উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
৭
সবার জীবনই স্মৃতিময়। তবে কিনা জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় অতীত একসময় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। তবুও কখনও কোনওভাবে হঠাৎ করে মনে যদি দোলা লাগে তখনই গুনগুনিয়ে উঠি ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন আমার...’
এবার থামতেই হচ্ছে। বাল্য, কৈশোর ও যৌবনের অনেক কিছুই তো স্মৃতিময়। তাই আমার স্কুল জীবনের একটি ঘটনার কথাই বলি।
আমি তখন হাওড়া রামকৃষ্ণপুর হাইস্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। সেবার পুজোর আগেই আমাদের বার্ষিক উৎসবের দিন স্থির হল। এই উৎসবের সময় ছোটদের জন্য কোনও নাটক মঞ্চস্থ হলে স্যাররা আমাকে দিয়েই অভিনয় করাতেন বেশি। এতে অনেক ছেলেই ঈর্ষা করত আমাকে। এদের মধ্যে পূর্ণেন্দু নামে একটি ছেলে আমাকে একদমই সহ্য করতে পারত না। পরে অবশ্য তার সঙ্গে আমার ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে কথা যাক।
পূর্ণেন্দু আর আমি অভিনয়ের জন্য মেকআপ করে বসে আছি। শুধু উদ্বোধনের অপেক্ষা। সভাপতি ও প্রধান অতিথি এলেই শুরু হবে অনুষ্ঠান।
এমন সময় হঠাৎই কার যেন মনে হল, এই যাঃ! সভাপতি এবং প্রধান অতিথির বরণ মালা তো আনা হয়নি। কিন্তু এখন মালা আনতে যাবেটা কে? স্টেজের কাছ থেকে কেউ তো নড়তে চায় না।
অবশেষে পূর্ণেন্দুই ওর এক বন্ধুকে নিয়ে এগিয়ে এসে স্যারদের বলল, ‘আমাকে টাকা দিন মালা আমিই এনে দিচ্ছি।’
স্যাররা বললেন, ‘তুই কী করে যাবি? তুই তো এখন মেকআপ করে ফেলেছিস!’
পূর্ণেন্দু বলল, ‘আমার এখনও মেকআপ কমপ্লিট হয়নি, আমি যাব আর আসব।’ বলেই তৈরি হয়ে নিল। এরপর ওর এক সঙ্গীকে নিয়ে উধাও হয়ে গেল চোখের পলকে।
এই পূর্ণেন্দু হল আমাদেরই প্রিয় শিক্ষক হরিপদবাবুর নাতি। দুরন্তপনায় ওর সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারত না।
যাই হোক, সভাপতি ও প্রধান অতিথি পৌঁছনোর আগেই ফুলমালা নিয়ে ফিরে এল ও। এতে স্যাররাও বেজায় খুশি। না, ছেলেটা চঞ্চল হোক, উপস্থিত বুদ্ধি মাথায় আছে। শুধু মালা নয় বুদ্ধি করে দুটো ফুলের তোড়াও নিয়ে এসেছে।
ইতিমধ্যে সভাপতি ও প্রধান অতিথি এসে হাজির হলেন। সভাপতি হয়েছিলেন স্থানীয় বিধায়ক এবং প্রধান অতিথি এই অঞ্চলেরই একজন স্বনামধন্য ডাক্তার। ওঁরা এলেন এবং মঞ্চও আলোকিত করলেন। পাঁচ-ছয় বছরের একটি বালিকাকে দিয়ে মাল্যদানও করানো হল।
হাততালিতে ফেটে পড়ল দর্শকরা।
কিন্তু এ কী! মালা পরার পর মাননীয় অতিথিদের নাক হঠাৎ সিঁটকে গেল কেন? বারবার দু’জনে কী যেন শুঁকলেন। তবে কি মালা পছন্দ হয়নি ওঁদের? না হলেও কিছু আর করার নেই। মালা গলা থেকে খুলে দু’জনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। তারপর রেখে দিলেন টেবিলের উপর।
এরপর শুরু হল উদ্বোধনী সঙ্গীত। একেবারেই বেসুরো গলার গান। তাই হাসির হুল্লোড় উঠল চারদিক থেকে। সভাপতি এবং প্রধান অতিথিও হাসি চাপতে রুমালে মুখ মোছার ভান করলেন।
উদ্বোধনী সঙ্গীতের পর শুরু হল একে একে ভাষণ। সভাপতি মহাশয় ভাষণ দিতে উঠে বললেন, ‘মাননীয় শিক্ষক মহাশয়, অভিভাবকবৃন্দ ও ছাত্রবন্ধুগণ! আজ এই আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসে আমি সত্যই অভিভূত। এমনই যে আমার মুখ দিয়ে আর কথা সরছে না। শুধু তাই নয়, অভিজ্ঞতাও যা হল তাতে মনে হল এ কোনও দুরন্ত কিশোরের কাজ। দুরন্তপনার যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে দেখলাম, তা চিরকাল মনে থাকবে। এই একই অভিজ্ঞতা প্রধান অতিথি মহাশয়েরও। তবু অনুরোধ, যে বা যারা করেছে এই কাজ, তাদের যেন শাস্তি দেওয়া না হয়। কেন না এরাই আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ।’
এমন কথা শুনে শিক্ষকরাও প্রত্যেকের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন।
সভাপতি মহাশয় বললেন, ‘আমি আমার ভাষণ এখানেই শেষ করছি। তার কারণ আমাকে এবং প্রধান অতিথি মহাশয়কে এক্ষুনি বাড়ি গিয়ে স্নান করতে হবে। তবে তার আগে হেডমাস্টার মহাশয়কে একবার মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি।’
লজ্জিত হেডমাস্টার মহাশয় সংকুচিত হয়ে মঞ্চে এসে বললেন, ‘ব্যাপারটা কী বলুন তো?’
বলব। তার আগে বলুন, ‘এই মালা কাদের দিয়ে আনিয়েছিলেন?’
‘আমরা ফুল-মালা কাজের চাপে আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। তাই দু’জন ছাত্রকে দিয়ে আনিয়েছিলেন।’
সভাপতি মশাই ভেবে বললেন, ‘হুম! তাহলে ঠিকই ধরেছি এ কোনও দুষ্টু ছেলের কাজ।’
হেডমাস্টার মহাশয় এবং আরও দু’-একজন স্যার এবার কাছে এসে বললেন, ‘ওরা কী করেছে বলুন? কান ধরে ওঠ-বোস করাব ওদের।’
‘না, না, তা করবেন না।’ বলে ফুলমালা দেখিয়ে বললেন, ‘এটা কী?’
‘আজ্ঞে কই।’
‘এদিকে কী লেগে?’
‘সিঁদুর।’
‘আর এই গন্ধটা?’
‘সেন্টের।’
‘তাহলে আর কিছু কি বুঝতে বাকি থাকে?’
স্যারেরা সবাই মাথা নত করলেন।
হেড মাস্টার মহাশয় জিভ কেটে বললেন, ‘ক্ষমা করুন। দোহাই আপনাদের। এ আমাদের স্কুলের বদনাম। এ তো মড়ার গলা থেকে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া মালা আর তোড়া। এ নিশ্চয়ই এখানকার বাঁশতলা ঘাটের শ্মশান থেকে কুড়িয়ে এনেছে ছেলে দুটো। ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’
এমএলএ মহাশয় বললেন, ‘আর ছিঃ ছিঃ, করে লাভ নেই। এখন কাউকে দিয়ে এগুলো ফেলিয়ে হাত ধোবার ব্যবস্থা করে দিন।’
সকলের মাথা হেঁট করে সভাপতি এবং প্রধান অতিথি মহাশয় বিদায় নিলেন। এরপরই টেনে আনা হল পূর্ণেন্দুকে।
সমস্ত স্যাররা একবার ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন।
তাঁদের মধ্যে এক স্যার নববাবু বললেন, ‘এখন আর ওকে কিছু বলার দরকার নেই। যা হওয়ার তা অনুষ্ঠানের শেষেই হবে।’
একটু পরেই শুরু হল অনুষ্ঠান। ‘সাজাহান’ থেকে নেওয়া একটি দৃশ্যের অভিনয়। পার্ট তো একদম মুখস্থই করেনি। তার ওপর কুকীর্তি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ভয়ে সব ডায়লগ ভুলে গিয়েছে। অথচ ওর আর আমার অভিনয়ের উপরই নির্ভর করছিল সব। কারণ এই নাট্যাংশে দুটিই মাত্র চরিত্র। তার একটি আমি অন্যটি ও। আমি অভিনয় করার উৎসাহে জলের মতো মুখস্থ করেছিলাম ডায়লগগুলো। ও তা করেনি। তাই পদে পদে আটকে যাচ্ছিল। অবশেষে হরিপদবাবু স্টেজের পিছন থেকে ওর ডায়লগগুলো জোরে জোরে প্রম্পট করতে লাগলেন। আর সেগুলো মাইক্রোফোনে ধরা পড়ে যাচ্ছে! তাতে হাসির ফোয়ারা ছুটল চারদিকে।
আমার তখন যতটা না হাসি পেল, তার থেকে বেশি রাগ হল। পূর্ণেন্দু যদি এভাবে না ডোবাত, তাহলে সেদিনের সেই অভিনয়ের স্মৃতি স্মরণীয় হয়ে থাকত আমার জীবনে।
যাই হোক, পরবর্তীকালে সে অবশ্য খুব ভালো ছেলে হয়ে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল ওর জীবনে। হোক সে দুরন্ত, তবু সব ভালো যার শেষ ভালো তার। এখন সে প্রবাসী।
অলঙ্করণ: সোমনাথ পাল