মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
নারীদিবসে লাল গোলাপি বেলুন ভালো, বিশেষ ছাড়ে গয়না কেনা ভালো, জামাকাপড়ে ঝাঁ চকচকে হওয়া ভালো। আমরা জানি জামাকাপড় এখন দেশের সব প্রান্তে মোটামুটি এক। তরুণীরা গ্রামীণ হোক বা শহুরে, তাঁদের রঙিন কুর্তি লেগিং আমাদের বলে দেয় সচেতন এক প্রজন্মের হাতে এখন ব্যাটন। যেমন হাতে হাতে স্মার্টফোন আর রাশি রাশি সেলফি বলে দেয় আমরা পৌঁছে গিয়েছি একবিংশ শতকে।
কিন্তু সত্যিই পৌঁছেছি কি? ধরে নেওয়া হয়, ভারতের গ্রামীণ জনসংখ্যার ৭০ শতাংশের মধ্যে অর্ধেকই নাকি নারী! যদিচ নারীর সংখ্যা বা পুরুষ-নারীর অনুপাত ক্রমশ কমে আসার পিছনে নানারকমের কারণের কথা তো আমরা জানিই— ভ্রূণহত্যা থেকে শুরু করে সদ্যোজাত কন্যাসন্তানের অপুষ্টি আর অনাদর। তবু এই ভারত জাগছে।
‘বেটি বাঁচাও’-এর বড় বড় হোর্ডিংয়ের নীচেই হয়তো ঘটে যাচ্ছে একটি বিশাল ধর্ষণকাণ্ড, একটি গুমখুন। পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একটি মেয়েকে, পুলিস কেসের আগেই, এক বা একাধিক ক্ষমতাবানের নির্দেশে। অথবা বিয়ের নামে তাদের নিয়ে ফেলা হচ্ছে কোনও বেশ্যালয়ে। র্যাকেট চলেছে মেয়ে পাচারের। কিন্তু এসব গল্পের পরেও গ্রামের মেয়েরা স্কুটি চেপে বেরচ্ছে। সাইকেলে চড়ে বিনুনি বা চুল উড়িয়ে ইশকুলে চলেছে। অন্যদিকে বিপরীত এক চিত্র অনুযায়ী আমরাও এও দেখি, কর্মস্থল অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি থাকছে না মহিলা কর্মীদের গ্রহণ করতে।
কিছুদিন আগে একটি বিজ্ঞাপন প্রায়ই দেখা যেত, ‘যেখানে ভাবনা সেখানেই শৌচালয়’। ছবির জগতের নায়িকাকে কাজে লাগিয়ে গ্রামীণ পরিবারদের তেতো ওষুধ গিলিয়ে দিতে চাইত সরকার। গ্রামীণ যে পরিবারগুলি তৈরি হয়ে উঠছে রুপোলি পর্দায় তারা যতই অবাস্তব হোক, পরিস্থিতিটি বাস্তব বইকি। একটি মেয়ে এক হাত ঘোমটা দিয়ে যাবে শ্বশুরবাড়ি। রাতে তার ‘বাইরে যাওয়ার’ প্রয়োজন হলে সেই ঘোমটা হয়ে যাবে অর্থহীন। এটাই বলছেন বিদ্যা বালান। আশ্চর্য একটা গল্প রচনা করা হল! দুঃখের বিষয়, এই রুপোলি পর্দায় নির্মিত বয়ানটা যেন আরও বেশি করে মেয়েদের পর্দানশিনতা বা ঘোমটার ভেতরে ঠেলে দিতে চাইল। আমরা কি আমাদের স্কিমগুলোকে এর চেয়ে বেশি ভালো করে উপস্থাপনা করতে পারি না?
শৌচালয় বাড়িতে বাড়িতে কেন দরকার, মেয়েদের বাস্তবতার সঙ্গে কেন তা যুক্ত? এর পিছনে আছে আরও তেতো, আরও ভয়ঙ্কর একটা গল্প। আজও কাগজ খুললেই ভারতের গ্রামাঞ্চলের যত ধর্ষণের ঘটনা পড়তে পাই, তার অধিকাংশই ঘটেছে গভীর রাতে বা ভোরের দিকে। সুতরাং শৌচালয় তৈরি করে ২০১৯-এর মধ্যে সারা ভারতের একটিও গৃহকেও শৌচালয়হীন না রাখার যে প্রকল্প তা অত্যন্ত জরুরি।
কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন শুধু শৌচালয় তৈরিতে কি সত্যিই আসবে? কেহ নাহি জানে। ভারতের নানা জায়গায়, উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশে, মেয়েদের ‘বাইরে যাওয়া’ অর্থাৎ শৌচকর্মের জন্য বেরনো বন্ধ করতে একটিই যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, ঘুরিয়ে তা মেয়েদের ঠেলে দিচ্ছে আরও অন্ধকারের দিকে। বাড়ির মেয়ে বউকে বাইরে পাঠাবেন কেন, বাড়িতে শৌচালয় বানান। পর্দানশিনদের পর্দায় রাখুন, বাথরুমটাও আড়ালে থাকলে আব্রু থাকবে মেয়েদের।
এই ঢাকাচাপার সংস্কৃতিতে, আসলে মেয়েদের রক্ষা করার জন্য শুধু শৌচালয় নির্মাণই যথেষ্ট নয়। কারণ ধর্ষকের মানসিকতা পাল্টায়নি। বাজারে যাওয়ার পথে, একা কাজে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে, অন্য আরও নানা জায়গায় একটি মেয়ের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা তো ঘটেই চলবে। সবকিছু বন্ধ করতে হবে? মেয়েদের অবাধ চলাফেরা চলবে না? মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরনোই বন্ধ! এই কি একমাত্র উপায়, ধর্ষণ বন্ধ করার?
২০১১ সালের জনগণনা দেখিয়েছিল, দেশের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষের শৌচালয়ের সুবিধা নেই। কিন্তু দেশের পঞ্চাশ শতাংশ মানুষের কাছে মোবাইল ফোনটি আছে। মোট তিপ্পান্ন শতাংশ গৃহে শৌচালয় বানানো হয়নি, আর শুধু গ্রামাঞ্চলের কথা ধরলে এই সংখ্যাটা প্রায় সত্তরের কোঠায় চলে যাবে। উন্মুক্ত শৌচকর্ম থেকে যে ধরনের জীবাণুঘটিত সংক্রমণের সম্ভাবনা, তা কিন্তু পুরুষ নারী নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের পক্ষেই বিপজ্জনক। একটি জটিল সমস্যাকে যুঝতে চাওয়া হচ্ছে শৌচালয় ব্যবহারের বার্তা না দিয়ে, শৌচালয় তৈরির বার্তা দিয়ে। তাও একটা সামাজিকভাবে ভুল বার্তা দিয়ে। শুধু মেয়েদের জন্য নয়, শৌচালয় সবার জন্যই দরকার। শৌচালয় তৈরির স্কিম সঠিক, কিন্তু এই স্কিমের প্রচারের ভাবনা ভুল। অনেক সময়ে এমনও হয়, স্কিম হয়তো অগ্রগামী ভাবনা থেকে তৈরি হল। বলা হল মেয়েদের পড়ানোর ও স্বনির্ভর করার জন্য টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দাঁড়াল কি? সে টাকা শেষমেশ মেয়েদের বাবা মা কিংবা পরিবার বিয়ে দেওয়ার পণ হিসেবে ব্যবহার করল! আবার এমন স্কিমও আসে, যা ভাবা হয়েছে মেয়েদের বিয়ের খরচকে মাথায় রেখে। আপাতভাবে প্রকল্পের উদ্দেশ্য সাধু মনে হলেও এই সিদ্ধান্ত আদতে মেয়েটির পরিবার কতটা কাজে লাগাচ্ছে সেটা খতিয়ে দেখতে হবে। মেয়েকে পরিবারের দায় বলে মনে করার যে সংকীর্ণ মানসিকতা, সেই ভাবনাই যদি বেঁচে থাকে, তাতে কোনও সুরাহার পথ মিলবে কি?
আসলে নতুনের হাত ধরতে অনেক পরিশ্রম। তাই, বারবার নতুন ভারতের বুকে এই সব প্রশ্ন উঠে পড়ে।