উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
চরিত্র ছোট না বড়, গুরুত্ব আছে না নেই, এসব সাতপাঁচ ভাবনাকে আমলই দিতেন না তুলসী চক্রবর্তী। মন-প্রাণ ঢেলে শুধু অভিনয় করে যেতেন। ‘শুন বরনারী’ ছবিতে সুপ্রিয়াদেবীর সঙ্গে ছিলেন মাত্র একটি দৃশ্যে। ট্রেন যাত্রার সেই একটি মাত্র দৃশ্যেই কিস্তিমাত। ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবিতে তবলিয়ার ভূমিকায় কালোয়াতি গানে অসাধারণ তবলা বাজিয়েছিলেন। ‘শুভদা’ ছবিতে নিজের কণ্ঠে গান গেয়েছিলেন। ‘কবি’ ছবিতে দর্শক তাঁর নাচ প্রত্যক্ষ করেছেন।
অভিনয় ও গান-বাজনার পাশাপাশি তুলসী চক্রবর্তী সেলাই-ফোড়াইতেও হাত পাকিয়েছিলেন। জীবনের কোনও কিছুই যায় না ফেলা! থিয়েটারে একবার অন্যের বদলে কয়েকটা দিন রাজার অভিনয় করতে হয়েছিল তাঁকে। তা অভিনয় করতে গিয়ে দেখেন রাজার নাগরা নেই। দমে যাননি তিনি। মোজার উপর সাজার রং লাগিয়ে, এঁকে, সেলাই করে তৈরি করে ফেলেন নাগরা। সেটা পরেই নেমে পড়েন মঞ্চে। এই হলেন তুলসী চক্রবর্তী।
বাড়িতে নারায়ণ শিলা ছিল। এই গৃহদেবতার নিত্যপুজো করতেন তিনিই। নিজে নিয়মিত বাজার করতেন। অভিনয়ের পাশাপাশি এই একটা জিনিসেও তাঁর দারুণ ইন্টারেস্ট ছিল। তাঁর সহশিল্পীরাও এই ভালোবাসার কথা জানতেন।
একদিন তুলসী চক্রবর্তী যথারীতি স্টার থিয়েটারের লবিতে আসর জমিয়ে বসেছেন। তাঁকে ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকজন। এমন সময় যেখানে হাজির হলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত নাট্যকার তথা নাট্য নির্দেশক দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—
‘আজ কী বাজার করলেন তুলসীদা?’
তুলসী চক্রবর্তী বললেন, ‘আর বোলো না ভাই। বড্ড হয়রানি হতে হয়েছে আজ ফুল কিনতে গিয়ে। অনেক দোকান ঘুরলাম। কিন্তু কোনও ফুলের দোকানেই আজ কর্তাপাতা নেই।’
দেবনারায়ণ গুপ্ত তো হতবাক। বিস্ময়াবিষ্ট চোখে জানতে চাইলেন, ‘কর্তাপাতা! সে আবার কী! এমন পাতার নাম তো কখনও শুনিনি।’
ওদিকে তুলসীর থামার লক্ষণ নেই। এক নাগাড়ে বলেই চলেছেন, ‘কর্তাপাতা না হলে কি নারায়ণের পুজো হয়?’
সকলে যখন এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে, তখন তুলসী চক্রবর্তীর পাশে বসে থাকা বাংলা থিয়েটার ও সিনেমার আরও এক নমস্য অভিনেতা জহর গাঙ্গুলি রহস্য সমাধানে এগিয়ে এলেন। এই জহর গাঙ্গুলিকে অভিনেতা তৈরির পিছনে বিরাট অবদান তুলসী চক্রবর্তীর সে কথায় পরে আসছি।
জহর গাঙ্গুলি বললেন, ‘আসলে ওঁর বউ তো তুলসী শব্দটা উচ্চারণ করতে পারে না, আমাদের কাছে সেই কথাটাই কেমন কায়দা করে জানিয়ে দিল, দেখেছেন তো।’ জহর গাঙ্গুলির কথায় সকলে হেসে উঠল। স্বয়ং, তুলসীও তখন মিটিমিটি হাসছেন।
বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের স্বনামধন্য অভিনেতা, পরিচালক ও নাট্যকার অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছেই যে অভিনয়ের অ-আ-ক-খ শিখেছিলেন তুলসী, তা তো আগেই বলেছি। এই অপরেশ মুখোপাধ্যায়কে ধরেই তুলসী পথ দেখিয়েছিলেন জহর গাঙ্গুলিকে। তুলসী না থাকলে যে অপরেশচন্দ্রের কাছে পৌঁছতেই পারতেন না তিনি, তা এক বাক্যে স্বীকার করতেন জহর গাঙ্গুলিও। বন্ধুকে স্টার থিয়েটারে ঢোকানোর জন্য অপরেশবাবুর পা পর্যন্ত ধরেছিলেন তুলসী। সেকথা নিজেই বলে গিয়েছেন জহর গাঙ্গুলি।
গ্রাম থেকে কলকাতায় এসে তখন চোখে সরষে ফুল দেখছেন জহর গাঙ্গুলি। হালে পানি না পেয়ে কোনওক্রমে মিত্র থিয়েটারে ভিড়ের দৃশ্যে অভিনয় করার ছাড়পত্র পেয়েছেন। নতুন বলে অন্য অভিনেতারা তো বটেই চাকর-বাকরেরাও বাঁকা চোখে দেখত। সেই সময় তুলসীর সঙ্গে আলাপ জহরের। তুলসী তখন স্টারে। পাঠ শেষ করে মাঝে-মধ্যে যেতেন মিত্র থিয়েটারে। সেখানেই দু’জনের সুখ-দুঃখের কথা হতো। কলকাতা শহরে একবেলা খেয়ে কী করে দিন কাটছে জহরের, তা শুনে কষ্ট পেতেন তুলসীও। একদিন সহকর্মীদের নিষ্ঠুর ব্যবহারে গুম হয়ে বসে আছেন জহর। সেই সময় তুলসীকে দেখে চোখের জল সামলাতে পারলেন না। সেদিন তুলসী তাঁকে স্টার থিয়েটারে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। বললেন, ‘কাল একবার আয়। রিহার্সাল আছে, তখন স্যারের (অপরেশচন্দ্র) কাছে নিয়ে যাব। চেষ্টা করে দেখি। এখানে থাকলে তো তুই গঞ্জনা শুনতে শুনতেই মরে যাবি।’
পরদিন বিকালে স্টারে গিয়ে জহর দেখেন যে তাঁর জন্য তুলসী চক্রবর্তী স্টার থিয়েটারের গেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন। চোখে-মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ। জহর যেতেই বললেন, ‘এত দেরি করতে হয়। রিহার্সাল কখন শুরু হয়ে গিয়েছে। স্যারের রিহার্সালে দু’মিনিট দেরি হলেও কথা শুনতে হয়।’
একথা বলে জহরকে একপ্রকার টানতে টানতে অপরেশ মুখুজ্যের কাছে নিয়ে গেলেন তুলসী। গালভরা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘এই যে স্যার, এই ছেলেটিকে এনেছি আপনার কাছে।’
অপরেশচন্দ্র তো আকাশ থেকে পড়লেন। ভ্রূ কুঁচকে বললেন, ‘ছেলেটিকে এনেছ মানে? একে নিয়ে কী করব? জামাই করব?’
উত্তরে তুলসী বললেন, ‘না স্যার! ওকে নিয়ে এলাম অভিনয় করানোর জন্য। মিত্র থিয়েটারে পড়ে পড়ে সকলের গঞ্জনা সইছিল। তা আমিই বললাম, জহর, চল স্যারের কাছে। একবার তিনি যদি তোকে পায়ে ঠাঁই দেন, তবে গোজন্ম থেকে উদ্ধার হয়ে যাবি।’
অপরেশবাবু বিরক্তই হলেন। বললেন, ‘খুব যে তৈলমর্দন করতে শিখেছ! তা আমি কি তোমাকে বলেছিলাম একটা ছেলে ধরে নিয়ে আসতে! না, না, আমার নতুন নাটকে কোনও নতুন ছেলের দরকার নেই।’
অপরেশবাবুর কথা শুনে জহর গাঙ্গুলি তো মনে মনে প্রমাদ গুনলেন। তুলসী ঝপ করে অপরেশচন্দ্রর পা দুটো জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘এই আপনার পায়ে পড়ছি স্যার! ছেলেটাকে একটু চান্স দিয়ে দেখুন, ও দুঃখী ছেলে স্যার। খুব ভালো ছেলে। আপনি একটু পায়ে ঠাঁই দিলে ও চিরকাল আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকবে।’