আমাদের দেশে আগেকার সাহিত্য ও সমাজে মহিলার আদর্শ ছিল যে তিনি পবিত্র হইবেন। সেটা ভাল কথা; কিন্তু তাই বলিয়া যে তিনি অতীব কোমল ও অবলা হইবেন, ঘরের বাহিরে ভয়ে জড়সড়, বিশ্বব্যাপক এক লজ্জায় অবসন্ন হইয়া বাহিরের জগতের দিকে তাকান মাত্র যথাসম্ভব অন্তঃপুরে লুকাইয়া বাঁচিবেন, এইরূপ ইচ্ছা করা ভুল। এমন হইলে তাঁহার দ্বারা পরের সাহায্য করা, বিশ্বজগতের কাছে যোগ দেওয়া দূরে থাকুক, আত্মরক্ষা করাও অসম্ভব হইবে। নিবেদিতা বলিতেন যে ইহা হিন্দুনারীর পবিত্র আদর্শের সত্য সত্যই বিরোধী। এতদিনে আমরা অনেকে তাঁহার এই মত মানিয়া লইয়াছি। যেমন ধর্মজগতে বিবেকানন্দ আমাদের ঘুম ভাঙাইয়া ঘোষণা করিলেন—ন অয়ম্ আত্মা বলহীনেন লভ্যঃ—অর্থাৎ দুর্বল যে সে আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভ করিতে পারে না, যুদ্ধক্ষেত্রেও যেমন ধর্মাসাধনায়ও তেমনি, বীর, সবল হওয়া চাই। নিবেদিতা বলিতেন যে বাঙালী মহিলারা যদি ফুলের ঘায়ে মূর্চ্ছা যাওয়াটাকে আদর্শ মনে করেন, তবে তাঁহাদের নিত্য চকিত চঞ্চল চিত কখনও মনুষ্যত্বের উচ্চস্তরে উঠিতে পারিবে না, তাঁহারা গোবেচারা জীব হইয়া থাকিবেন। প্রাচীন আর্য্য “নারীগণ যে সাহস, স্বাবলম্বন, কার্যদক্ষতা, প্রখর বুদ্ধি প্রভৃতি গুণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন সেই গুণগুলি যদি আজকালকার মাতা ও কন্যারা হারাইয়া থাকে তবে তাহা সমস্ত জাতির ক্ষতির কারণ হইবে। এইজন্য আমাদের পুরাণ, ইতিহাস আদিতে তিনি কোন কর্মঠ তেজস্বিনী নারী-চরিত্রের কথা পড়িলে আনন্দিত হইতেন, চাহিতেন যে আবার সেইরূপ নারীর যুগ ভারতে ফিরিয়া আসুক। বীর স্বাধীন-গতিশালিনী অথচ বিশুদ্ধ চরিত্রা কত কত স্ত্রী রাজপুত ও মারাঠা ইতিহাসে বিখ্যাত, তাঁহারা ভারতের কন্যা ছিলেন, এই আর্যভূমি আবার সেরূপ সন্তান প্রসব করুক ইহাই তাঁহার প্রার্থনা ছিল।
বোধগয়াতে একটি প্রকাণ্ড গোল পাথরের বেদী আছে, তাহার উপর আগাগোড়া তিব্বতী বজ্রের চিহ্ন অঙ্কিত। বৌদ্ধদের মধ্যে প্রবাদ আছে যে ভগবান বুদ্ধ যখন সুদীর্ঘ কঠোর ধ্যানের পর মানবহিতকর তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিলেন তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার বসিবার জন্য এই বজ্রাসন পাঠাইয়া দেন। ঐ স্থানে বেড়াইবার সময় নিবেদিতা বলিলেন, “মানবের হিতের জন্য যে নিজেকে নিঃশেষ দান করে, সে দেবতাদের কাজের জন্য বজ্রের মত কঠিন এক অজেয় শক্তি হ্য়।” সেইজন্য ঐ বজ্রচিহ্ন তিনি ভারতের প্রতীক বলিয়া গ্রহণ করেন, এবং তাহাই তাঁহার গ্রন্থের উপর অঙ্কিত করেন। আচার্য জগদীশ বসুও ঐ চিহ্ন সাদরে লইয়াছেন।
আধুনিক ভারতীয় নারীর নিকট এই উচ্চতর পূর্ণ মানবতার দাবি, জগতের প্রগতিতে সাহায্য করিবার দাবি, নিবেদিতা করিতেন। বৈষ্ণব সাহিত্যে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না, মলয় পবন, কোকিল কূজন, বসন্তের ফুলরাশী, নৃত্যগীত এইগুলিমাত্র গোপিনীদের ঘিরিয়া আছে। সেজন্য নিবেদিতা তাহাদের বর্জ্জন করিয়া কালীর উপাসনা প্রচার করিতেন। বাংলাদেশে পৌঁছিয়া তাঁহার প্রথম ইংরেজী বক্তৃতার বিষয় হইল—Kali the Mother। সে সভায় কোন নামজাদা হিন্দুনেতা সভাপতি পাওয়া গেল না, কালী নাম শুনিয়া কলিকাতার সভ্য সমাজ চমকিয়া উঠিলেন।
রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যামন্দির প্রকাশিত ‘দীপান্বিতা নিবেদিতা’ থেকে