চৈতন্যদেব হরিনামের বন্যায় জগৎকে ভাসিয়ে দিয়ে গেলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতোই তাঁকেও অনেক কিছুই সইতে হয়েছিল। লোকে তাঁকে বলতে কিছুই বাকি রাখেনি। উনি নাম-সংকীর্তনে বেরোতেন একটু সেজেগুজে গলায় মালতীর মালা প’রে। একে অপরূপ সুপুরুষ, তাতে যখন সাজগোজ করে বেরোতেন তখন সকলে মুগ্ধচোখে চেয়ে চেয়ে দেখত শুধু। কিন্তু একদল ঈর্ষাপরায়ণ লোক বলতে লাগল—একে অমন রূপ, তাতে ওই সাজবেশ, লোকের আকর্ষণ হবে না কেন! আর অত ঐশ্বর্য, শিষ্যরা ভুরি ভুরি দিয়ে যাচ্ছে, তা ছাড়া অমন রূপসী স্ত্রী, এসব নিয়ে ভোগ-সুখে ডুবে থেকে নাম করা, এ আর কি?...
এসব কথা যখন মহাপ্রভু শুনলেন, তখন বুঝলেন, তাঁর সন্ন্যাস ছাড়া জীবের উদ্ধার হবে না, বিষ্ণুপ্রিয়ার চোখের জল ছাড়া জগতের কল্যাণ অসম্ভব। তিনি তখন মা এবং স্ত্রীকে অনেক বুঝিয়ে তাঁদের অনুমতি নিয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করলেন এবং পুরী চলে গেলেন। এক এক সময় তাঁর বিরাট ঐশী শক্তির প্রকাশ হয়েছে বটে, কিন্তু তিনি সেটাকে সংবরণ ক’রে নিয়েছেন, সাধারণ মানুষের মতোই আচরণ ক’রে গিয়েছেন শেষ পর্যন্ত।
আবার মানুষের জন্যই তাঁর সবচেয়ে প্রিয় পার্ষদ নিত্যানন্দ প্রভুকে সংসারে পাঠালেন। নিত্যানন্দ ছিলেন মহাপ্রভুর এপিঠ-ওপিঠ। আজীবন কঠোর সন্ন্যাসধর্ম পালন করেছেন। সমস্ত বাসনাকে জয় ক’রে সন্ন্যাসধর্মে পূর্ণ-প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারপর তাঁকে মহাপ্রভুর আদেশে সংসার করতে হ’ল। তাঁর সংসার করা নিজের বাসনা-তৃপ্তির জন্য নয়। কারণ, তিনি তো সব বাসনা-কামনার ঊর্ধ্বে। তাঁর সংসার করা গৃহীদের আশ্বাস দেবার জন্য যে, সংসারে থেকেও ভগবানকে ডাকা যায়, ভগবানকে পাওয়া যায়, তাঁর সংসার শুধুমাত্র ভগবৎ নাম প্রচারের জন্য।
তাই সম্পূর্ণ নির্লিপ্তভাবে কর্তব্যকর্মটুকু ক’রে যাওয়া ছাড়া সংসারে তাঁর আর কিছু প্রয়োজন ছিল না। এই মানুষের উদ্ধারের জন্যই মহাপ্রভুকে বিবাহের পর স্ত্রীকে ত্যাগ ক’রে সন্ন্যাস নিতে হ’ল, আবার এই জীবকল্যাণের জন্যই আজন্ম সন্ন্যাসী নিত্যানন্দকে সংসারে পাঠাতে হল।
এমনিতে দেখ, ভগবানের সঙ্গে শুধু চাওয়ার সম্বন্ধই থাকে, দেওয়ার কিছু থাকে না। কিন্তু ভগবান দেহ ধারণ ক’রে এলে মনে হয় শুধু দিতে। যেই তাঁকে নিজের আপনজন বলে কাছে পেলাম, তখন চাওয়ার চেয়ে দেওয়ার মনটাই হয়ে যায় বেশি। আত্মীয়সুলভ ভালবাসা যেই এল তখন নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে তাঁর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যটাই বড় হয়ে ওঠে। মা-যশোদার কাছে যখন গোপাল এলেন তখন তিনি তো বলেননি—কৃষ্ণ, আমাকে ধর্ম অর্থ কাম মোক্ষ এসব দে। বরং তাঁকে কী করে একটু খাওয়াবেন, আদর করবেন এই ছিল তাঁর চিন্তা। কালিয়া নাগকে দমন করতে শ্রীকৃষ্ণ দীঘিতে নামলেন শুনে মা যশোদা ভয়ে কেঁদে উঠলেন। ভগবান ভাবলে এটা হত না, মানবভাবটি না হলে নিষ্কাম বিশুদ্ধ ভালবাসাটা আসে না। ভগবানের মূর্তির কাছে তো শুধু দেহি দেহি। ভক্তি-পূজা সবের ভেতরই চাওয়াটি রয়েছে।
মহাপুরুষেরা যখন আসেন, নিজের সত্তাকে ভুলে আসেন। তাঁরা যে অধরার ধন, ধরায় এসেও তাঁরা থাকেন আপনহারা হয়ে। তাঁদের বিরাট প্রতিভার প্রতিষ্ঠার কোনও রকম চাহিদাই থাকে না। কোনও রকম retuen তাঁরা চান না। প্রেম-ভালবাসাকে ঠাকুর সব স্তরে না দিয়ে যদি একটা দিব্য স্তরের জন্যই শুধু রেখে দিতেন তো ভালো হ’ত। কারণ, ভালবাসার বহিঃপ্রকাশটা সবক্ষেত্রে প্রায় একই রকম হয় ব’লে, দিব্য ভালবাসার সঙ্গে সাধারণ কামনাবাসনাযুক্ত ভালবাসার তফাৎটা মানুষ ঠিক বুঝতে পারে না।
অর্চনাপুরী মায়ের ‘ছড়ানো মুক্তো’ থেকে