মেয়াদি সঞ্চয় থেকে অর্থাগম যোগ আছে। সন্তানের আবদার মেটাতে অর্থ ব্যয়। ধর্মকর্মে মন আকৃষ্ট হবে। ... বিশদ
সেই অচলায়তন ভাঙার সাহস দেখিয়েছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ ছেলেই। নারীমুক্তির পথিকৃৎ হতে চেয়ে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর মুক্ত হাওয়াকে নিজের পরিবারের অন্দরে বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে মুক্ত হাওয়ার প্রথম ফসল সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী। অন্তঃপুরের পর্দার আড়াল সরিয়ে স্বামীর সঙ্গে অনাত্মীয়দের সামনে আসা তিনিই ঠাকুর পরিবারের প্রথম বধূ।
বিলেত ফেরত প্রথম ভারতীয় আইসিএস সত্যেন্দ্রনাথ পত্নীকে নিয়ে যাবেন কর্মস্থল বোম্বেতে। এ যেন এক বিপ্লব! কিন্তু এবার প্রশ্ন উঠল, মেজ বউ কী পোশাক পরে বাইরে যাবেন? ঘরের কোণে বন্দি মেয়ে-বউদের পোশাক নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি এত দিন। সেই সময়ে অন্তঃপুরের মেয়েরা কেবল একটি কাপড়ে শরীর ঢেকে রাখত। সত্যেন্দ্রনাথ ছুটলেন কলকাতার এক ফরাসিদের দোকানে। ফরমাশ দিয়ে কিম্ভূতকিমাকার এক পোশাক বানালেন। যাকে বলে ওরিয়েন্টাল। কিন্তু, ‘সেটা পরা এত হাঙ্গামা হতো যে ওঁকে পরিয়ে দিতে হতো, আমি পারতুম না। দুচারখানা শাড়িও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম।’ লিখেছেন জ্ঞানদানন্দিনী। যে বাড়ির বউরা তখনও আস্ত পালকি সুদ্ধ গঙ্গার জলে ডুব দিত, সেই বাড়ির বউ জ্ঞানদানন্দিনী জাহাজে চেপে চললেন মহারাষ্ট্র।
বোম্বে গিয়ে জ্ঞানদানন্দিনী মানেকজি করসেদজি নামে সম্ভ্রান্ত এক পার্সি পরিবারের সঙ্গে কয়েক মাস ছিলেন। সেখানে লক্ষ্য করলেন, পার্সি পরিবারের মেয়েরা শাড়ির আঁচল ডান কাঁধের উপর পরে। দারুন তো! ‘পরে আমি সেটা বদলে আমাদের মতো বাঁ কাঁধে পরতুম।’
কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরা কিংবা বাঁ দিকে আঁচল জ্ঞানদানন্দিনীই প্রথম ঠাকুরবাড়িতে আমদানি করেন। সেই সঙ্গে শাড়ির সঙ্গে যে দিব্য মানানসই জ্যাকেট পরা যায়, আর সেই পোশাকে লেসের ব্যবহার প্রথম শুরু করেন জ্ঞানদানন্দিনী। শাড়ির সঙ্গে সেমিজ-ব্লাউজ পরাও তিনি চালু করেন। একসময় জ্ঞানদানন্দিনী খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনও দিতেন। তাঁর শাড়ি পরার ধরনের নাম ছিল ‘বোম্বাই দস্তুর’। যা পরিচিত হল, ‘ঠাকুরবাড়ির শাড়ি’ পরার স্টাইল নামে। সেটাই ছিল বাংলার মেয়েদের প্রথম ফ্যাশন বিপ্লব!
পালকিতে চেপে ঠাকুরবাড়িতে যে মেজ বউ বোম্বে গিয়েছিলেন, দু’বছর পর তিনিই হয়ে উঠেছিলেন প্রথম ভারতীয় রাজকর্মচারীর ঘরনি। ইংরেজ সাম্রাজ্যের ক্ষমতার অলিন্দের বাসিন্দা। ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে অপরূপ বেশবাসে, পায়ে জুতো ও বিলিতি মোজা পরিহিতা যে নারী ঠাকুরবাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন, তার সঙ্গে দু’বছর আগের ভীতসন্ত্রস্ত মেয়েটির আকাশ-পাতাল তফাৎ। স্বর্ণকুমারী দেবী লিখেছেন, ‘ঘরের বৌকে মেমের মতো সেদিন গাড়ি হইতে নামিতে দেখিয়া সেদিন বাড়িতে যে শোকাভিনয় ঘটিয়াছিল তাহা বর্ণনার অতীত।’ অন্তঃপুরে অধিকাংশ নারী তাঁর সঙ্গ বর্জন করেন। একঘরে করা হয় তাঁকে। স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখা থেকে জানা যায়, সে সময় বাড়ির অন্যান্য মেয়েরা বউঠাকুরাণীর সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করতে বা মিশতে ভয় পেতেন। জ্ঞানদানন্দিনীকে গ্রহণ না করলেও তাঁর শাড়ি পরবার অভিনব ভঙ্গিমাটি কিন্তু আপন করে নিয়েছিলেন সবাই। সময়কে অতিক্রম করা আধুনিকার আখ্যান তখন মুখে মুখে।
আজন্ম লালিত সংস্কার ভেঙে অন্তঃপুরের দুয়ারটুকু পার হতে অনেক ভয়, অনেক লজ্জা ও ঘৃণা সয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন রবির মেজবৌঠান। জ্ঞানদানন্দিনী নিজের সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলার নারী সমাজের সামনে খুলে দিয়েছিলেন নতুন জীবনের দরজা। তিনি ছিলেন প্রথা ভাঙার পথিকৃৎ তথা নতুন প্রথার প্রবর্তকও।
বিদেশে যাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ বোম্বেতে তাঁর কাছ থেকেই পাশ্চাত্য রীতি-রেওয়াজ শিখেছিলেন। মেজবৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী হয়ে উঠেছিলেন ১৮ বছরের রবীন্দ্রনাথের অভিভাবক। কবির জন্য মৃণালিনীকে যশোর থেকে খুঁজে এনেছিলেন জ্ঞানদাই। বাঙালি জনমানসে দু’টি জিনিসের প্রবর্তন করেন তিনি। একটি, সান্ধ্যভ্রমণ ও অন্যটি জন্মদিন পালন। এছাড়াও যৌথ পরিবারের বাইরে আধুনিক ছোট পরিবারের ছকটি জ্ঞানদানন্দিনীই চালু করেন। আজ ঠাকুরবাড়ির বউ-মেয়েদের যতগুলি ছবি পাওয়া যায়, তার পেছনেও কৃতিত্ব আছে এই মহিয়সী নারীর। বর্ন অ্যান্ড শেপার্ড নামে একটি কোম্পানির কাছে ফটোগ্রাফি শিখেছিলেন তিনি। ঠাকুরবাড়ির মেয়ে-বউদের শাড়ি পরিয়ে নিজেই সে ছবি তুলে তা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।
জ্ঞানদানন্দিনী নারী জাগরণের ঊষালগ্নের অন্যতম কিরণ। তাঁর হাত ধরেই বাঙালি নারী ঘর থেকে বাইরের জগতে পা দিয়ে শিখেছিল নতুন আদবকায়দা। আটপৌরে ভাঁজ থেকে বের হয়ে শাড়ি পড়েছিল কুচি দিয়ে। সঙ্গে বরাঙ্গে উঠেছিল বোতাম জোড়া গা ঢাকা ব্লাউজ। কর্মজগতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে বাঙালি নারী পেয়েছিল মার্জিত পোশাক রীতি। তবুও এ সমাজে আধুনিকতার সংজ্ঞার জন্য জ্ঞানদানন্দিনীরা অপেক্ষা করেননি। ঠাকুরবাড়ির মেজ বউঠাকুরাণী তাই হয়ে গিয়েছেন উদাহরণের মতো। জ্ঞানদানন্দিনীর সঙ্গে সভ্যতা থাকুক বা না থাকুক, সভ্যতার ইতিহাস আজও ঠিক রয়ে গিয়েছে।
তথ্যসূত্র: ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহল, চিত্রা দেব