প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্য আসবে। প্রেম-প্রণয়ে আগ্রহ বাড়বে। তবে তা বাস্তবায়িত হওয়াতে সমস্যা আছে। লৌহ ও ... বিশদ
জন্ম বরিশাল, ১৯২৩-এর ১৪ সেপ্টেম্বর। বাবা ছিলেন অঙ্কের মাস্টারমশাই। সে যুগে এমএসসির ফার্স্টক্লাস। অঙ্কের মাস্টারির চাকরিটা বাবার হঠাৎ চলে গেল। ছেলেকে তাঁর উপদেশ, অঙ্ক নয়, পদার্থবিজ্ঞানে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জুটলেও জুটতে পারে! ’৪২-এর মন্বন্তর, আগস্ট আন্দোলন, প্রেসিডেন্সির পঠনপাঠন শিকেয় (১৯৪২-’৪৪ প্রেসিডেন্সি / কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন)। ডামাডোলে সপরিবার প্রত্যাবর্তন বরিশালেই। নির্মল নিষ্কলুষ মনোরম প্রকৃতি। নদনদী, ছায়াঘেরা গ্রাম, শ্যামলে শ্যামল আর নীলিমায় নীল। নেই কোথাও মন্বন্তরের বিলাপ, বিবমিষা। তারপর, হঠাৎ কী হল? নির্মোহ আত্মমগ্ন তিনি, অমলকুমার রায়চৌধুরী। অন্তরিন নিজের সুড়ঙ্গে। মন্বন্তর কী তাহলে ‘এ কে আর’-এর মনে এমন গভীর রেখাপাত করে গিয়েছিল যে সেই দুঃস্বপ্নের কালরাত্রি তাঁকে তাড়া করে ফিরল সতত। জ্যান্ত মুরগির জবাই, রক্তাক্ত ছটফটানি দেখে মুরগির মাংস জীবনে ছুঁয়েও দেখেননি। খেতে ভালোবাসতেন ভাজা তোপসে মাছ। পার্শে বা পাবদার ঝোল। দই, মিষ্টির প্রতিও ছিল আসক্তি। কেউ বলেছিল চিংড়ি জলের পোকা, পোকা খাওয়ার ভয়ে চিংড়িও সযত্নে পরিহার করেছিলেন।
তীর্থপতি হিন্দু হাইস্কুলে লেখাপড়া। একটা অঙ্ক গৎবাঁধা নিয়মের বাইরে আরও নানাভাবে যে কষা যায়, তা দেখিয়ে হেডমাস্টারের নেক-নজরে পড়ে যান। স্কুলের ম্যাগাজিনে সে কথা ফলাও করে ছেপে লাজুক ‘এ কে আর’-কে যথেষ্ট বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলেছিলেন হেডমাস্টারমশাই। একবার ম্যালেরিয়া পেড়ে ফেলল। গাদা-গুচ্ছের কুইনাইন সেবনে হৃৎস্পন্দন অনিয়মিত। মড়ার মতো বিছানায় পড়ে আছেন। নাড়ি অতলে। মা ঘরে ঢুকে আঁতকে উঠে চিৎকার করে কান্না জুড়লেন, ভেবেছিলেন ইহজগতের মায়া কাটিয়েছেন ‘এ কে আর’। ছেলেমেয়েদের বই পড়তে উৎসাহ দিতেন, বিদেশি ক্লাসিক্যাল সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। আর পাঁচটা বাঙালির মতো বেড়াতে ভালোবাসতেন। বহুবার গিয়েছেন পুরী, দার্জিলিং। মারা যাবার কিছুদিন আগেও গিয়েছিলেন মিরিক। জীবনভর শ্রীঅঙ্গে শোভা পেয়েছে ধুতি-পাঞ্জাবি। ধুতির কোঁচা পকেটে গোঁজা। মেরিল্যান্ড যাওয়ার সময়, বোধহয় একবারই সাহেবি কেতায় সুট টাই পরেছিলেন। বরাবরই পোশাকের প্রতি ছিলেন আদ্যন্ত নির্লিপ্ত, উদাসীন।
আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে যে সময়ে অমলকুমার গবেষণায় মজেছেন, সেইসময় আপেক্ষিকতাবাদের ভবিষ্যৎ মোটেই উজ্জ্বল ছিল না। এন আর সেন ছাড়া গবেষণায় সঙ্গী হিসাবে পাননি কাউকেই। নানারকম ঝড়ঝাপটা, অবসাদ কাটিয়ে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কালটিভেশন অব সায়েন্সে জোটালেন গবেষণা-সহকারীর চাকরি। কালটিভেশনের অধিকর্তা তখন মেঘনাদ সাহা। ১৯৫৩-র ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র নিয়ে দুরুদুরু বক্ষে ঢুকলেন মেঘনাদ সাহার ঘরে। উগরে দিলেন মাথায় বুড়বুড়িয়ে ওঠা চিন্তাভাবনার হিজবিজবিজ। শুনলেন ডঃ সাহা, অপ্রসন্নচিত্তে। দেবীদাস আচার্যের সঙ্গে গবেষণায় লেগে পড়ার উপদেশ দিলেন। হতোদ্যম ‘এ কে আর’। দেবীদাস তাঁর যোগ্য সঙ্গতকারী নন কখনওই। ঘাড় বাঁকা অমলকুমারকে তাঁর মনোমতো কাজ থেকে বিচ্যুত করা যে কঠিন স্বয়ং অধিকর্তাও তা হাড়েহাড়ে টের পেলেন। ডিক্রি জারি হল, অধিকর্তা বা বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া একপাও চলা নিষেধ ‘এ কে আর’-এর। ঝুপসি এক যন্ত্রপাতির রান্নাঘরে ঠাঁই হল অমলকুমারের। একটা মাত্র জানলা ঘরে। ঠা ঠা রোদে পিঠ পুড়ে যায় সারাদিন।
অনন্যোপায় অমলকুমার আশুতোষ কলেজে আংশিক সময়ের শিক্ষক হিসাবে যোগদানে বাধ্য হলেন। বিয়ে থা করেছেন, রোজগার দরকার। বিশ্ববন্দিত ‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’-এর জন্ম এই আশুতোষ কলেজ থেকেই। ‘ফিজিক্যাল রিভিউ’তে প্রকাশিত ১৯৫৫-র সেই গবেষণাপত্র, ‘রিলেটিভিস্টিক কসমোলজি ওয়ানের’ ধারে কাছেও এ পর্যন্ত কোনও একটি গবেষণা-সন্দর্ভ পৌঁছতে পারেনি। কালটিভেশনে কাজের অবসরে তিনি কেবল ভেবেছেন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাকি বিশ্ববিদ্যালয়— কোথায় বিজ্ঞানীরা একটু শান্তিতে নিজের মতো করে কাজ করতে পারবেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কাজের কাজ যে কিছুই হয় না, তাও তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন। মৌলিক গবেষণার আঁতুড়ঘর সবসময়ই বিশ্ববিদ্যালয়। আশ্চর্যের বিষয় কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানও তাঁকে কোনওদিন ডাকেনি। বিশ্বখ্যাত গণিতবিদ অধ্যাপক কলস্বন তখন অক্সফোর্ডে পড়াচ্ছেন। তাঁর ছোট্ট একটি ভুল ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ’ মারফত সহজেই শোধরানো সম্ভব হয়েছিল। আনন্দে উদ্বাহু কলস্বন একটি প্রবন্ধে বার-দশেক এ কে আরের ভূয়সী প্রশংসা করে তাঁর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন। নিস্পৃহ, দূরদ্বীপবাসী তিনি কালটিভেশনের রান্নাঘরে একাগ্র চিত্তে তখন কাজে মগ্ন।
বিয়ের কথাবার্তা চলছে, পাত্রীর দাদা জানতে চাইলেন চাকরিতে মাইনেপত্র বাড়বে কি না, উন্নতির সম্ভাবনাই বা কতটা? নির্বিকার চিত্তে অমলকুমার উত্তর দিয়েছিলেন, মাইনে বাড়বে কি না বা কতটা উন্নতি হবে, তা তিনি বলতে পারবেন না। তবে ভারতে তাঁর কাজের সমকক্ষ কেউ নেই। নিজের ওপর এমনই তাঁর অগাধ আত্মবিশ্বাস! বিদেশে তখন ‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’ নিয়ে রীতিমতো হইচই চলছে। দেশে তাঁর খবর কেউ রাখেন না। অসীম সাহসে ভর করে তিনি ‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’কে পাঠালেন ডিএসসি থিসিসের জন্য। জন আর্কিবল্ড হুইলার ছিলেন তাঁর পরীক্ষক। উচ্ছ্বসিত হুইলার লিখলেন রায়চৌধুরী ‘রিলেটিভিস্টিক কসমোলজি’র দুরূহ এক সমস্যার চমকপ্রদ সমাধান করেছেন। বয়স ষাট পেরিয়েছে, এই অজুহাতে ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি’ তাঁকে সদস্যপদ দিতে বিস্তর টালবাহানা করছিল। জয়ন্তবিষ্ণু নারলিকার, তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলেন সারা পৃথিবী যে বিজ্ঞানীর দৃঢ়তায় নত তাঁকেও কি সায়েন্স অ্যাকাডেমির যোগ্যতামান পেরনোর পরীক্ষায় বসতে হবে? তারপরে অবশ্য সসম্মানে তাঁকে সায়েন্স অ্যাকাডেমির সদস্যপদ প্রদান করা হয়েছিল।
রায়চৌধুরী সমীকরণ ও সৃষ্টিতত্ত্ব
বিশ্বের সৃষ্টি একটা বিন্দু থেকে, যে বিন্দুটা কিন্তু মোটেই কাল্পনিক নয়। সেই বিন্দু বা ‘সিঙ্গুলারিটি’র কথা প্রথম বলেছিলেন বিজ্ঞানী সোয়ারসচাইল্ড। কিন্তু সোয়ারসচাইল্ডের সিঙ্গুলারিটির কিছু গোঁজামিল আইনস্টাইনের চোখেও ধরা পড়েছিল। ‘সিঙ্গুলারিটি’ কী, একটু খোলসা করা যাক। ধরা যাক একটা তুবড়ি বসানো রয়েছে, আগুনের স্পর্শে তুবড়ি প্রথমে ভুস-ভুস করে দু’একটা স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে ছড়াতে নারকেল গাছের মাথা টপকে গেল। প্রতিটা রশ্মি একটা বিন্দু থেকে উৎসারিত হয়ে বৃত্তাকার বা অধি-বৃত্তাকার পথে বহু উঁচুতে উঠে নির্বাপিত হল। তুবড়ির মতো একটা বিন্দু থেকেই শুরু হয়েছিল বিশ্বসৃষ্টি। বিরাট ভর ও অপরিমেয় শক্তি একটা বিন্দুতে আসীন। তুবড়ির মতো ভুস-ভুস করে বিশ্ব ফুলে ফেঁপে উঠতে শুরু করলেও তুবড়ির মতো মসৃণ নিরুদ্বিগ্ন পথে কিন্তু তার যাত্রা শুরু হয়নি। বিন্দু-বিশ্ব, সৃষ্টির মুহূর্তে ফুলে ফেঁপে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছে, বনবন করে ঘুরতে শুরু করেছে। বিশৃঙ্খলা/ অনিয়মে জেরবার লণ্ডভণ্ড হয়েছে বিশ্বসৃষ্টির আদি-মুহূর্ত। তারপর নটরাজের প্রলয়নাচন থামলে অজস্র গ্রহ-নক্ষত্র-ছায়াপথ-কৃষ্ণগহ্বর বুকে আঁকড়ে থিতু হয়েছে আজকের বিশ্ব।
অনিয়মিত উচ্ছৃঙ্খল সৃষ্টি রহস্যকে আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বে ঠিকঠাক কব্জা করা যাচ্ছিল না। নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না যে, মহাকর্ষের মধ্যেই নিহিত কি না বিশ্বসৃষ্টির অজানা রহস্য। কিছুতেই বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে যাচাই করা যাচ্ছিল না, একটা বিন্দুর মধ্যে কীভাবে নিহিত থাকতে পারে বিপুল ভর আর শক্তির মেলবন্ধনী অমিতপরাক্রমী এক দানব? কার অঙ্গুলিহেলনেই বা লিলিপুট ‘সিঙ্গুলারিটি’ থেকে ফুলে-ফেঁপে উঠে সৃষ্টি হল এই মহাবিশ্ব? দুরূহ এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না ‘রিমানিয়ান জ্যামিতি’। উত্তর মিলল না এমনকী ‘ওপেনহাইমার-স্নাইডার’ বা ‘ফ্রিডম্যান-রবার্টসন-ওয়াকর’ মডেলেও। ‘রায়চৌধুরী সমীকরণ’ এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ বাতলাল। ‘রিকি কার্ভেচারের’ সাহায্যে ‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’ প্রমাণ করল আপেক্ষিকতাবাদের মধ্যেই ঘাপটি মেরে বসে খিলখিলিয়ে হাসছে ‘সিঙ্গুলারিটি’। মহাকর্ষের ইন্ধনেই অকল্পনীয় শক্তি ও ভরের প্রায়-অদৃশ্য মিলনবিন্দু ‘সিঙ্গুলারিটি’ থেকে নাচতে নাচতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে বিশ্ব। সেই মহাকর্ষের প্রভাবেই সূর্যের তুলনায় বহুগুণ বড় একটি নক্ষত্রও বুড়ো-বয়সে তার দাপট হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যখন মৃত্যুমুখে পতিত তখন তার বিশাল ভর-শক্তি এসে জড় হয় সেই সাড়ে তিনহাত ভূমি ‘সিঙ্গুলারিটি’তে। সৃষ্টির মাহেন্দ্রক্ষণের সিঙ্গুলারিটি আর ব্ল্যাকহোলের অন্তর্জলি যাত্রার সিঙ্গুলারিটির মধ্যে ফারাক নেই কোনও। সেই সিঙ্গুলারিটিই ‘বিগ ব্যাং’ নামে পরিচিত। যে মুহূর্তে মৃত্যুঘণ্টা বাজল বিশালকায় কোনও নক্ষত্রের, ব্ল্যাকহোলের জন্মও সেই মুহূর্তেই। ঠিক তখনই স্থান-কালেরও অগস্ত্যযাত্রার শুরু।
‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’-এ সৃষ্টিরহস্য আর কৃষ্ণগহ্বরের ‘সিঙ্গুলারিটির’ প্রথম সঠিক সঠিক দিশা মিলল। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক সিঙ্গুলারিটির মৌলিক আবিষ্কারক হিসাবে নোবেলে কেন বিবেচিত হবে না অমলকুমারের নাম? পেনরোজ তো ‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’ ধার করেই নোবেল পুরস্কার পেলেন! ‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশনের’ পর অমলকুমার ‘স্পেস-টাইম সিঙ্গুলারিটি’ নিয়ে আর বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। তখন তাঁর মাথায় চেপেছে ‘স্পেস-টাইমের’ অস্তিত্ব ছাড়াই ‘সিঙ্গুলারিটির’ তত্ত্বতালাশের ভূত। শুধু ‘সিঙ্গুলারিটি’ নিয়ে পড়ে থাকলে নোবেল হয়তো তাঁর কপালেই জুটত!
রায়চৌধুরী-হকিং-পেনরোজ ও ব্ল্যাকহোল
১৯৮৭ সালে প্রথম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে এ কে আরের সঙ্গে মোলাকাত হয় পেনরোজের। সাদামাটা ধুতি-পাঞ্জাবিতে এ কে আর-কে দেখে পেনরোজ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি এই সেই মানুষ। অমলকুমারের ‘সিঙ্গুলারিটির’ উপর ভর করেই হকিং-পেনরোজ আপেক্ষিকতাবাদের কুয়াশা সরিয়ে যবনিকাপাত করেছেন সৃষ্টি-রহস্যের, উদ্ঘাটন করেছেন ব্ল্যাকহোল মহাকর্ষজনিত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। প্রমাণ করেছেন, ব্ল্যাকহোলের পেট থেকে কোনও তথ্য তো দূরঅস্ত, আলোকেও ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। গিলে ফেলা সেই আলোকরশ্মিও ব্ল্যাকহোলের পেট চিরে কিছুতেই বেরতে পারবে না। হকিং তখন কেমব্রিজে, দ্বিতীয়-বর্ষের ছাত্র। গণিতের বিশেষ উচ্চমার্গের শাখা ‘টপোলজি’র এক নিখুঁত গণনায় হকিং প্রথম ব্ল্যাকহোলের স্পষ্ট ছবি আঁকলেন। হকিংয়ের কাজে সাহায্য করছেন জর্জ এলিস। ‘সিঙ্গুলারিটি’ সম্পর্কে রজার পেনরোজের গাণিতিক মডেল হঠাৎই নজরে এল হকিং-এর। ‘মোর্স থিওরি’র সাহায্যে পেনরোজের মডেলের যাবতীয় ত্রুটি শুধরে হকিং খাড়া করলেন ‘সিঙ্গুলারিটি’ বা ‘বিগ ব্যাং’ তত্ত্ব। পেনরোজ নিজে বলছেন, হকিং আমার তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে এমন এক শৌভিক তত্ত্বের বিনির্মাণ ঘটাল যে, পদার্থবিজ্ঞান তো কোন ছার গণিতেও কেউ কখনও তার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারেনি’ হকিংয়ের সেই নতুন বিগ ব্যাং সিঙ্গুলারিটি তত্ত্বে রিমানিয়ান জ্যামিতি, আপেক্ষিকতাবাদের যাবতীয় সংশয়-সন্দেহের কালোমেঘ যেমন উড়ে গেল এক লহমায়, তেমনই জলের মতো সহজ সরল হয়ে গেল সৃষ্টিরহস্য। এ প্রসঙ্গে পেনরোজ আরও এক ভারতীয় বিজ্ঞানীর কথা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছেন, তিনি এস চন্দ্রশেখর।
কিন্তু ব্ল্যাকহোলের অদ্ভুত আচরণের কথা তখনও অজানা। হকিং প্রথম সফলভাবে ব্যাখ্যা করলেন কেন ব্ল্যাকহোলে সর্বক্ষণ তুমুল অস্থিরতা বিরাজমান! থার্মোডিনামিক্স আর কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে অস্ত্র করে হকিং ব্ল্যাকহোলের যাবতীয় তমসা দূর করলেন। এই অস্থিরতা বা ‘এনট্রপি’ যে ব্ল্যাকহোলের মজ্জায় তাও দেখালেন। ১৯৭২ সালে হকিং উপর্যুপরি এই ধরনের অভ্রংলিহ কাজে চমকে দিচ্ছেন গোটা বিশ্বকে। ব্ল্যাকহোল ঘূর্ণায়মান হোক বা নিশ্চল, হকিং দেখালেন বিকিরণ তার নিয়তি। ‘হকিং রেডিয়েশন’ নামে যা পরিচিত। ব্ল্যাকহোলের পাঁচিল বা হরাইজনের কথাও হকিং প্রথম বলেছিলেন। যে পাঁচিল টপকে আলো একবার ব্ল্যাকহোলের পেটে গিয়ে পড়লে তারও ঘটবে সলিলসমাধি। হকিংয়ের যুগান্তকারী আবিষ্কার— আলোই যখন ব্ল্যাকহোলে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে চিরতরে, তাই কোনও জাগতিক বস্তুকেই আর ব্ল্যাকহোলের পেটের ভিতর থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব। ব্ল্যাকহোলের গর্ভ থেকে কোনও তথ্য কোনওভাবেই পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়। সেটিই ‘ইনফরমেশন লস’। সেইসময় আইনস্টাইনীয় E=m, অর্থাৎ ভর ও শক্তি তখন এক ও অভিন্ন।
‘সিঙ্গুলারিটি’কে যথাযথ বোঝাতে গিয়ে হকিং-জেমস হার্টেল যৌথভাবে ঘোষণা করলেন ‘নো বাউন্ডারি’ প্রপোজাল। উদাহরণ হিসাবে বললেন, উত্তরমেরুতে দ্রাঘিমাংশের খাতায়কলমে অস্তিত্ব থাকলেও তা সোনার পাথরবাটি। ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে স্থান-কালও সেইরকম। তত্ত্বে আছে, কিন্তু খালি চোখে অদৃশ্য। বিকিরণের ঠেলায় ব্ল্যাকহোল যখন মহাকাশে একটি ভাসমান বিন্দু, তখন বিপুল ভর-শক্তির অভূতপূর্ব চাপে বিস্ফোরণ স্বাভাবিক। কিন্তু পৃথিবী থেকে সেই বিস্ফোরণের আঁচ মেলে না। হকিং ভেবেছিলেন সেই বিস্ফোরণ টেলিস্কোপের সাহায্যে তিনি নিশ্চয়ই প্রত্যক্ষ করবেন কোনওদিন। কিন্তু তাঁর সে আশা অপূর্ণই থেকে গিয়েছিল। ২০২০-র আর এক নোবেলজয়ী, আন্দ্রে ঘেজ ব্ল্যাকহোলের সেই বিস্ফোরণকে গভীর অভিনিবেশে প্রত্যক্ষ করে বাগিয়ে নিলেন নোবেল। গত ১৬ বছর ধরে ‘মিল্কি-ওয়ের’ মাঝখানে একটি দৈত্যাকার ব্ল্যাকহোলের গতিবিধি নিবিষ্ট চিত্তে ঘেজ পর্যবেক্ষণ করছিলেন ৪ ও ৮ মিটার ‘গ্রাভিটি টেলিস্কোপে’। ‘এস-টু’ নামে একটি নক্ষত্র যখন ব্ল্যাকহোলের অভিকর্ষের টানে ব্ল্যাকহোলটিকে কেন্দ্র করে প্রদক্ষিণরত, তখনই ঘটল সেই অত্যাশ্চর্য ঘটনা। নক্ষত্রের আলো বেঁকে ব্ল্যাকহোলের পেটের মধ্যে ঢুকে গেল। পৃথিবী থেকে তা স্বচক্ষে দেখলেন ঘেজ। এ কে আর-আইনস্টাইন-হকিং অলক্ষে হাততালি দিয়ে উঠলেন। কারণ তাঁদের কথাই যে ঠিক তার অব্যর্থ প্রমাণ মিলল।
পেনরোজ, ‘দি গার্ডিয়ানে’ হকিং সম্পর্কে এক স্মৃতিচারণে লিখছেন—হকিংয়ের আশেপাশে সবাই লিলিপুট। ৩২ বছর বয়সে, রয়েল সোসাইটির সর্বকনিষ্ঠ ফেলো। আইজ্যাক নিউটনের ৩১০ বছর পর কেমব্রিজের ‘লুকাসিয়ান প্রফেসর’। ওই অতলস্পর্শী প্রতিবন্ধকতা নিয়ে হকিং নেমে যাচ্ছেন খনির গভীরে। নাসার ‘জিরো গ্রাভিটি’তে মহাকাশচারীদের মতো ভেসে থাকছেন। কথা বলতে পারছে না, অথচ বনবন করে হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে গোল্লাছুট খেলছেন। একবার এক ছাত্র ভুলভাল তর্ক জুড়েছে, তিতিবিরক্ত হকিং ছাত্রের পায়ের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিল হুইলচেয়ার। যে হকিং কোনওদিন তাঁর পূর্বসূরি কোনও বিজ্ঞানীর কাছে ঋণস্বীকারে ছিলেন অনিচ্ছুক, তিনিই ‘রায়চৌধুরী ইক্যুয়েশন’ সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত, প্রণত। নোবেলের থেকে সেটা কী কোনও অংশে কম প্রাপ্তি?