বদমেজাজ ও কঠিন ব্যবহারে ঘরে-বাইরে অশান্তি ও শত্রুতা। পেট ও বুকের সংক্রমণে দেহসুখের অভাব। কর্মে ... বিশদ
এই আকাশ ঝলসানো রোদ তো এই কালো মেঘের সজল বর্ষণ। আবহাওয়ার খামখেয়ালি যেন বড্ড পেয়ে বসেছে এবছর। তবু তারই মধ্যে মাঝে মাঝেই এক মুখ হাসি নিয়ে ফুটে উঠছে ঘন নীল আকাশ। আর তাতে সাদা মেঘের কারুকাজ। আকাশে মেঘ আর রোদের খেলা দিব্য জানান দিচ্ছে পুজো আসছে। আর পুজো মানেই তো সারাদিন টইটই ঘোরাঘুরি। সবান্ধব আড্ডা, খাওয়াদাওয়া, হইহই। ওহ্, কেনাকাটা, সাজগোজ আর নতুন জামার কথাই বলা হল না যে! হ্যাঁ, পুজো মানেই নতুন জামা। সারা বছর অপেক্ষার অবসান হয় চারদিনের চুটিয়ে আনন্দের মাধ্যমে। বছরের ওই ক’টা দিন মন মেতে ওঠে এক অনাবিল ভালোলাগায়। কোভিড আতঙ্ককে ছাপিয়ে যায় সেই ভালোলাগা, সেই আনন্দ। তাই তো পুজোয় চাই নিত্যনতুন সাজ। আর পুজোর সম্ভারে ড্রেস ক্রমশ অনবদ্য অংশ হয়ে উঠছে।
বছর পঁচিশ আগের কথা, পুজোর জামা তখন শুধুই বালিকা আর কিশোরীবেলার সঙ্গী। নকশার টুকটাক অদল বদলে তা বাচ্চা থেকে টিনএজারদের জন্য লাগসই হয়ে উঠত। তারুণ্যের সাজে তখন রং নিয়ে আসত নতুন শাড়ির গন্ধ। ব্লাউজে সামান্য লেস, ফ্রিল, এমব্রয়ডারি বা অ্যাপ্লিকের কাজের সঙ্গে অতি সাধারণ ডুরে শাড়িটিও অসাধারণ হয়ে উঠত। পুজোয় অবশ্য সুতির পাশাপাশি সিল্ক, তসর ইত্যাদি নানা ফেব্রিকের স্থান ছিল। এমন সময় আস্তে ধীরে ঘটল বিশ্বায়ন। ফ্যাশনের সংজ্ঞাটাই ক্রমশ বদলে যেতে লাগল তার হাত ধরে। সাজগোজে লাগল পাশ্চাত্যের ছোঁয়া। আর সেই ছোঁয়ায় সাজের ধরন একটু একটু করে বদলে যেতে শুরু করল। শাড়ির বদলে তারুণ্যের সাজে দেখা দিল জিনস, টপ এমনকী ড্রেসের আধিক্য। ফ্রক আর এখন শুধুই বাল্য ও কৈশোরের অঙ্গেই সীমাবদ্ধ নেই। তা তরুণীদের হাত ধরে ক্রমশ এগিয়ে চলেছে। আর এখন তো যুবতী বা সদ্য প্রৌঢ়ত্বেও মহিলারা অনায়াসে ফ্রক গলিয়ে সাজ সম্পূর্ণ করছেন। অবশ্যই সেই পোশাকের গালভারী নাম হয়েছে ড্রেস। নকশার দিক দিয়েও এসেছে নানা পরিবর্তন। কোথাও পাশ্চাত্যের প্রভাব ঘোরতর। কোথাও বা সেই প্রভাবের সঙ্গেই মিশেছে প্রাচ্যের স্বাদ। দুইয়ে মিলে তৈরি হয়েছে ফিউশন। এবছর পুজো ট্রেন্ড কী বলছে? ড্রেসের নকশা এখন কেমন? রং-ই বা কীরকম? এমনই বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর উঠে এল কলকাতার কয়েকজন ডিজাইনারের কথায়।
খাদি ইন্ডিয়ার জন্য পোশাক তৈরি করেন ঐশী গুপ্ত। বললেন, এবছর দারুণ ট্রেন্ড এসেছে পুজোর ভাবনায়। অবশেষে লোকে একটু আধটু বেরতে শুরু করেছে। আর সেই জন্যই নিজেদের তারা নতুনভাবে, নবরূপে সাজিয়ে তুলতে চাইছে। এবছর পুজোর ড্রেসে নাকি কাট অফ ডিজাইন খুবই চলছে। অর্থাৎ পোশাকটার শেষে তা অভিনব প্যাটার্নে কেটে দেওয়া হচ্ছে। সেটা কখনও একটু বড় ঝুলে থাকছে কখনও বা হাঁটুর ওপরেও শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ডেনিম শর্টসে যে কাট অফ স্টাইল থাকে সেটাই এখন ড্রেসেও এসেছে। এই কাট অফ সম্পূর্ণই পাশ্চাত্যের প্রভাবে তৈরি। এছাড়াও পাশ্চাত্যের প্রভাব আরও বেশি মাত্রায় প্রকট হয়েছে ফিগার হাগিং ড্রেসে। গায়ের সঙ্গে গ্লাভসের মতো লেগে থাকে এই পোশাক। আগে এই কাট ভারতে একেবারেই চলত না, এখন কিন্তু তা পুজোর ডিজাইনে উঠে এসেছে।
তবে ড্রেস বললেই যে পাশ্চাত্যের ছবি চোখে ভেসে ওঠে, আমাদের পুজোর ফ্যাশন তার তুলনায় কিছুটা আলাদা, জানালেন ঐশী। আমাদের দেশীয় এমব্রয়ডারি নিয়েও এবছর পুজোয় দারুণ নকশা তৈরি করেছেন ঐশী। সুতোর কাজ ড্রেসে উঠে এসেছে। এবং আঞ্চলিক কাজ গুরুত্ব পেয়েছে। কাঁথা কাজ, বেগমপুরি কাজ ইত্যাদি খুবই উঠে এসেছে। এই ধরনের কাজ কিন্তু হাই নেক বাটনড আপ পোশাকে করা হচ্ছে। সুতোর রং নিয়ে খেলা করেছেন শিল্পীরা। কলমকারি প্যাচ অ্যাপলিকের সঙ্গে খাদির একরঙা কাপড় ব্যবহার করে ড্রেস বানানো হয়েছে। এই ধরনের ডিজাইনের সঙ্গে আবার পাশ্চাত্যের চরিত্র বজায় রেখে হাতায় উঠে এসেছে ভিন্ন ডিজাইন। ফ্লেয়ার হাতা, কাফ হাতা, বেল হাতার সঙ্গে ফিটেড নকশা সবই হাতার ডিজাইনে দেখা যাচ্ছে। অনেক সময় আবার ফিটেড স্লিভসের সঙ্গে শো বাটন ব্যবহার করা হয়েছে।
এছাড়াও এবছর নাকি স্ট্রেট লাইন, হাই স্লিট ইত্যাদিও ড্রেসে খুবই ইন। তাতে লুকটা অবশ্যই খুবই ওয়েস্টার্ন হচ্ছে। ইউনি লুক ব্যাপারটা এখন নেই। যদি স্যুটও মেয়েরা পরে তাহলে তাতেও ফেমিনিন লুক আনা হয়েছে। আবারও ড্রেসের কথায় ফিরলেন ঐশী। বললেন, অ্যাসিমেট্রিক ডিজাইন এবার পুজোর লুকে খুব ইন। তা হাতার কাটে হতে পারে, নেকলাইনেও হতে পারে অথবা ড্রেসের লেন্থের দিকেও হতে পারে। অনেক সময় আবার নকশার ক্ষেত্রেও এই অ্যাসিমেট্রিক ডিজাইন খুব চলছে। যেমন একদিকে প্লিটেড, অন্য দিকে প্লেন। বা খানিকটা ফিটেড হয়ে নামল, তারপর ঝালরের মতো ফ্লেয়ার ইত্যাদি। আর একটা জিনিস খুবই বৈচিত্র্য এনেছে ওয়েস্টার্ন পোশাকে। যেমন সিন্ডারেলা কাটে একটা মডার্ন লুক দেওয়া হয়েছে। ফলে পাশ্চাত্যের লেয়ারগুলো বজায় রেখে ড্রেসের নকশা তৈরি করা হয়েছে। বেল স্লিভের সঙ্গে কাঁধের কাছে কাট অফ ডিজাইন এসেছে। এবং পোশাকটা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলমিশে হয়ে উঠেছে অনবদ্য।
রোজকার পরার মতো ড্রেস বানাতেই পছন্দ করেন নামেঘ ফ্যাশন স্টুডিওর ডিজাইনার এবং অন্যতম কর্ণধার মেঘালি লাহিড়ী। তাঁর কথায়, এবার পুজোয় বাড়ি থেকে কেউ হয়তো ততটা বেরতে পারবে না। তাই সিম্পল অথচ এলিগ্যান্ট লুকের পোশাক বানাচ্ছেন তাঁরা। আর এই ধরনের পোশাকের ডিজাইনে ফ্লেয়ারের সঙ্গে স্ট্রেট কাটের মিলমিশ থাকছে। ফেব্রিকের ক্ষেত্রে হ্যান্ড ওভেন ফেব্রিক নিয়েই বেশি কাজ করছেন তাঁরা। ইক্কত, স্ট্রাইপ ইত্যাদি হাতে বোনা ফেব্রিক নিয়ে যেমন কাজ হচ্ছে তেমনই এবছর ব্লক প্রিন্টেরও চাহিদা থাকবে বলে মনে করছেন মেঘালি। কিছু ক্ষেত্রে আবার হাতে বোনা চেকের সঙ্গে ব্লক প্রিন্টের মেলবন্ধনও ঘটানো হবে। এখন অল্পবয়সি মেয়েদের পাশাপাশি মধ্যবয়সী মহিলারাও অবলীলায় ড্রেস পরছেন। ফলে একটু ফ্লেয়ারি কাট তাঁদের পক্ষে বেশি মানানসই, বললেন মেঘালি। তাই ফিটেড ড্রেসের চেয়ে ফ্লেয়ারি পোশাকই তিনি বেশি বানাচ্ছেন।
ফেব্রিকের ক্ষেত্রে কটন সবচেয়ে ভালো বলে তিনি মনে করেন। বিশেষত এই পরিস্থিতিতে যখন বাইরে বেরনোর সুযোগ কম তখন সাধারণ পোশাকই ভালো। তাছাড়া কাচাকাচিরও সুবিধে এই ধরনের পোশাকে। গামছা ফেব্রিক এখন ফ্যাশনে খুবই ইন। তাছাড়া এই ধরনের ফেব্রিকে রঙের বৈচিত্র্যও প্রচুর, হলুদ, লাল, কমলা, নীল, তুঁতে এমন হরেক রং নিয়ে কাজ করা যায়। ফলে পোশাক উজ্জ্বল লাগে। আর এই গামছার সঙ্গে যদি একরঙা কাপড় প্যাচ বা কম্বিনেশন করে লাগানো যায় তাহলে ড্রেসটা অন্য ধরনের চেহারা পায়। অনেক সময় আবার গামছার স্ট্রাইপের সঙ্গে অল্টারনেট করে হাতে বোনা ফেব্রিকে চেক ডিজাইন ম্যাচ করানো হয়। এতে পোশাকে একটা ফেস্টিভ লুক আসে। তবে এই ধরনের ডিজাইন মূলত টিনএজ ফ্যাশনের জন্য ভালো। মধ্যবয়সিরা ব্লক প্রিন্ট, স্ট্রাইপ বা এক রঙা পোশাকেই বেশি স্বচ্ছন্দ। তবে ড্রেসের ঝুলের ক্ষেত্রে তাঁরাও এখন একটু এক্সপেরিমেন্ট পছন্দ করছেন বলে জানালেন মেঘালি। তাঁর কথায়, শর্ট ড্রেস হয়তো মধ্যবয়সিরা তেমন পরেন না, তবে মিডি এবং ম্যাক্সি দু’ধরনের ঝুলের পোশাকেই তাঁরা স্বচ্ছন্দ। কয়েক বছর আগেও কিন্তু ট্রেন্ড এরকম ছিল না। তখন চল্লিশের ওপর মহিলারা ড্রেসের ক্ষেত্রে শুধুই ম্যাক্সি ড্রেস বাছতেন। কিন্তু ক্রমশ পাশ্চাত্যের পোশাকে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছেন তাঁরা। তাই এখন হাঁটুর নীচ পর্যন্ত ঝুলের ফ্রক পরছেন অনায়াসে।
রেনি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় জানালেন তাঁরা এবছর পুজোর জন্য এমন ধরনের পোশাক আনছেন যা বাঙালি মহিলারা অনায়াসেই পুজো দিতে যাওয়ার সময়ও পরতে পারবেন। কোভিডের কারণে ঠাকুর দেখতে বেরনোয় এখন বড় বাধা। তাই পুজো মণ্ডপে প্রতিমা দর্শন শুধুই মাত্র পুজো দিতে যাওয়ার সময়। সাধারণত বাঙালিরা ওই সময় শাড়িই পরেন। কিন্তু শাড়িতে আবার কাচাকাচির ঝামেলা। এতসব ভেবে স্বস্তিকা বললেন, এমন ড্রেস তাঁর সংস্থা ডিজাইন করেছে যা পরে মহিলারা পুজো দিতে যেতে পারবেন অবলীলায়। কেমন সেই পোশাক? স্বস্তিকা বললেন, পুজোর পোশাক হিসেবে ইন্ডিয়ান ফেব্রিক বেছে নিয়েছেন তঁরা। তার মধ্যে যে দু’টি ফেব্রিক নিয়ে সবচেয়ে বেশি কাজ হচ্ছে তা হল চান্দেরি ও তসর। এছাড়া সুতিও রয়েছে। তবে পুজোর পোশাকে একটু জমকালো লুক দিতে চান্দেরি আর তসরই বেশি উপযুক্ত। প্লেন চান্দেরিতে রঙের বৈচিত্র্যর মাধ্যমে একটা ড্রেসি লুক দিচ্ছেন। সি-গ্রিন, মেরুন, ব্রাইট ব্লু, লাল, হলুদ ইত্যাদি রং বাছা হয়েছে এই পোশাকের ক্ষেত্রে। এছাড়া রয়েছে সোনালি রঙের আধিক্য। চান্দেরি এবং তসর দু’ধরনের ফেব্রিকের ওপরেই গোল্ডেন টেম্পল প্রিন্ট এনেছে রেনি। সাদা বা মেরুনের ওপর গোল্ড প্রিন্ট করা তসরের ড্রেস তো অষ্টমীর অঞ্জলির জন্য অনবদ্য। এছাড়া লাল তো পুজোর রং। ফলে অবশ্যই তসর এবং চান্দেরি দু’ক্ষেত্রেই লাল রঙের ব্যবহার রয়েছে রেনির কালেকশনে। প্রতিটি পুজোর দিনের জন্যই একেকটা পোশাক তৈরি করা হয়েছে এখানে। শুধু গোল্ড প্রিন্টেই নয়, এমনকী এমব্রয়ডারিতেও টেম্পল ওয়ার্ক করা হয়েছে। এবং এই যে টেম্পল ওয়ার্ক তা কিন্তু শুধুই পাড়ে করা হয়নি। গলায়, হাতে এমনকী গায়েও ছোট ছোট করে এই কাজের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। কিছু ড্রেসে আবার অলওভার কাজ থাকছে। কিন্তু সেই কাজেও সুতোর বুননে মন্দিরের কারুকাজ ফুটে বেরচ্ছে।
মধ্যবয়সি মহিলাদের কথা ভেবেই রেনির তসর কালেকশন করা হয়েছে। তসরের একটা নিজস্ব আভিজাত্য রয়েছে। আর সেই অভিজাত লুকের জন্য তা সব বয়সেই মানিয়ে যায়। রেনির তসর কালেকশনে বিভিন্ন রঙের বাহার পাবেন। তাই তা অল্পবয়সিদের যেমন মানাবে তেমনই হালকা রঙের তসরের ড্রেস আবার মধ্যবয়সিদের পরনে উঠলেও দারুণ লাগবে। স্বস্তিকার মতে পুজোর ফিলটা রেখেই তারা এথনিক লুক থেকে একটু বেরিয়ে আসতে চাইছে। কাটের ক্ষেত্রে একটু ওয়েস্টার্নের দিকেই বরং ঝুঁকেছেন তাঁরা। কিন্তু সেই ওয়েস্টার্ন কাট বজায় রেখেও স্টাইলের দিক দিয়ে এমন প্রাচ্যের প্রভাব এনেছেন যে পোশাকটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এবং এই যে কাট ও স্টাইলের সংমিশ্রণ, এর ফলে সব বয়সের মহিলার কাছেই তা আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। সবুজ, ম্যাজেন্টা, রাস্ট ইত্যাদি গাঢ় রং যেমন রাখা হয়েছে তেমনই আবার পিচ, সাদা, অফ হোয়াইট, গ্রে ইত্যাদি হালকা রং রাখা হয়েছে।
রং, ডিজাইন, ফেব্রিক, কাট এবং স্টাইলের মাধ্যমে ড্রেসের আকর্ষণ এখন বিশ্বব্যাপী। মেয়েরাও তাই গতে বাঁধা পোশাকের ঘেরাটোপ ডিঙিয়ে সব কিছুকেই আপন করে নিচ্ছে।
ছবি: রেনি ও নামেঘ