। সাফল্য পাওয়ার পরেও ছবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন হননি তিনি নিজেও। না বাড়িয়েছেন পারিশ্রমিক, না বাড়িয়েছেন স্বভাবের গাম্ভীর্য। ন্যূনতম পারিশ্রমিকের বিনিময়েই ছবিতে কাজ করতেন তিনি। অনেক সময় ভালোবাসার মানুষদের কাছ থেকে কোনওরকম পারিশ্রমিকই নিতেন না। আরও একটা ব্যাপার হল, তিনি কোনও দিন কোনও ফিল্ম কোম্পানিকে ফেরাতেন না। অফার যা আসত তাতেই রাজি হয়ে যেতেন। ফল হতে থাকল নির্মম। ভালো কাজ সরে গিয়ে বারবার তাকে চাকর-বাকরের চরিত্রে ভাবা হতে লাগল।
তুলসী চক্রবর্তীকে ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়। বোধহয় সত্যজিৎবাবুই তাঁর অভিনয় প্রতিভা সঠিক আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। পরশুরামের কলম থেকে বেরনো পরেশ দত্তকে ছবিতে অবলীলায় জীবন্ত করে তুলেছিলেন তুলসী। ‘সত্যজিৎ রায়: দ্য ইনার আই: দ্য বায়োগ্রাফি অব আ মাস্টার ফিল্ম মেকার’-এর লেখক অ্যান্ড্রু রবিনসন ‘পরশ পাথর’ ছবিতে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘Chakravarti recalls Chaplin to his best. Instead of Moustache, he has a pair of eyes as bulbous as a frog's which he opens wide with every emontion known to man.’
চিৎপুরের ছাপাখানায় কাজ করতে করতে সেখানে হ্যান্ড বিল আর পোস্টারে নাম করা শিল্পীদের ছবি দেখেই যে অভিনয়ের প্রতি ঝোঁকটা বেড়ে গিয়েছিল তুলসী চক্রবর্তীর তা তো আগেই জানিয়েছি। তবে বেশিরভাগই ছোটখাট পার্ট করায় সেই আশা আর তাঁর পূরণ হচ্ছিল না। আশ মিটল একেবারে শেষ বয়সে এসে ‘পরশ পাথর’ ছবিতে। বড় বড় হোর্ডিংয়ে বিরাট আকারে জ্বলজ্বল করত তাঁর মুখচ্ছবি।
‘পরশ পাথর’ ছবিতে নির্বাচিত হওয়ার পর সত্যজিতের নির্দেশে এক দর্জি তুলসীর বাড়ি গিয়েছিলেন পাঞ্জাবির মাপ নেওয়ার জন্য। তাঁর মতো অভিনেতাকেও যে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হতে পারে তা কোনও দিন ভাবেননি তিনি। নায়কের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য পাঞ্জাবির মাপ নিতে দর্জি আসছেন বাড়িতে! আনন্দে আত্মহারা তুলসী বলেছিলেন, ‘উফঃ এ আমি কখনও ভাবতে পারিনি।’
এই ছবির শ্যুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ রায় তাঁকে গাড়িতে করে আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। হাওড়া টু টালিগঞ্জ। কিন্তু তুলসী এই সামান্য সুবিধাটুকুও নিতে চাননি। বলেছিলেন, ‘না রে বাবা আমার ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসই ভালো। গাড়িতে চেপে এলে অন্য প্রযোজকরা ভেবে বসতে পারেন যে এবার তুলসী বেশি টাকা চাইবে। ওঁরা আর কাজে ডাকবেন না।’
মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেও অনেক কম পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন তুলসী চক্রবর্তী। সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, তাঁর ছবির নায়ককে এত কম টাকা দিতে পারবেন না। তিনি সাম্মানিক বাড়ানোর কথা বলেছিলেন, তুলসী রাজি হননি। ছবি শেষ হওয়ার পর পরিচালক তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি তো ছবির নায়ক। এত কম টাকায় রাজি হলেন কেন?’ উত্তরে তুলসীর সেই এক কথা, ‘এর থেকে বেশি নিলে বাকি শিল্পীরা কী দোষ করল। আমাকে এত বেশি টাকা দেবেন না। আমি যদি এত হাজার টাকা পাই, তবে পরে আর কেউ আমাকে নেবে না। সবাই বলবে তুলসী রেট বাড়িয়ে দিয়েছে।’
কেন যে নিজের সম্পর্কে এই মনোভাব ছিল তাঁর! অথচ বাঘাবাঘা সব অভিনেতারা তাঁর সঙ্গে এক ফ্রেমে অভিনয় করতে ভয় পেতেন রীতিমতো। দিকপাল ছবি বিশ্বাস তাঁর এই সতীর্থ সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘আমি কখনও কোনও ছায়াছবির সংলাপ সেভাবে মুখস্থ করি না। একটু চোখ বুলিয়ে তা পর্দায় নিজের মতো করে বলি। কিন্তু যখন তুলসীর সঙ্গে অভিনয় করতে হয়, তখন সংলাপগুলো ভালো করে মুখস্থ করে নিতে হয়। কারণ বলা যায় না, তুলসী কখন কী অভিনয়ের প্যাঁচ কষে কুপোকাত করে দেয়।’ ছবি বিশ্বাস জানতেন সহঅভিনেতা যখন তুলসী, তখন অভিনয়টাও করতে হবে টক্কর দেওয়ার মতো।
একবার এক সিনেমার শ্যুটিংয়ে অনাহুতের মতো উপস্থিত হয়ে বৈষ্ণব সাজার অনুমতি পেয়েছিলেন তুলসী। বৈষ্ণব সেজে শ্রীখোল হাতে পরিচালকের সামনে যেতেই পরিচালক তাঁকে একেবারে সামনের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিলেন। তুলসী শট দিলেন—খোল বাজাচ্ছেন, মুখে হরিনাম, চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে। পরিচালক এত খুশি হলেন যে দেড় মিনিটের শট তিনি চার মিনিট নিলেন এবং সিনেমাতেও সেটা রেখে দিলেন। এমনই ছিল তাঁর অভিনয় প্রতিভা।
আবার ‘পরশ পাথর’ ছবির কথায় ফিরি। এই ছবিতে অভিনয়ের সময় তিনি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন। পরিচিত এক সাংবাদিককে বলেছিলেন, ‘আমাকে নায়ক বানিয়ে ছবি হচ্ছে, এ তো আমি ভাবতেই পারছি না। তাও কি না সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষের ছবিতে! এই বারে আমি নির্ঘাৎ পাগল হয়ে যাব। জীবনে তো কখনও এত বড় মুখ হোর্ডিংয়ে দেখিনি। এর আগে যাও বা দু-চারবার হয়েছে, তা সেসব মুখ তো দূরবীন দিয়ে খুঁজে বার করতে হতো। এ আমি কী হনু হলাম রে!’
ছবির পোস্টার ডিজাইন দেখে সত্যজিৎ রায়ের উদ্দেশে কপালে হাত ঠেকিয়ে নমস্কার জানিয়ে বলেছিলেন, ‘মানুষটা কীরকম রসিক দেখেছ! আমার টাক ফাটিয়ে আটখানা করে তার ভেতর থেকে রস বের করেছেন। আবার লিখেছেন আহ্লাদে আটখানা। আহা!’ পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে এই বর্ষীয়ান অভিনেতা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সত্যজিৎ বলেছিলেন, ‘তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতার কদর এই পোড়া দেশে কেউ করবে না। তিনি যদি আমেরিকায় জন্মাতেন, নির্ঘাৎ অস্কার পেতেন।
(ক্রমশ)
‘পরশ পাথর’ ছবির বিভিন্ন দৃশ্যে তুলসী চক্রবর্তী। অলঙ্করণ: নবারুণ সেন