উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
এক পারিবারিক উৎসবে যোগ দিতে নাগপুরে আমার গৃহিণীর ছোটকাকার বাড়িতে গিয়েছিলাম— সপরিবারে, সআত্মজনে। মোট চোদ্দোজন। উৎসব মিটে গেলে একদিন স্থির হল অ্যাডভেঞ্চার করতে বেরব— যেদিকে দু’চোখ যায়। ছোটকাকা প্রস্তাব দিলেন, ‘তাহলে তোমরা বাঘের ডেরা দেখে এসো। চিড়িয়াখানার বাঘ নয়, জঙ্গলের টাটকা বাঘ। হাতে গরম। জীবনে এই স্মৃতি ভুলবে না।’
আমরা পাঁচজন পুরুষ, পাঁচজন নারী, চারটি শিশু। মেয়েরা মুহূর্তে নস্যাৎ করে দিল এরকম রোমহর্ষক প্রস্তাব। বলল, ‘উরিব্বাস! বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বাঘের মুখোমুখি হতে চাই না।’
ছোটকাকা বোঝালেন, ‘তোমরা গাড়ির মধ্যে থাকবে। খুবই সুরক্ষিত গাড়ি। বাঘ এসে গাড়ির চারপাশ দিয়ে ঘুরে গেলেও ভয়ের কিছু নেই। আমি কয়েকবার তোতলাডো গিয়েছি। অন্তত দু’বার বাঘবাবুরা এসেছিলেন করমর্দন করতে, তবে আমরা দূর থেকে নমস্কার করে বলেছি, সিইউ এগেইন।’
সেদিন বিকেলে বললেন, ‘গাড়ি ও বাংলো—সব বুক করে দিয়েছি।’ জায়গাটার নাম তোতলাডো। নাগপুর থেকে পাঁচ-ছ’ ঘণ্টার গাড়িপথ। তোতলাডোতে একটি ফরেস্ট গেস্ট হাউস আছে, সেখানে পাঁচটি ঘর সংরক্ষিত আমাদের নামে। সাতসকালে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম একটা বড় আকারের গাড়িতে। গাড়িটা বেশ মজবুত। মেয়েরাও দেখে-শুনে রায় দিল, হ্যাঁ, সুরক্ষিত বলা চলে। চোদ্দোজন বসার পরেও আরও দু-তিনটি সিট খালি। ড্রাইভারের চেহারাও বেশ মজবুত। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ হবে। মুখে ঘন কালো চাপ দাড়ি। নামটিও জম্পেশ, সিরাজ।
ফেব্রুয়ারির সকালে বেশ ঠান্ডা-ঠান্ডা আবহাওয়া। শহর পেরিয়ে হাইওয়েতে পড়তেই সিরাজ গাড়িতে গতি তুলল। ঝকঝকে পিচ পথ, দু’পাশে সবুজ প্রকৃতি, হু হু করে চলেছে গাড়ি। একটার পর একটা গঞ্জ পড়ছে রাস্তায়, তারপর আবার সবুজ। ঘণ্টা দুয়েক পরে রাস্তায় পড়ল একটি চমৎকার জলাশয়— খিনসি লেক। জল এতটাই স্বচ্ছ যে, অনেক নীচের নুড়িপাথর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।
কিছুক্ষণ জলবিহার করে কাছাকাছি একটি ধাবায় দুপুরের খাওয়া। কিন্তু এত সব করে বেরতে বেরতে বিকেল। ড্রাইভার সিরাজ একটু খুঁতখুঁত করে বলল, একটু দেরি হয়ে গেল, স্যার।
তোতলাডো পৌঁছতে সন্ধে। যে বাংলাটির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়াল, সেই দোতলা বাড়িটির চেহারা দেখে সবাই বলে উঠল, ‘দারুণ, দারুণ’। পাঁচটা ঘরে যার-যার লাগেজ রাখতে বাংলোর চৌকিদার এসে জানতে চাইল, রাতের ডিনার লাগবে কি না। ‘লাগবে’ বলতেই জানাল, এখন মার্কেট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। চিকেন পাওয়া যাবে না। অগত্যা ডিমের ঝোল আর ভাত।
—তাই হোক, বলতে—ওদিকে সিরাজ তাগাদা দিচ্ছে, ‘চলুন স্যার, একবার জঙ্গলটা দেখে আসি।’ মেয়েরা আপত্তি করছিল, কী দরকার! এই তো ভালোই ঘোরা হল, কাল সকালে এখান থেকেই ব্রেকফাস্ট খেয়ে বেরিয়ে যাব। কিন্তু আমরা কয়েকজন চাইছি জঙ্গলের ভিতরটা একটু ঘুরে আসতে। এত কাছে এসে জঙ্গল না দেখে ফিরে যাব! সিরাজও বলল, ‘চলুন, স্যার।’
প্রধানত সিরাজের তাগিদেই আবার বেরিয়ে পড়ি। পিচ রাস্তা পেরিয়ে একটু পরেই একটি পাহাড়ি এলাকা। ঘন জঙ্গলে-ঢাকা পাহাড়ের মধ্যে একটা সরু পথ। সিরাজ সাঁ করে সেই পথে ঢুকে পড়ল, আর সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঝাঁপিয়ে পড়ল জঙ্গুলে পথে। সামনে গাড়ির হেডলাইটে দেখা যাচ্ছে সরু পাহাড়ি পথ। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর মেয়েরা বলল, ‘ব্যস, অনেক হয়েছে, এবার ফিরে চল।’
সিরাজকে শুনে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘ফিরব, সামনে গাড়ি ঘোরানোর জায়গা পেলেই। তবে সেখানেই বাঘের ডেরা। এ সময় তেনারা ঘুরতে বেরন।’
সামনে শুধু সরু পথ, ঘোরানোর কোনও জায়গাই নেই। গাড়ি ক্রমশ সেঁধিয়ে যাচ্ছে আরও আরও দূরে। মিনিট চল্লিশ পার হয়ে গিয়েছে। আমিও বললাম, ‘সিরাজ এবার ফেরো।’
হাওয়ায় পচা মাংসের গন্ধ পেতেই সিরাজ বলল, ‘বাঘেরা নিশ্চয় ডিনার সারছে এখন।’ কী সর্বনাশ! সবাই চেঁচামেচি করাতে সিরাজ সামনে একটা চওড়া জায়গা পেয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল, আর কী আশ্চর্য, হঠাৎ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ। সিরাজ চাবি ঘুরিয়ে দু-তিনবার চেষ্টা করার পরেও যখন গাড়ি স্টার্ট নিল না, গাড়ি থেকে নেমে বনেট খুলে কী যেন দেখে বলল, ‘স্যার, গাড়িতে তেল খতম।’
—তেল নেই! সে কী! আমরা চেঁচিয়ে বললাম। এটা ঠিক, সকালে নাগপুর থেকে বেরিয়ে বেশ কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চলেছে, সিরাজ কিন্তু একবারও বলেনি রাস্তায় তেল নিতে হবে। বিরক্ত হয়ে সে কথাই বললাম, ‘তোতলাডো থেকে বেরনোর সময় তুমি দেখে নাওনি তেল আছে কি নেই!’
গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হওয়ায় চারদিক ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। সিরাজের মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। গাড়ির ভিতরে তখন মেয়েদের আতঙ্ক আর চেঁচামেচি বেড়েই চলেছে। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলছে, ‘কী রকম কাণ্ডজ্ঞান তোমার! এতগুলো বাচ্চা সঙ্গে। এরকম বিপদের মধ্যে ফেললে আমাদের। কী হবে এখন!’
সিরাজ গাড়ির ভিতরে থেকে একটা খালি জেরিকেন বের করে বলল, আমি চট করে শহরে গিয়ে তেল নিয়ে আসি।
—কত দূরে শহর?
—যেতে এক ঘণ্টা ফিরতে এক ঘণ্টা।
বললাম, ‘তুমি আমাদের এই জঙ্গলে অন্ধকারে ফেলে রেখে চলে যেতে চাইছ! ইয়ার্কি পেয়েছ!’ গাড়ির ভিতরে তখন হইচই, ভয় তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পচা গন্ধটা তখন যেন আরও ছড়িয়ে পড়েছে। কাছাকাছি কোথাও নিশ্চয় বাঘের ডেরা আছে। সেই ডেরায় আমাদের রেখে— রেগেমেগে বললাম, ‘তুমি এখন কোথাও যাবে না।’
প্রায় মিনিট পনেরো এরকম তীব্র চেঁচামেচি হওয়ার পর সিরাজ আবার চড়ে বসল গাড়িতে, বলল, ‘দেখি আবার চেষ্টা করে।’ বলে চাবি ঘোরাতেই সবাইকে চমকে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট নিল। তারপর হুশ করে গাড়ি ছুটিয়ে চলল ফিরতি পথে
গাড়ির মধ্যে একরাশ উল্লাস। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী ব্যাপার, সিরাজ, তুমি বললে তেল নেই!’
সিরাজ একগাল হেসে বলল, ‘তেল ছিল স্যার। ট্যাঙ্কে তেল না থাকলে কোনও ড্রাইভার রাস্তায় বেরবে না। আমি দেখলাম, বাঙালি বাবুদের সাহস কতখানি!’