উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে সাফল্য আসবে। হিসেব করে চললে তেমন আর্থিক সমস্যায় পড়তে হবে না। ব্যবসায় উন্নতি ... বিশদ
আজ তুলসী চক্রবর্তী। অষ্টম কিস্তি।
তুলসী চক্রবর্তীর এহেন আচরণে অপরেশ মুখোপাধ্যায় হতচকিত হয়ে গেলেন। খানিকটা বিব্রতও হলেন, বলে উঠলেন, ‘আহা কর কী! কর কী! পা ছাড়ো। ঠিক আছে, তুমি ওকে নিয়ে গিয়ে বসাও। রিহার্সালের পর আমি ওর সঙ্গে কথাবার্তা বলব। পা ছাড়ো।’ জহর গঙ্গোপাধ্যায় মুক্ত কণ্ঠে বলতেন, ‘চক্কোত্তি না থাকলে আমার হয়তো কোন দিন অভিনেতা হওয়াই হতো না।’ অথচ ভাগ্যের কী পরিহাস! যার জন্য তুলসী চক্রবর্তী সে দিন অপরেশবাবুর পায়ে ধরেছিলেন, পরবর্তীকালে সেই ছেলেটাই হয়ে গেল বাংলা ছবির হিরো। আর তুলসী নিজে সারা জীবন হিরো বা হিরোইনের বাড়ির চাকরের চরিত্রেই অভিনয় করে গেলেন।
কিন্তু এই যে জহর গাঙ্গুলি হিরো হতেন, আর তুলসী চক্রবর্তী সাজতেন তাঁর বাড়ির চাকর, এই ব্যাপারটা অন্য কারওর ক্ষেত্রে হলে হয়তো দু’জনের বন্ধুত্বের মধ্যে চিড় ধরাতে পারত। কিন্তু এই দু’জনের ক্ষেত্রে তা কোনওদিনও হয়নি। আর সেই কৃতিত্বও জহর দিয়েছেন তুলসীকেই।
জহর গাঙ্গুলির কথায়, ‘চক্কোত্তি এমন একজন বড় মাপের মানুষ, বড় মনের মানুষ ছিল, এমনি তার হৃদয়ের উদারতা, যে ওসব ছোটখাট ব্যাপার তার কাছে পাত্তাই পেত না। যদিও আমার মধ্যে ওর সম্পর্কে একটা আড়ষ্টতা বরাবরই ছিল। দেখা হলে ওর সঙ্গে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যে ভালো করে কথা বলব, সেটাও পারতাম না। অথচ চক্কোত্তি ছিল অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। উল্টে বরং ও মাঝেমাঝেই আমাকে ঠাট্টা করে বলত, ‘কি হে সুলালবাবু (জহর গাঙ্গুলিকে এই নামে ডাকতেন সতীর্থরা), আজকাল তুমি তো বড়ই ব্যস্ত, দিনরাত কাজ করছ, ভালোই রোজগারপাতি হচ্ছে। দেখো ভাই, আমাদের মতো অভাজনদের যেন একেবারে ভুলেটুলে যেও না।’
বুঝতে পারতাম এমন রসিকতা চক্কোত্তিই করতে পারে। এইসব কথা বলতে বলতে ওর মুখ হাসিতে ভরে উঠত। বুঝতে পারতাম আমার সাফল্যটাকে ও নিজের সাফল্যই মনে করে। এমনই সিংহ হৃদয়ের মানুষ ছিল ও।’
মধ্য হাওড়ার সংকীর্ণ গলি ২ নং কৈলাস বসু থার্ড লেন। সেখানে দু’কামরার বাড়িতে থাকতেন তুলসী চক্রবর্তী আর তার স্ত্রী ঊষারানি দেবী। দু’ধারে সারি সারি ঘর, সঙ্গে লাগোয়া রান্নার জায়গা। মাঝখান দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা। সেই পথটুকু পেরিয়েই তাঁর ঘরে পৌঁছতে হতো। সুযোগ পেলেই সেই ঘরে বসাতেন গানের আসর। একটি গান বিশেষ প্রিয় ছিল তাঁর—
শিবরাত্রির পরের দিন
শিবের হল সর্দি-কাশি,
ঘটি ঘটি জল ঢেলেছে
জেঠি, কাকি, মামি, মাসি
তাই শিবের হল সর্দি-কাশি।
আদা দিয়ে চা করে
দুগ্গা এসে সামনে ধরে
‘সিদ্দি আনলে খেও না, বাপু’
বললে শিবে মুচকি হাসি
শিবের হল সর্দি-কাশি।
পর্দায় তুলসী চক্রবর্তীর একটি গানের দৃশ্য দেখার স্মৃতি উঠে এল সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায়। ছবির নামটা আর এখন মনে নেই অশীতিপর এই পাণ্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টার। তবে, দৃশ্যটি এখনও মনে, গেঁথে আছে তাঁর। বলছিলেন, ‘সম্ভবত ছবিটার নাম কাঞ্চনমূল্য। ছবিটায় তুলসী চক্রবর্তীকে বাঈজি সাজানো হয়েছিল। মেয়েদের মতো বিনুনি করা চুল, কী সুন্দর যে মানিয়েছিল। ঘাগরা দুলিয়ে চোখ টিপে টিপে যখন গাইছেন,
আমি কারে দেখিয়া দেব ঘোমটা
আহা নাতজামাই আমার ন্যাংটা
হলসুদ্ধু লোকের সেই দৃশ্য দেখে সে কী হাসি। আমি তখন বেশ ছোট। পরবর্তীকালে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি, মনে আছে, তখন একদিন টিভিতে এই ছবিটা দেখাচ্ছিল। সেদিন ছবিটা দেখার জন্য অফিস পর্যন্ত কামাই করেছিলাম।’ সাহিত্যিক ষষ্ঠীপদও হাওড়ার মানুষ। জন্মেছেন ষষ্ঠীতলার রামকৃষ্ণপুরে। ওঁর চার-পাঁচটি বাড়ির পরেই থাকতেন তুলসী চক্রবর্তী। কিন্তু শিশু বয়সে তুলসীকে যমের মতো ভয় পেতেন তিনি। সে কথাই বলছিলেন হাসতে হাসতে।
‘তখন আমার দু’-তিন বছর বয়স। দিদি হয়তো কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও হঠাৎ রাস্তায় দেখা তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে। পরনে ধুতি, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। আমি তো দিদিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগতাম। ওই রকম চেহারা, যাকে বলে একেবারে শাঁসে-জলে। বড় বড় গোল গোল চোখ নিয়ে যখন আয় আয় বলে হাত বাড়াতেন, তখন আর আমার মধ্যে সেন্স বলে কিছু থাকত না। প্রায় অজ্ঞান হয়ে যেতাম। কোনওক্রমে বাড়ির লোকজন আমাকে নিয়ে ফিরে আসত। অথচ ওর গিন্নিরও বেশ ভালো চেহারা ছিল। উনি যখন ডাকতেন আমি কিন্তু তখন তাঁর কোলে উঠে গলা জড়িয়ে ধরতাম। আর একটা ঘটনার কথাও খুব মনে পড়ে। তখন আমার সাত-আট বছর বয়স। তুলসী চক্রবর্তীকে তখনও আমি বেশ ভয় পাই। পারতপক্ষে ওঁদের পাড়াটা এড়িয়ে চলি। একদিন সকালে হল কি! হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড ষাঁড় আমাকে তাড়া করল। আর আমিও দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঢুকে পড়লাম তুলসী চক্রবর্তীর বাড়ি।